হযরত সালমান ফারসীর ইসলাম গ্রহণ
লিখেছেন লিখেছেন এশিয়ান স্প্রিং ১৯ মে, ২০১৫, ০২:০৭:২৩ দুপুর
হযরত সালমান ফারসী প্রথম জীবনে একজন অগ্নউপাসক ছিলেন। পরে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং সবশেষে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি পারস্যের ইসফাহান প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। তার পিতা ছিলেন একজন বিত্তশালী গ্রাম্য মোড়ল। তিনি তাকে এত বেশি স্নেহ করতেন যে, তাকে বাড়ী থেকে কোথাও যেতে দিতেন না। তিনি জানান যে, এই সময়ে তিনি অগ্নি উপাসকদের ধর্মে গভীর দক্ষতা অর্জন করেন। এক মুহুর্তের জন্যও যাতে আগুন নিভতে না পারে-এভাবে কুন্ডলী জ্বালিয়ে রাখতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এ সময়ে ঘটনাক্রমে একটি জমি দেখাশুনার দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা হয়। এই জমি দেখতে গিয়ে তিনি পিতার অনুমতিক্রমে বাড়ীর বাইরে যাওয়া আসা করতে লাগলেন। এই সময় তার যাওয়া আসার পথের পাশে একটি খৃস্টান গীর্জা তার নজরে পড়ে। লোকজনের হৈ চৈ শুনে কৌতুহল বশতঃ তিনি সেই গীর্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। সেখানে তাদের উপাসনা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান এবং মনে মনে বলেন, অগ্নি উপাসকদের ধর্মের চেয়ে এই ধর্ম অনেক ভাল। ঐ দিন আর জমি দেখতে যাওয়া হলো না। তিনি সারাদিন গীর্জায় কাটিয়ে দিলেন। গীর্জার লোকদের কাছে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে, এই ধর্মের উৎস কোথায়? তারা জানালো যে, সিরিয়ায়। এরপর তিনি তাঁর পিতার কাছে ফিরে গেলেন। তাঁর পিতা তাঁকে জিজ্ঞাসা তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে? সালমান গীর্জার ঘটনা খুলে বললেন। সেই সাথে এই কথাও বললেন যে, ঐ ধর্ম তাঁর কাছে ভালো লেগেছে। একথা শুনে তার বাবা বললেন, না বাবা, তোমার জন্য তোমার বাপ দাদার ধর্মই ভালো।
সালমান বললেন, না বাবা, ঐ ধর্মই ভাল। এতে তিনি তাঁকে নিয়ে ভীত হয়ে পড়লেন এবং তাঁর পায়ে শিকল পরিয়ে দিলেন। এই সময় সালমান গোপনে গীর্জায় খৃস্টানদের নিকট খবর পাঠান যে, আপনাদের কাছে সিরিয়া থেকে কোনো কাফেলা এলে আমাকে জানাবেন। কিছুদিন পর সিরিয়া থেকে একটা কাফেলা এল। তারা যথাসময়ে সালমানকে সে খবর জানালো। সালমান বলে পাঠালেন যে, এই কাফেলার কাজ যখন শেষ হবে এবং তারা সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবে, তখন আমাকে জানাবেন। তারপর কাফেলার কাজ শেষে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করলে তা সালমানকে জানানো হলো। সালমান তৎক্ষণাত স্বীয় পিতার স্নেহের শিকল ভেঙ্গে গোপনে তাদের সাথে সিরিয়ায় চলে গেলেন। সিরিয়ায় গিয়ে তিনি লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেনঃ এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী কে? তারা তাকে জানালো যে, গীর্জার পাদ্রীই সবচেয়ে জ্ঞানী।
সালমান পাদ্রীর নিকট হাজির হয়ে বললেনঃ আমি এই ধর্মের প্রতি খুবই আগ্রহী। আমি আপনার সহচর হয়ে আপনার সেবা করতে চাই এবং আপনার কাছ থেকে ধর্ম শিখতে ও উপাসনা করতে চাই। পাদ্রী সালমানকে স্বীয় গীর্জায় থাকতে দিলেন এবং সালমান খৃস্টধর্মে দীক্ষা নিতে লাগলেন। এই সময়ে সালমান বুঝতে পারলেন যে, উক্ত পাদ্রী খুবই অসৎ। সে জনসাধারণের কাছ হতে সদকা আদায় করে এবং তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ না করে নিজে আত্মসাৎ করে। এভাবে সে বিপুল সম্পদ সঞ্চয় করে। সালমান এরপর থেকে তাকে ঘৃণা করতে লাগলেন এবং এই স্থান ত্যাগ করার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন।
এই পাদ্রী মারা গেলে খৃস্টানরা তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য সমবেত হয়। সালমান তাদেরকে বললেনঃ এ লোকটি চরম দুর্নীতিবাজ ছিল। সে তোমাদেরকে ছদকা দিতে উপদেশ দিত। কিন্তু নিজে তোমাদের দেয়া ছদকাগুলো আত্মসাৎ করতো। তারা সালমানকে বললোঃ তোমার এসব অভিযোগ যে সত্য, তার প্রমাণ কী? তিনি এর প্রমাণস্বরূপ তার জমা করা সাতটি সোনা রূপা ভর্তি কলসি বের করে দেখালেন। তা দেখে সমবেত জনতা ক্রুদ্ধ স্বরে বললোঃ আমরা এ নরাধমকে কবর দেব না। তারপর লাশকে তারা শূলে চড়াল। তার উপর পাথর ছুঁড়লো এবং তারপর একজন নতুন যাজক নিয়োগ করলো।
নতুন যাজক ছিল একজন নিরেট সৎলোক। পৃথিবীর ধন-সম্পদের প্রতি তার কোন লালসা ছিল না। সালমান কিছুদিন তার কাছে থাকলেন। তারপর তার মৃত্যু কাছাকাছি এলে সালমান তাকে বললেনঃ জনাব, আমি তো এতদিন এখানে কাটালাম। এখন আপনার পর আমি কোথায় কার কাছে যাবো বলে দিন।
তিনি বললেনঃ বাবা! আমি যতটা খাঁটি ধর্মের অনুসারী ছিলাম, এখন তেমন আর কাউকে দেখি না। ভালো লোকেরা সব পরপাড়ে পাড়ি জমিয়েছে। এখন যারা আছে, তারা অধিকাংশই ধর্মকে খানিকটা বিকৃত করেছে, আর খানিকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। তবে মুসেলে একজন আছে খাঁটি ধর্মের অনুসারী। তুমি তার কাছে চলে যাও।
সালমান মুসেলের যাজকের কাছে গেলন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনিও মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগে নসিবেইনের এক ব্যক্তির সন্ধান দিয়ে গেলেন। অতঃপর সালমান নসিবাইনে গেলেন। সেখানেকার পাদ্রীর কাছে কিছুদিন থাকার পর তিনিও মারা গেলেন। মারা যাওয়ার সময় আম্মুরিয়ার আর একজন যাজকের সন্ধান দিয়ে গেলেন। সালমান আম্মুরিয়ায় চলে গেলেন।
আম্মুরিয়ায় কিছুদিন থাকার পর সেখানকার যাজকও মারা গেলেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে সালমান তার কাছে একজন সৎ যাজকের সন্ধান চাইলে তিনি বললেনঃ এখন আমার জানামতে সঠিক ধর্মের কোন অনুসারী যাজক পৃথিবীতে জীবিত নেই। তবে একজন নতুন নবীর আবির্ভাবের সময় পৃথিবীতে ঘনিয়ে এসেছে। তিনি ইবরাহীম(আ) এর দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। তিনি আরব ভূমিতে আবির্ভূত হবেন এবং দুই মরুর মাঝে খেজুরের বাগানে পরিপূর্ণ জায়গায় হিজরত করবেন। তিনি হাদিয়া নিবেন কিন্তু ছদকা গ্রহণ করবেন না। তার দুই কাঁধের মাঝে নব্যুয়তের সীল থাকবে। তুমি যদি সেই দেশে যেতে পার তবে যেও।
আম্মুরিয়ায় হযরত সালমান অনেক ছাগল ভেড়া পুষতেন। তারই একপাল ছাগল ভেড়া একদল আরব বনিককে দিয়ে তিনি আম্মুরিয়া থেকে আরব চলে গেলেন। ওয়াদিল কুরাতে তারা তাকে এক ইহুদীর নিকট বিক্রী করে দিল। সালমান এই ইহুদীর খেজুরের বাগানে কাজ করতে লাগলেন। ঐ খেজুরের বাগান দেখে তিনি ভেবেছিলেন, এটাই সেই আখেরী নবীর আবির্ভাব স্থান। তাই তিনি ইহুদীর কাছে থাকতে লাগলেন।
হযরত সালমান বলেনঃ “এই সময় একদিন মদীনা হতে আমার ইহুদী মনিবের একজন আত্মীয় এল। বনু কুরায়যা গোত্রের এই ইহুদী আমাকে কিনে নিয়ে মদীনায় চলে এল। মদীনাকেই দেখে আমি চিনতে পারলাম যেন ওটা অবিকল আমার আম্মুরিয়ার ওস্তাদের বর্ণিত জায়গা। তাই আমি ওখানেই থাকতে লাগলাম। এই সময় মক্কায় রাসূল(সা) নব্যূয়ত লাভ করেছেন বলে শুনলাম। তবে তার সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর জানতে পারলাম না। কিছুদিন পর তিনি মদীনায় হিজরত করে আসলেন।
একদিন আমি খেজুর ভর্তি গাছের মাথায় চড়ে আমার মনিবের জন্য কিছু কাজ করছি। মনিব তখন আমার নিচে বসা ছিলেন। সহসা তার এক চাচাতো ভাই এসে তাকে বললোঃ আল্লাহ কায়লার বংশধরকে ধ্বংস করুন। (আওস ও খাজরাজ এই দুই গোত্রের মায়ের নাম কায়লা। তাই কায়লার বংশধর বলতে ঐ দুই গোত্রকে বুঝানো হয়েছে)। ওরা এখন মক্কা হতে আগত এক ব্যক্তির চারিপাশে ভিড় করছে। লোকটি আজই এসেছে। আওস ও খাজরাজ মনে করে সে নাকি এ যুগের নবী এবং সর্বশেষ নবী। হযরত সালমান বললেনঃ খেজুর গাছের উপর বসে আমি যখন এ খবর শুনলাম, তখন আনন্দে ও উত্তেজনায় এত বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি মনিবের ঘাড়ের উপর পড়ে যাব বলে আশংকা হচ্ছিল। অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে গাছ হতে নেমে এসে ঐ লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আপনি কার কথা যেন বলেছিলেন? অমনি আমার মনিব আমাকে ঠাস করে একটি চড় বসিয়ে দিল। সে বললোঃ তোর তা দিয়ে কি দরকার? আমি বললামঃ কিছু না. কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞেস করেছিলাম।
হযরত সালমান বলেনঃ এরপর আমি নিজের কাছে সঞ্চিত কিছু খাবার জিনিস নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় গোপনে কুবাতে রাসূল(সা) এর কাছে উপস্থিত হলাম। তাকে বললামঃ আমি শুনেছি, আপনার সাথে অনেক দরিদ্র লোক রয়েছে। তাদের কাছে আমি কিছু ছদকা এনেছি। এই বলে উক্ত খাদ্য হাযির করলে তিনি সাহাবীদেরকে তা খেতে দিলেন। কিন্তু নিজে খেলেন না। তখন আমি মনে মনে বললামঃ আম্মুরিয়ার যাজক যে তিনটি আলামতের কথা বলেছে, তার একটি পেয়ে গেলাম। অতঃপর আমি সেদিনকার মত চলে এলাম।
আর একদিন আরো কিছু খাবার নিয়ে তা হাদীয়া হিসেবে পেশ করলাম। রাসূল(সা) তা নিজেও খেলেন এবং অন্যদেরকেও খাওয়ালেন। এরপর আমি দ্বিতীয় আলামতটিও পেয়ে গেলাম।
এরপর যখন তিনি বাকীযুল গারকাদ নামক কবরস্থানে তাঁর জনৈক সাহাবীর দাফন সম্পন্ন করে ফিরে আসছিলেন, তখন আমি তাঁর কাছে উপস্থিত হলাম। সেই সময় রাসূল(সা) এর গায়ে ঢিলেঢালা পোশাক ছিল। আমি নব্যুয়তের মোহরটি দেখার জন্য তাঁর ঘাড়ের উপর চোখ বুলাতে লাগলেন। রাসূল(সা) আমার চাহনির হাবভাব দেখে বুঝে ফেললেন এবং তাঁর পিঠের উপর থেকে চাদর উঠিয়ে ফেলে দিলেন। আমি তখন নব্যুয়তের মোহর দেখে চিনতে পারলাম। আমি মোহরটিতে চুমু খাওয়ার জন্য ঝুঁকে পড়লাম এবং কাঁদতে লাগলাম। রাসূল(সা) আমাকে বললেনঃ সামনে এস। আমি সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। অতঃপর অতীতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম।
এরপর রাসূল(সা) আমাকে ইহুদীর দাসত্ব হতে মুক্ত হবার জন্য ৪০ আউন্স স্বর্ণ দিলেন। ঐ স্বর্ণ ইহুদীকে দিয়ে আমি মুক্তি লাভ করলাম। কিন্তু বদর ও ওহুদ যুদ্ধ আমার দাসত্বকালে সংঘটিত হয়। তাই আমি তাতে অংশগ্রহণ করতে পারিনি।
শিক্ষাঃ হযরত সালমান ফারসীর ইসলাম গ্রহণের এই ঘটনা অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ। এর সর্বপ্রধান শিক্ষা হচ্ছে এই যে, মুহাম্মদ(সা) ছাড়া পৃথিবীতে আল্লাহ প্রেরিত আর কোন নবীর শরীয়ত অবিকৃত অবস্থায় নেই। তাই ইসলাম ছাড়া আর কোন ধর্ম সঠিক ও নির্ভুল নয়। এই সত্য ও সঠিক দ্বীনের সন্ধান লাভের জন্য হযরত সালমান ফারসী প্রথম দিন হতেই অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। আল্লাহ তাঁর অক্লান্ত সাধনাকে সফল করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা সত্যের সন্ধানরত প্রত্যেক মানুষকেই সত্যের সন্ধান দিয়ে থাকেন।
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই ব্যাপারটি একটু বিস্তারীত জানতে চাই, হযরত সালমান ছিলেন একজন মুক্ত ও স্বাধীন মানুষ, তাকে কে বিক্রি করল? কেন করলো? স্বাধীন মানুষকে তো বিক্রি করা যায় না।
আপনার বর্ণনাকৃত ঘটনাটির উৎস জানাবেন। ধন্যবাদ।
আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন