শিক্ষক যখন বন্ধু ও প্রদর্শক

লিখেছেন লিখেছেন সেলিম উদ্দিন৭২১ ৩০ জুন, ২০১৫, ১১:৪৪:২৪ রাত



সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম গ্রহন করিনি।অতএব চরম দারিদ্রতার সাথে সে শৈশব থেকে সখ্যতা।পিতা শিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু মা-নিরক্ষর। অথচ পড়াশুনার প্রেরণা পেয়েছি বরাবরই মায়ের কাছ থেকে।কিভাবে যে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছিলাম জানিনা। তবে হ্যাঁ, তৃতীয় শ্রেণি পেছনে ফেলার পর সবাই বলতে শুরু করল-এই ছেলেটা মেধাবী। মেধাবী হবার সুফল বা কুফল সম্পর্কে তেমন একটা ভাল ধারনা ছিলনা। একেতো অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে দ্বিতীয়ত অভাবের দৈত্য দুয়ারে দাঁড়িয়ে।বাড়িতে কেঊ শ্রেণির পাঠে সাহায্য করবে সে রকম জ্ঞানের চেরাগও আশেপাশের ঘরে অনুপস্থিত।নিজেই ছাত্র, নিজেই শিক্ষক। বেশ মজ়া।তবু কেন যে সবাই ভাল ছাত্র বলতো জানিনা।তৃতীয় শ্রেণি,চতুর্থ শ্রেণিতে প্রথম হতে না পারলেও যথাক্রমে তৃতীয় ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার অপরাধ করে ফেলি।প্রতিদ্বন্ধিতা হত আমরা চারজনের মধ্যে। তিনজন মেয়ে আমি একা। পঞ্চম শ্রেণিতে আবারো দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন আমরা তিনজন বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করবো।অন্য মেয়েটা তার চাচাত বোনের সাথে পঞ্চম শ্রেণি না পড়েই ষষ্ট শ্রেণিতে চলে যায়।বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। প্রধান শিক্ষক মহোদয় জনাব হাতেম সিকদার প্রকৃত অর্থেই শিক্ষানুরাগি ছিলেন। তিনি প্রতিদিন আমাদের স্কুল ছুটির পর পড়াতেন। টাকা পয়সা নিতেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল আমরা যাতে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে তাঁর সুনাম বৃদ্ধি করি। পটুয়াখালির মানুষ ছিলেন। দীর্ঘ সাতাশ বছর তিনি আমাদের বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। মাঝে কিছুদিনের জন্য অন্য স্কুলে বদলি হলেও এলাকাবাসী তাঁকে আবার আমাদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন। শেষ পর্যন্ত অবসরে যাবার এক বছর আগে নিজ এলাকায় বদলি নিয়ে চলে যান।এলাকার প্রতিটি ঘরের খবর তিনি জানতেন।সবার নামধাম তাঁর নখদর্পনে ছিল।পঞ্চম শ্রেনীতে বৃত্তি পরীক্ষা দেবার জন্য আমাকে তিনি"বৃত্তি সহায়িকা" কিনে দিয়েছিলেন। একদিন তিনি বললেন-"বৃত্তি পরীক্ষার ফি পঁচিশ টাকা নিয়ে আসিও।" বাড়িতে গিয়ে মাকে বললাম। মা বুঝেন না বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে কী হবে। তিনি পাশ্ববর্তী সওদাগর বাড়িতে গেলেন। সওদাগর সাহেবের পরিবার ছিল শিক্ষিত পরিবার। সওদাগরের ছোট ছেলে জনাব হুমায়ূন কবির চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তোর ডিগ্রিধারী ছিলেন।তিনি বললেন বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারা তো অনেক বড় ব্যাপার। ভাল করে পড় এবং পরীক্ষা দাও। কিন্তু পঁচিশ টাকা তখন অনেক বড় সমস্যা। মা টাকা জোগাড় করতে পারলেন না। তিনি চুপ করে রইলেন। ততদিনে আর্থিক দৈন্যতার সাথে আমার পরিচয় ঘটে গিয়েছিল বলে আমি বুঝলাম পরীক্ষা দেয়া হবেনা। সবাই টাকা জমা দিয়ে দিলেও আমি দিতে পারছিনা বলে স্কুলে গেলামনা। টাকা জমা দেবার শেষদিন বিকেলে দেখি আমাকে খুঁজতে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন আমার আরেকজন প্রিয় স্যার জনাব মুজিবুল আলাম। বয়সে তরুন ছিলেন।ছাত্র-ছাত্রীদের ভাল-মন্দের খোঁজ-খবর নিতেন।তিনি ছিলেন স্থানীয়।আমাদের বাড়ি স্কুলের অতি কাছেই ছিল। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন স্কুলে যাচ্ছিনা কেন।আমি সরল ভাষায় সত্যি কথাটাই বললাম। তিনি আমাকে বললেন তুমি কাল স্কুলে এসো।পরদিন স্কুলে গেলে প্রধান শিক্ষক মহোদয় আমাকে খুব করে বকা দিলেন। আমি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।পরে শুনেছিলাম মুজিব স্যার আমার বৃত্তি পরীক্ষার ফি দিতে চাইলে প্রধান শিক্ষক মহোদয় তা নাকচ করে নিজেই তা দিয়ে দেন।এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমরা তিনজন দীর্ঘদিন পর আরবানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমার জীবনের সূচনালগ্নে সাক্ষাত ঘটেছিল এ মহান শিক্ষকদের যাঁদের ঋণ শোধ করা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। মুজিব স্যার কে পরবর্তি জীবনে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক ও বন্ধু। এখন তিনি অবসরে চলে গেছেন। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যে আমার এই স্যারকে দীর্ঘায়ূ দান করেন। (চলবে)

বিষয়: বিবিধ

৯৬০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

328094
০১ জুলাই ২০১৫ রাত ০২:০২
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার শিক্ষনিয় পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
এমন কয়েকজন শিক্ষক এর জন্যই এই দেশে বিস্তৃত হতে পেরেছে শিক্ষা।
328106
০১ জুলাই ২০১৫ রাত ০২:৫৯
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : এরকম স্যাররা আছে বলেই শিক্ষাটা এখনও আছে। তারা বেঁচে থাকলে জানাই সালাম। ধন্যবাদ ,,
328231
০১ জুলাই ২০১৫ রাত ১১:২৪
সেলিম উদ্দিন৭২১ লিখেছেন : ধন্যবাদ
328232
০১ জুলাই ২০১৫ রাত ১১:২৫
সেলিম উদ্দিন৭২১ লিখেছেন : Many thanks to Minhajul Islam Mohammad Masum and Ridwan Kabir Sabuj

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File