"রামাদান মাসে আমল"
লিখেছেন লিখেছেন মহিউদ্দিন মাহী ০২ জুন, ২০১৬, ০৮:০৮:৩৫ রাত
প্রিয় ভাই/বোন,
আসসালামু আলাইকুম…………
আহলান-সাহলান,
মাহে-রামাদান;
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের শুভ বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে আবারও হাজির হচ্ছে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী মহাগ্রন্থ “আল কুরআন” নাযিলের মাস শাহরু রামাদান। একজন একনিষ্ঠ মুমিন ব্যক্তির চলার পথের একমাত্র পাথেয় হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ। আর যেহেতু এই রমজান মাসেই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে সেহেতু একে যথাযথভাবে অনুশীলন করার এটাই উত্তম সময়।
এ মাসটি মূলত একটি ‘ট্রেনিং পিরিয়ড’। একটা সময় ছিল যখন রমজান মাস আসলে সকলের মধ্যে কী এক স্বর্গীয় অনুভূতি কাজ করত! কিন্তু আজ দিনে দিনে আমরা হারিয়ে ফেলছি সে অনুভূতি। কিন্তু কেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই অনেক জবাব দিবেন, সব প্রশ্নের জবাব একটি- মহিমান্বিত এ রমজান মাসকে নিয়ে আমাদের বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। তাই আমরা যদি বিশেষ কিছু পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া (আমল)-এর মাধ্যমে মাসটি পালন করতে পারি তাহলে বরকতময় এ মাসের মধ্য দিয়ে আমরা মহান প্রভূর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবো। চলুন তবে মনে করে দেই এমন কিছু বিষয়-
১. মানসিক প্রস্তুতি (নিয়ত)-
নবীজী (সা.) রমজান মাসের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতেন এবং রজব মাসের চাঁদ দেখে মাহে রমজান প্রাপ্তির আশায় বিভোর থাকতেন। এমন বরকতময় মাসটি যাতে হেলায় বিনষ্ট না হয় সেজন্য পূর্ব থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। যেহেতু এই লেখাটি রমজান শুরুর আগেই লিখছি তাই এখন থেকেই আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ মনোজগৎকে এমনভাবে সাঁজাতে হবে যাতে আমরা এই রমজানের পরিপূর্ণ হক আদায় করে মহান আল্লাহর ঘোষিত পুরস্কার লাভে নিজেদেরকে ধন্য করতে পারি।
২. জামায়াতে সালাত আদায়-
যদিও সব সময়ের জন্যই জামায়াতে সালাত আদায় করার ব্যাপারে যথেষ্ট তাকিদ দেয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে অবশ্যই রমজানে জামায়াতে সালাত আদায় করা জরুরী। মহান আল্লাহর নির্দেশ-“আর তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর” (সুরা বাকারা-৪৩)। তাছাড়া তারাবীহ সালাত আদায়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিৎ।
এক্ষেত্রে পুরুষদের জন্য মসজিদে যাওয়াই শ্রেয়। কেননা এতে সালাতে খুশু ও একাগ্রতা হাসিল হয় পাশাপাশি সামাজিক সম্প্রীতি সুদৃঢ় হয়।
৩. কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন-
“রমযান মাস হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী”-(সূরা বাকারা-১৮৫)।
যেহেতু এই রমজান মাসেই পবিত্র কুরানুল কারীম অবতীর্ণ হয়েছে তাই এ মাসই অধিক পরিমাণে কুরআন অধ্যয়ন করার মোক্ষম সময়। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু তেলাওয়াতের ‘খতম’ করাই যথেষ্ট নয় বরং এটি হচ্ছে কুরআন অনুধাবন ও উপলব্ধির মাধ্যমে এর শিক্ষা বাস্তবায়নের উপযুক্ত সময়। এজন্য বাসা,মেস,অফিস সবখানেই দৈনিক একবার হলেও ফরজ নামাজের শেষে দারসুল কুরআন/দারসুল হাদিসের আয়োজন করা যেতে পারে।
৪. কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ)-
“রাত্রিতে দন্ডায়মান হোন কিছু অংশ বাদ দিয়ে, অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা কিছু কম”-(সুরা মুযযামমিল-২,৩)
মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের এক অনন্য মাধ্যম হচ্ছে কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদের সালাত। রমজান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। রমাদানের কারণে আরো বেশি ফজিলত রয়েছে। যেহেতু সেহরি খাওয়ার জন্য উঠতে হয় সেজন্য রমজান মাসে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করার বিশেষ সুযোগও রয়েছে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত’’ [সহিহ মুসলিম : ২৮১২]
৫. দান-সাদকা –
রমজান মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।নিকটাত্মীয়,ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব-মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় এটি।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন। হিসাব করে এ মাসে যাকাত দেয়া উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমাদানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত’’ [বুখারি : ১৯০২]।
৬. সার্বক্ষণিক দোয়া ও ইস্তেগফার-
দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এজন্য এ মাসে বেশি বেশি দোয়া ও নিজ কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার করা মুমিন ব্যাক্তির কর্তব্য।
হাদিসে এসেছে, ‘‘ইফতারের মূহূর্তে আল্লাহ রাববুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমাদানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে’’ [আল জামিউস সাগীর : ৩৯৩৩]
‘‘রমযানের প্রতি দিবসে ও রাতে আল্লাহ তা‘আলা অনেককে মুক্ত করে দেন। প্রতি রাতে ও দিবসে প্রতি মুসলিমের দোয়া কবূল করা হয়’’ [সহিহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ১০০২]
৭. ইফতার করানো-
রমজান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল হচ্ছে ইফতার করা এবং করানো।
হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল(সা.) বলেছেন, যে রোজাদারকে ইফতার করালো, তারও রোজাদারের ন্যায় ছাওয়াব হবে, তবে রোজাদারের নেকি বিন্দুমাত্র কমানো হবে না। (তিরমিজি, ইবনু মাজাহ, নাসাঈ)।
সাহাবীরা বলেন, হে আল্লাহর রসূল (স.) আমাদের এমন সংস্থান নেই যা দিয়ে আমরা কাওকে ইফতার করাতে পারি? তিনি (স.) বলেন, আল্লাহ তাকেও এই সওয়াব দেবেন, যে ব্যক্তি কোন রোজা পালনকারীকে এক ঢোক দুধ অথবা একটা শুকনো খেজুর কিংবা এক চুমুক পানি দিয়েও ইফতার করাবে আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়াবে আল্লাহ তাকে আমার “হাউজে কাওছার” থেকে এমন ভাবে পানি পান করাবেন যার ফলে, সে জান্নাতে না পৌছানো পর্যন্ত আর তৃষ্ণার্ত হবে না। ( বায়হাকী ওয়াবুল ঈমান)
৮. সুন্নাতের অনুসরণ-
যেহেতু রাসুল (সঃ)কে “জীবন্ত কুরআন” বলা হয়েছে সেহেতু এই কুরআনকে অনুসরণ করতে হলে অবশ্যই তাঁর শেখানো পদ্ধতি অনুযায়ীই তা করতে হবে।আর রাসুল (সঃ) এর শেখানো প্রক্রিয়া অনুসারে ইসলামকে পালন করার নামই সুন্নাহ।রামাদান যেহেতু মুমিনের প্রশিক্ষণের মাস তাই এ মাসে সুন্নাতে রাসুলের (সঃ) পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হবে যাতে করে এই শিক্ষা অনুযায়ী বছরের বাকি সময়টা অতিবাহিত করা যায়।
৯. সার্বক্ষণিক পবিত্রতা-
পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গস্বরূপ।তবে এ পবিত্রতা শুধু বাহ্যিক বা শারীরিক নয় বরং আত্মিক পবিত্রতাও এর অন্তর্ভুক্ত। তাই একজন মুমিনের জন্য সদাসর্বদা পবিত্র অবস্থায় থাকাই বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে রোজাদার অবস্থায় যথাসম্ভব অজুর হালতে থাকা এবং অন্তরকে সকল প্রকার অন্যায় ও অশ্লীল চিন্তা থেকে মুক্ত রাখা রোজার মৌলিক দাবী। রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন, ‘যে রোজা রাখলো অথচ মিথ্যা কথা, মিথ্যা কাজ এবং পাপাচার ছাড়তে পারলো না, তার না খেয়ে থাকায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’(মুসলিম)।
১০. অধীনস্থদের প্রতি কোমলতা-
মাহে রমজানের একটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা হলো অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও সহিষ্ণুতা। তাই এ সময়ে অধীনস্থ সকলের প্রতি কোমলতা প্রদর্শন অপরিহার্য। রমজান মাসে অফিস,আদালত,ব্যবসা তথা সকল কর্মক্ষেত্রে সীমার মধ্যে যতদূর সম্ভব অধীনস্থদের প্রতি শ্রমের বোঝা লাঘব করা অশেষ সাওয়াবের কাজ।
১১. ইতিকাফ করা-
ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা। অর্থাৎ মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কোরান তিলাওয়াত, দোয়া, ইসতিগফার ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা। এ ইবাদাতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রমাদানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমাদানের শেষ দশ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ ই‘তিকাফ করতেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘‘প্রত্যেক রমাযানেই তিনি (সঃ) শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রমযানে তিনি ইতিকাফ করেছিলেন বিশ দিন’’ [সহিহ আলবুখারী : ২০৪৪]। দশ দিন ই‘তেকাফ করা সুন্নাত।
১২. ইনসাফভিত্তিক সমাজ নির্মাণ-
মাহে রমজানের বরকতে একজন অঢেল সম্পদের মালিকও একজন অভূক্ত ব্যক্তির যন্ত্রণা উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়ে থাকে। তাই রমজানের অপরিহার্য দাবী হচ্ছে একটি ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করা। আর এক্ষেত্রে প্রত্যেক রোজাদারকে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সর্বোপরি কথা হচ্ছে, ছোট্র এ লেখার মাধ্যমে রমজানের আমল সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়। একনিষ্ঠভাবে সিয়াম সাধনার মাধমে ব্যক্তি চরিত্রের উন্নয়ন ও মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনই রমজানের সার্থকতা। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে যথাযথভাবে সিয়াম পালন করে তাঁর ঘোষিত পুরস্কার গ্রহনে ধন্য হওয়ার তাওফিক দান করুন।
আমিন।
বিষয়: বিবিধ
২০০৪ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক সুন্দর একটি লিখা মাশাআল্লাহ।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ @'ইভেনিং স্টার'
আর গাজী ভাইকেও।
আসছি পরে....
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ @'ইভেনিং স্টার'
আর গাজী ভাইকেও।
শুকরিয়া।
শুকরিয়া।
রমাদান সম্পর্কিত আজ এখানে যে ক'টি লেখা পড়লাম তার মধ্যে আপনারটাই সবচে' ভালো লাগলো!
আলকুরআনের (১)বিশুদ্ধ পঠন শেখা/শেখানো এবং (২)অর্থ/শব্দার্থসহ পাঠ - এ দুটো বিষয় জুড়ে দিলে আরো সুন্দর হতো!
জাযাকাল্লাহ..
মন্তব্য এবং পরামর্শের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। #আবু_সাইফ.
মন্তব্য এবং পরামর্শের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। #আবু_সাইফ.
এখন আমরা মানুসিক প্রস্তুতি নেই, তবে নামি দামি ইফতার, লোকদেখানো তারাবীহ তে শামিল হওয়া, ব্যবসায় নতুন নতুন অনুষঙ্গ যোগ করে মুনাফা অর্জন করা, পোশাক কেনায় প্রতিযোগিতা ইত্যাদিতে প্রস্তুতি কেন্দ্রিভূত হয়ে যায়।
খতম তারাবীহ পড়তে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, তাই কিতা করতাম আমি।
খুবই উত্তম বলেছেন, দারস দেওয়া উচিৎ।
এখন মানুষ অন্যকে ইফতার করানোতে খুবই ততপর, কিন্তু উদ্দেশ্যে ব্যাপক ঝামেলা। হয় নিজের বড়ত্ব জাহির, অথবা প্রতিষ্ঠানের প্রচার ও প্রসার।
আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক এবং দুকলা করুন।
আমলের ব্যাপারে কথা হচ্ছে প্রত্যেকের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা উচিৎ। কেননা আল্লাহ তায়ালা সাধ্যাতীত কোনোকিছুই কারো ওপর চাপিয়ে দেন না।
আল্লাহ যেন আপনার দোয়া কবুল করেন।আমীন।
امين يارب
অনেক প্রয়োজনীয় একটা লিখা
জাঝাক আল্লাহ খাইরান,
যে রমজান মাস পেলো কিন্তু নিজেকে দোজখের আগুন থেকে রক্ষা করলো না, তার জন্য ধংস,
মহান আল্লাহ, আমাদেরকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করুন, আমিন
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে/আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
দোয়া চাই...মাসুম ভাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন