সম্পর্কের সমীকরণ আর প্রবাসী মনের বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন সজীব শাহরিয়ার ১৮ এপ্রিল, ২০১৫, ০৭:৪৩:৩৯ সন্ধ্যা
ঠিক যে সময়টাতে আমি এ লেখাটা লিখেছিলাম ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১১ বেজে ২২ মি. জানুয়ারী ২৮, ২০১৫। জিদআলীর (বাহরাইন) ছোট্ট ফ্লাটের হলরুমে বসে বসে লিখছিলাম। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রবাস জীবনের কিছু উপলদ্ধি আর কথা লিখতে বসা। মনের মধ্যে অনেকগুলো বিষয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে নিত্যদিন। ভাবছিলাম অন্যরকম কিছু। হাতে লিখতে ইদানীং এত অসস্তি লাগে কেন বুঝতে পারি না। হাত ভেঙ্গে আসে। তাই কম্পিউটারের সাহয্য ছাড়া একেবারেই দিন দিন অচল হয়ে যাচ্ছি। তারপরও লিখাটা হাতেই শুরু করি। পেন্সিলের চালনায় ধীরে ধীরে কিছু অনুভুতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে চলছিলাম।
আমার মেয়েদের নিয়ে আজকাল বেশ ভাবনা চিন্তায় পড়ে গেছি। ওদের জন্য জীবনের বাকী সময়টাতে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার আগ্রহটাও আমাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। আমরা অনেক এক্সপেরিমন্ট করে করে বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধানে পৌছাতে পারি। যারা আমার সম্পর্কে জানে তারা একথা ও জানে আমি আমার জীবনে এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ বানিয়েছি আমার জীবন আর সংসার কে। যার পরিণামে আশ-পাশের মানুষগুলোর অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আর এই কষ্টটা সবাই আমার জন্য করেছে এটা ভাবতে খারাপ লাগে। আর নিজের যতটুকু কষ্ট হয়েছে তা বোধহয় প্রাপ্যই ছিল। ছোটবেলা থেকে সবার থেকে আলাদা হওয়ার একটা প্রবণতা আমার ভেতর প্রকটভাবে ছিল। আমি ভেবে চিন্তে এর কিছু উৎস যদিও সমীকরণে মেলাতে পেরেছি কিন্তু যে সমাধান এখন হয়ত আর কোন কাজে আসবে না। আমি যখন খুব ছোট একবার আমার বাবার সাথে আমি শুয়ে শুয়ে গল্প করছিলাম। নানা প্রশ্ন করে তাকে তাল-বেতাল করার উপক্রম। কিন্তু আমার মনে আছে সে একবারের জন্যও বিরক্ত হয়নি। আমার বাবা আমাকে দেখিয়েছিল পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে থাকার একটা স্টাইল। বাবার ভাষায় প্রেসিডেন্টরা এভাবে ঘুমায়। ছোটবেলা থেকেই প্রেসিডেন্ড হব বলেই পায়ের উপর পা তুলে শোয়ার অভ্যাস করে ফেলি। আজও আমার সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। বাবা আমাকে হয়ত সেইদিন সাময়িক আনন্দ আর অনুপ্রেরণার জন্য সে কৌশলটি হয়ত দেখিয়েছিল কিন্তু আমার জীবনে অভ্যাসটা স্থায়ী হয়ে যাবে তা হয়ত আমার কিংবা তার কারই জানা ছিল না। আমার জেষ্ঠ কন্যা জেনেটিকভাবে একই অভ্যাস পেয়ে গেল। অথার্ৎ সেও পায়ে পা তুলে ঘুমায়। সবার থেকে আলাদা হবার চরিত্রটি আমাকে গণমানুষ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। অহমিকা নয় যদিও এটা, তুবু নিয়মিত স্রোতের আগে যেতে চাইলেও হয়ত মানুষ পথ হারা হয়। মানুষকে তার জীবনের নিয়মিত স্রোতের অনুকূলেই সাগর পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌছাতে হয়। আর কেউ যদি তার একটু ফের করতে চায় তবে আমি নিঃশ্চিত বলতে পারি যাত্রাপথের যেকোন এক পযার্য়ে হলেও তাকে নিয়মিত স্রোতের সাথে এসে মিশতে হবে। শুধু পাথর্ক্য এতটুকুই যখন সে এশে মিশে যায় স্বাভাবিকতায় তখন সে দেখতে পায় দূর্বলতম সহযাত্রীগুলো এতটা উচ্চতায় পৌছে গেছে সে উচ্চ্তায় পৌছানো তার জন্য দুঃস্ধ্য কাজ। সমস্ত অরডিনারী অপছন্দ করেছি হতে চেয়েছি এক্সট্রা অরডিনারী। হয়েছিও অসধারন তবে সেটা লেস দ্যান অরডিনারী। জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ন একটা সময়কে গুরুত্বহীনভাবে কাটানোর কিছু মাসুল দিতেই হয় তাই নয় কি?
তবে হ্যা আমি কিন্তু অতিমাত্রায় ব্যাথিতও নই। শোক-তাপ থাকলেও মাঝে মাঝে হারানো পথেই কেন জানি আসল পথের আলো দেখতে পারি। লাইট অব দ্যা এন্ড অব ট্যানেল। গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে দেখলাম আমি বাংলাদেশে ফিরেছি আর আমার ছোট মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি। ঘুমের মাঝেও যে মানুষের অনুভুতি এতটা প্রবল আমার জানা ছিল না। মুহুর্তেই বুকটা ভারি হয়ে উঠল। নিজের সন্তানকে কাছে পাওয়ার আকুতি মনে হয় আস্তে আস্তে অবচেতনাতেই প্রবল হয়েছে। ঘুম ভেঙ্গেছে কিন্তু ভাঙ্গেনি অনুভুতি। আমার শুধু বিস্ময় লাগে এই ভেবে পৃথিবীর সব বাবারই কি এমন লাগে? আমার বাবাকেও ছোটবেলায় দেখেটি রোবটের মত কাজ করতেন। আমাদের জন্য বাহারী খাবার আনতেন কিন্তু নিজে কখনই খেতেন না। মেয়েদের পছন্দের খাবারগুলো যখন সামনে আসে তখন তা খেতে ইচ্ছে করে না পৃথিবীর সব পিতারাই কি এরুপ স্বাধহীন লৌহমানব? বিষয়গুলো একটু কম্প্লিকেটেড, আর কিছু জিনিস কম্প্লিকেটেড থাকাই ভাল। মায়া ভালবাসার এই শৃংখলে জীবন চলার যৌগিক পথে সম্পর্কের মত মৌলিক সমীকরণ একটু জটিল থাকাটাই স্মুথ। খুব দ্রুত অর্থাৎ কাছকাছি সময়ে একাধীক শিশুরা আমার স্ত্রীর কোল জুড়ে নেয় আর তার জন্যই এখন তাকে একটা মেকানিক্যাল ডিভাসেই পরিনত হতে হয়েছে। রাত-বিরাত তার হরদম ডিউটি আমাকে বিস্মিত করেছে। বিস্মিত হয়েছি এই ভেবেও আমাকেও একজন মা তার সমস্ত কষ্ট উপেক্ষা করে জীবনের এই প্লাট ফর্মে পৌছে দিয়েছে।
আমার স্ত্রী সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে একা একা পথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছে। মা বাবার উভয়ে জায়গাতেই ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে তাকে। অবাক হই যখন দেখি তার রোবোটিক পারফর্মেন্সের মধ্যেও নরম সৌখিন কিছু অনুভূতি এখনও সজীব। পাক্ষিক অথবা মাসিক যেভাবেই হোক তিনি তার রুটিন ঝগড়া টেলিফোনেই সেরে নেন। কন্যাদের আসামী করে প্রতিদিনকার মামলাগুলোর চার্জশিট প্রতিদিনই সেরে ফেলেন। কারো আচরণগত সমস্যা, কারো হয়ত ঠান্ডা পানির ধরা থেকে অসুখ বাধানো ইত্যাদি মামলাগুলো নিয়মিত। গত পহেলা জানুয়ারী ছিল বিশ্ব অভিযোগ দিবস। খুব সকালেই বাংলাদেশ থেকে ফোন বেজে উঠল ।রিসিভ করতেই বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়ে গেল। মিনিট পাচেক অভিযোগ গঠন, দোষারোপ এবং নিন্দা জ্ঞাপন। তবে আজকের আসামী আমি নিজেই। প্রধান অভিযোগ আমার এতগুলো বাচ্চা কেন। এবং তারা এত বিরক্ত করে কেন। কিছুক্ষন হতভম্বের মতন সব শুনলাম এবং পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগেই সাইক্লোন শেষ হয়ে গেল। লাইন কেটে দিল। সবকিছু এলোমেলো লাগছিল ঘুম ঘুম চোখে সবকিছু চিন্তাই করতে সমস্যা হচ্ছিল। তারপর নিজেই নিজে বললাম, আমাকে না বললে বলবে কাকে? এইভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সম্পর্কের এই অবাস্তব অংকগুলো না বুঝলে মনে হয় সংসার হয় না।
আজকাল দিনে যেভাবে দ্রুত ধ্বংসশীলতার মধ্যে দিয়ে পারিবারিক ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে সেই স্তরে এরুপ কতিপয় অভিযোগকে অনুযোগ মনে করে সুখ সুখ উপলদ্ধিই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?
বিষয়: সাহিত্য
১০৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন