বিমান সার্ভিস
লিখেছেন লিখেছেন আমি পাগল ১৭ এপ্রিল, ২০১৫, ১০:২৯:৩৬ সকাল
বাংলাদেশ বিমানের বিমান বালাটি কঠিন একটা ভাব নিয়ে ,প্লেনের দরজার পাশে দাড়িয়ে অতি বিনয়ের সাথে প্রবাশি প্যাসেঞ্জারদের বিদায় অভিবাদন জানাচ্ছে । একবার মন চাইল বিমানবালাকে জিজ্ঞেস করি "ইজ কিউজমি আপনার বয়স কত?" কিন্তু সাহশে কুলালনা । যাই হোক, বিমান বালার সামনে দিয়ে যত গুলো প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে সবাইকে টেপ রেকর্ডারের মত করে শোনাচ্ছে "ধন্যবাদ আবার আসবেন!ধন্যবাদ আবার আসবেন! পরনে দামী শাড়ি পায়ে উঁচু পেন্সিল হিল আর ঠোঁটে বেমানান পটের বিবিদের মত করে লিপ ইস্তিক মাখা । চলন ভঙ্গি দেখলে ইয়াদ আসে ফাশান টিভির কথা ।লাপাক ঝাপাক কিছিমের আর কি। ক্যাটওয়াক ও বলা যেতে পারে।হাসি দেখলে মনে হয় , বিমান বাংলাদেশের কাছে হাসি গুলো সস্তা দরে বিক্রি করা হয়েছে। পানসে ধরনের হাসি । উনার মুখে মেকাপের পরিমান এত বেশি যে ,তাকে দেখতে আর মানুষের মত মনে হচ্ছে না । মনে হচ্ছে আলিফ লায়লা সিরিজের ডাইনী, চুরেলদের মত কোন এক চিজ বিমানে ঢুকে পড়েছে।যে কোন মুহূর্তে কিছু একটা অঘটন হয়ে যেতে পারে।
কত পথ পাড়ি দেয়েছি বা এই মুহূর্তে কোন দেশের উপর দিয়ে যাচ্ছি তা ম্যাপ আকারে জানা যাচ্ছে সিটের সামনের সংযুক্ত মনিটরটিতে।ঠিক ভিডিও গেমসের মত বাবস্থা । গান শোনার ও বাবস্থা আছে তবে বেশি ভাগই অকেজো । আমাদের বিমানটি যখন মিয়ানমার এর সিমান্ত অতিক্রম করছিল তখন যশোরের এক ভাইয়ের চিৎকার শুনলাম । ঘটনা উনুসন্ধানে জানতে পারলাম , ভাইটি আমার পেশাব করতে যাবে কিন্তু বিমানবালা যেতে দিচ্ছেনা । বার বার পেশাব করার উনুমতি চেয়ে বেচারা বার্থ হয়েছে । ঠিক সংলাপ সংলাপ করে যেমন বার্থ হয়েছে সুশীল সমাজ । বিমানবালা বলছে একটু পর । আর একটু চেপে রাখুন । রেগে মেগে ভাইটি বলছে -
"কি আপা তখন থেকে চেপে রাখুন চেপে রাখুন করছেন । আমি কিন্তু এখানেই ভাসিয়ে দিবানে কইলাম ।আর কিন্তু সহ্য হচ্ছেনা । বাংলাদেশের পেশাব কি আমি মালেশিয়াতে করব নাকি । তাজ্জব কথা। মনে করতেছেন ফ্রী ফ্রী বিমানে উঠছি না ।স্যাপ দিয়ে গুনে গুনে টাকা দিছি ।এ কোন পেলেনে উঠলাম"। বিমানের ভিতর ভাসিয়ে দেবার ভয়েই শেষ মেশ বিমানবালা উনাকে টয়লেটে যেতে দিলেন । যশোরের লোক বলে কথা ।বাংলাদেশের গ্রাম থেকে আসা সহজ সরল মানুষ গুলো জিবনে যদি প্রথম বার বিমানে উঠে, তবে একটু আধটু ছটফটানি করবেই এটাই স্বাভাবিক । শহুরে মানুষ এর থেকে আরও বেশি করে ।বিমানের ভিতর শেলফি জর শুরু হয়ে যায়। মনে হয় পুরো বিমানটা একাই রিজার্ভ নিয়েছে ।শহুরে মানুষদের বিমানের ভিতরে এ রকম ছটফটানি না করলে বুঝি শহুরে ভাব বজাই থাকেনা। নিজের দেশের বিমান বলে কথা । ভাবটা এরকম যে , এত টাকা দিয়ে নিজ দেশের বিমানে উঠছি ফাজলামি নাকি ।বিমানে আসন গ্রহনের একটু পর বিমান বালা সিট বেল্ট বাঁধার নিয়ম কানুন শেখালেন। এই ফুটার ভিতর এটা ঢোকান ওর ভিতর থেকে ওটা বের করুন লাইফ জ্যাকেট আপনার সিটের নিচে, মাথার উপরের সুইচ চাপ দিলে অক্সিজেন মাস্ক ঝুলবে ঠিক ফাঁসির মঞ্চে দড়ি ঝুলার মত ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আমরা তার কথা মাফিক জায়গা মত সব ঠিক ঠাক ঢুকিয়ে চুপ চাপ বসে আছি।আমার পিছনের ছিটে বসা লোকটি তার লোক কে সিট বেল্ট বাঁধানো শিখাচ্ছে । অথচ বিমানবালা যখন জানতে চাইল সবাই সিট বেল্ট বাঁধতে পারছে কিনা তখন কিন্তু আমার ঐ দুই বাক্তিই সর্ব প্রথম হাঁ বলেছিল ।যাই হোক, পিছন থেকে আমার কানে আসলো ,ওরা একে অপরকে বলা বলি করছে।
-কেমনে কি রে ? ফুটা কই? ঢোকে না তো ।
-আরে থাম এইডা কি? এত্ত বড় ফুটা তাও তোর নজরে পরতাছে না । তুই রাত কানা নাকি?
পেছন ফিরে দেখি দুই মুরুব্বি। কিলিন শেভ ।থুতনির নিচে কাটা দাগ। ব্লেটের আঁচড় খুব পষ্ট । আজ সকালেই শেভ করা । কালচে চেহারা চক চক করছে । মাথা ভর্তি কাচা পাকা চুল । চোখে মুখে গ্রাম্য সরলতা। ইয়ার হোসটেজ সিট বেল্ট বাঁধার নিয়ম কানুন বাতলিয়ে দিয়ে পিছনে এক কোণায় বসে অন্য এক কলিকের সাথে গল্পে করছে । যেখানে ইস্পেশাল খাবার দাবার থাকে । আমার সামনের কয়েকজন পাসেঞ্জার বিমানের ভিতরকার ছবি তুলছে। জানালা দরজা কোন কিছুই বাদ পড়ছে না । ভাব সাব দেখে মনে হচ্ছে তাজমহলের ছবি তুলছে । যার প্রতিটা অংশ বিরাট মূল্যবান কোন কিছু বাদটা দেওয়া যাবেনা । বাদ দিলে বিরাট লস হবে। সম্ভবত টয়লেটের ছবিও তুলেছে। মোবাইল এর ফটো গ্যালারি খুঁজলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে। ওখান থেকে একজন বিমানবালা এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল ছবি তোলা অফ ! বিমান এখন ফ্লায়িং করবে । বলাও সারা অম্নি বিমানের দৌড়ানও শুরু । দাঁড়ানো কিছু পাসেঞ্জার ধব ধব করে ছিটের উপর আছাড় খেয়ে পড়লো । এক জন বলল -ল্যাউ ঠ্যালা। শো শো শব্দের পরিবর্তে কুত করে একটা শব্দ শুনলাম । জানিনা কোথা থেকে আসলো এ শব্দ । বিরাট ঝাকুনি বাকুনি তে বিমানের প্রত্যেকটা পার্টসের আলাদা আলাদা শব্দ শুনলাম । প্রথমে আল্লাহ , পরে মাকে স্মরণ করলাম । বিরাট আতংক মাখা মুখ নিয়ে বয়স্ক বিমান বালাটি আমাদের সবাইকে আইতুল কুরছি পড়তে বলল ।আমার ডান পাশে বসা এক মোটা ভদ্রলোক বিমানবালার সতর্ক বাণী শুনে হাই ফাই হাই ফাই করা শুরু করে দিল । দেখেই বোঝা যায় উনি হার্ডের রোগী । ভদ্রলোক সহ সবাই চোখ বড় বড় করে আইতুল কুরছি পড়তে লাগলো । জানের মায়া বড় মায়া ।এদের সবার অস্থিরতা দেখে আমি নিজেই আইতুল কুরছি ভুলে গেলাম । কাউকে জিজ্ঞাস করার সাহস পেলাম না ।আমি সিটের নিচে লুকানো লাইফ জ্যাকেট হাতরাচ্ছি । ।আর আয়তুল কুরসি মনে করার চেষ্টা করছি । বলা তো যায়না কখন কি ঘটে । তবে শুধু শুরা ফাতিহার আয়াত গুলো মনে পড়ছে । ওটাও পরে ভুলে যেতে পারি বিধায় আমি ফটা ফট শুরা ফাতিহা পাঠ করলাম । মনে হল আমি বিমানে নয় জঙ্গলের মধ্য ভাঙ্গা চোরা রাস্তা দিয়ে মফিজ গাড়ি(ব্রেক বিহিন) চেপে কোথাও যাচ্ছি ।যা থামবে লাস্ট ইষ্টিশন জাহান্নামে ।অনেক বছর আগে গাজীপুর গিয়ে ছিলাম জঙ্গল দেখতে । যাবার পথে একবার এরকম ঝাকুনি খেয়ে ছিলাম ।ঐ রকম ঝাকুনি আমি আমার বাপের জন্নমেও খাইনি । ঝাকুনিতে নিজেকে টেনিস বল মনে হচ্ছিল । দু পাশে জঙ্গল। তার মধ্যে খাই খন্দকে ভরা নির্জন রাস্তায় চলছে গাড়ি ।প্রচণ্ড গতিতে চলতে গিয়ে চাকা পাংচার হল । তাও আবার গহীন বনের মাঝখানে । সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । অচেনা জায়গা ।আর খানিকক্ষণ বাদেই ঘন জঙ্গলকে গ্রাস করবে কাল অন্ধকার। সে এক ভয়ানক ব্যাপার ।
বিমানের ঝাঁকুনিতে বাকের ভাইয়ের "হওয়া মে উরতা যায়ে মেরা লাল দু পাট্টা মাল মাল" গান মনে পড়তে লাগলো। মনে মনে গাইলাম দু লাইন। যাইহোক, তেমন কিছু হলনা মাঝে মধ্যে দু একবার ঝাকুনি দিতে দিতে সামনে ভেসে চলল । এই ঝাকুনি কে বিমান বাংলাদেশের ফ্রী মাসাজ সার্ভিস হিসেবেই মেনে নিলাম । ঘণ্টা খানিক পর খাবার চলে এল । খাসীর মাংস দিয়ে বিরয়ানী সাথে এক বাটি পায়েস । এবং একটি ঔষধ সেবনের কাপে কয়েক বুন্দ কোক । এরকম ২০ কাপের সম পরিমান এক বোতল অরজিনাল কো কা কো লা হবে। গরুর মাংস ভেবে এক নেপালি পাসেঞ্জার তার বিরয়ানী আমার পাশের ভদ্রলোককে দিল । আমার পাশের ভদ্রলোকটি গ্রগাসে গিলে লম্বা একটা ঢেঁকুর তুলল । এবং খাবার পরিবেশন কারীকে বলল ;
বিয়ার দিবেন্না ? মানে সফট এল্কাহলিক আরকি ।
খাবার পরিবেশনকারী অবাক হয়ে বলল;
-বিমান বাংলাদেশে এ সবের বাবসস্থা নেই ।
ভদ্রলোক আমার দিকে মন খারাপের ভংগিতে বলল ;
-খামাখা বাংলাদেশে বিমানের টিকিত খরিদ করলাম । ভেস্ত মানি । বিমানবালা গুলো সব আমার নানীর বয়সের । অল আর বরিং ফেস ।এই চার ঘণ্টা যে এখন কি করে কাটবে । ঘুমও আসবেনা ভিতরে খালি বিমানের নাট বোল্টুর ঝন ঝন আওয়াজ ।
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই । পাশের ভদ্রলোকের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রায় ভোর । মালেশিয়ার এয়ারপোর্টের বাতি গুলো নিভু নিভু করছে । মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরে এসেছে । সেই সাথে কিছু এস এম এস ।উঠুন উঠুন আমরা পৌঁছে গেছি । কি আবারও কি এই বিমানে করে আসবেন?
আমি মুচকি হেসে লাগেজ আর পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বিমানবালার সামনে দিয়ে নিচে নেমে আসলাম। আমার কানের কাছে বাজলো সেই টেপ রেকর্ডটি, ধন্যবাদ আবার আসবেন!
বিষয়: বিবিধ
২২৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন