বাংলাদেশে বাজেট ও উন্নয়ন
লিখেছেন লিখেছেন যোবায়ের আহমদ ১৬ মার্চ, ২০১৫, ১১:২০:৫৬ রাত
ফ্লোর পাবার পর খুলনা থেকে নির্বাচিত এক এমপি মহোদয় বলে উঠলেন, ‘উই আর জ্যাক অব অল, মাস্টার অব নান’। মানে, আমরাই সবকিছু অথচ কোন কিছুতেই নেই। আমরা বলতে তিনি এখানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্যদেরকে বোঝালেন। তাঁর এই কথার সরল অনুবাদ হল, আমরা সংসদ সদস্যরাই দেশের আইন, সংবিধান, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি নির্ধারণ করে থাকি। আবার আমরাই এসবের কোন কিছুতে নেই। আমাদের স্বাধীনভাবে কথা বলা ও মত প্রকাশের সুযোগ সীমিত। জাতীয় বাজেট সংসদে আমরাই পাশ করিয়ে দেই, অথচ এই বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমাদের কোন ভূমিকা নেই। সংসদে কোন একটি বিল পাশ হতে গেলে আমার দলের হুইপ মহোদয় যেদিকে হ্যাঁ বলবেন, আমিও সে দিকেই হ্যাঁ বলতে হবে। যে দিকে না বলবেন, আমিও সেদিকেই না বলতে হবে। তা না হলে আমার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং মাননীয় সংসদ সদস্যদেরকে বাজেট বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে বলে লাভ নেই।
বাজেট বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে মাননীয় সংসদ সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়নে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে ছিল সেমিনার। এটা বাজেট পরবর্তী একটা জাতীয় সেমিনার। আমি ছিলাম আয়োজক প্রতিষ্ঠানের একজন গবেষক। দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ, নীতি নির্ধারক, মাননীয় সংসদ সদস্য আর সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন সেখানে। বাংলাদেশে প্রতিবছর জুন মাসে পরবর্তী অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করা হয়ে থাকে। মূলত আমলাতন্ত্রই এই বাজেট তৈরি করে দেয়। বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় থেকে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তারপর কিছু যোগ বিয়োগ করে চূড়ান্ত বাজেট মহান সংসদে পেশ করা হয়। বাজেট অধিবেশনে প্রত্যেক সংসদ সদস্য বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। মজার ব্যাপার হল, এই বাজেট বক্তৃতায় তাঁরা বাজেটের ভাল মন্দ নিয়ে নিজস্ব মতামত কিংবা টেকনিক্যাল এনালাইসিসে না গিয়ে রাজনৈতিক কথাবার্তাই বেশি বলে থাকেন। এমনকি দেখা গেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধীদলের নেতাও বাজেট বক্তৃতায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনামূলক কথা বলেন বেশি। বাজেট আলোচনার ধারে কাছেও যান না।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ভাল ভূমিকা পালন করছে। সরকারের নীতি নির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ বলতে এরমক সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোর ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। বাজেটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের প্রাক-বাজেট আলোচনা ও বাজেট পরবর্তী মুল্যায়ন, সেমিনার, প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তারা অবদান রেখে থাকে। সেমিনারে উঠে আসে বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মুল্যায়ন সংক্রান্ত কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক।
গোটা জুন মাস বলতে গেলে সংসদে বাজেট অধিবেশন চলে। মাসের শেষের দিকে এসে এই বাজেট পাশ করানো হয় মহান সংসদে। জুলাই মাস থেকে বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যায়। মোটাদাগে বলতে গেলে বাজেটের দুটো অংশ থাকে। রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেট। রাজস্ব বাজেটে থাকে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়মিত ব্যয়ের হিসেব। যেমন সরকারি কর্মচারীদের বেতন ভাতা। আর উন্নয়ন বাজেটে থাকে গোটা অর্থবছরের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের হিসেব। রাজস্ব বাজেটের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কম বেশি করার সুযোগ থাকে খুবই কম। কেবলমাত্র উন্নয়ন বাজেটের টাকা থেকে নয় ছয় হয়ে থাকে বেশি। বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত কোন সরকারই উন্নয়ন বাজেট ১০০% বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এরমাঝেও যতটুকু বাস্তবায়ন হয় তার একটা বিশাল অংশ হল উন্নয়ন বাজেটে টাকার খরচ দেখানো। ব্যাপারটা হল, ১ কোটি টাকার কোন একটা প্রকল্পে যদি পুরো ১ কোটি টাকাই খরচ হয়, তাহলে ধরে নেয়া হয় প্রকল্প শতভাগ বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হল, বাংলাদেশে এরকম শতভাগ বাস্তবায়িত অনেক প্রকল্প আছে যার কোন সুবিধাই জনগণ পাচ্ছে না। দেখা গেছে নদীর উপর ব্রিজ আছে অথচ দু’দিকে যোগাযোগের কোন রাস্তা নেই। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ! ১০ ফুট চওড়া পাকা রাস্তার উভয় পাশ থেকে আধাফুট আধাফুট বাদ দিয়ে নয় ফুট রাস্তা পাকা করেও দেখানো হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ। এভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ব্যয়িত টাকার হিসেব-নিকেশ কিংবা প্রকল্পের অগ্রগতি মনিটরিংয়ে জাতীয় সংসদের কোন ভূমিকা থাকে না। এমনকি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মুল্যায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোরও কোন ভূমিকা থাকে না। কিছু বায়বীয় প্রজেক্ট আছে যেগুলোর বরাদ্দ শতভাগ খরচ হলেও প্রকল্পের উদ্দেশ্য কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা মুল্যায়ন করা কঠিন। যেমন, গ্রামীণ মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি প্রকল্প। প্রকল্প শেষে কোন উপজেলায় দেখা গেল বরাদ্দের টাকা পুরোটাই খরচ হয়েছে অথচ মহিলাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়েনি। এক্ষেত্রে মনিটরিং অনেক বেশি দুর্বল।
তবে এই যে ১০০% উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন হয় না, এর পেছনে বাস্তবসম্মত কারণও আছে। যেসব প্রকল্পে বিদেশি সাহায্য জড়িত থাকে সেসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক সময় বিদেশি সাহায্যের টাকা সময়মত আসে না। দাতাদের বিভিন্ন শর্ত আর নজরদারির কারণে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয় না। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে দেখা গেছে মূলত বিশ্বব্যাংকের শর্ত ভঙ্গ করার কারণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে। টাকার অভাবের কারণে প্রকল্প মাঝ পথে থেমে যাওয়ার রেকর্ডও আছে।
আবার রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। একবার কোন এক জেলায় (নাম প্রকাশ করছি না)তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লঞ্চ-স্টিমার ও বার্জ মালিকদের দাবীর প্রেক্ষিতে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন নদীর উপরে থাকা ব্রিজ ঐ বছরের মধ্যেই ২ ফুট উঁচু করা হবে। ফলে সেটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হল। কিন্তু ব্রিজের জন্য আলাদা করে কোন বরাদ্দ না থাকায় জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার কাজ বন্ধ করে ঐ টাকা দিয়ে ব্রিজের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
অনেক সময় প্রাকৃতিক কারণেও প্রকল্প বাস্তবায়ন নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে শতভাগ সম্পন্ন হয় না। যেহেতু জুলাই মাস থেকে বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হয়, তখন বর্ষাকাল থাকে বিধায় নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো ঠিকমত শুরুই করা যায় না। বিশেষ করে রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, ব্রিজ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্পের কাজে বর্ষা চলাকালীন সময়ে তেমন অগ্রগতি হয় না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। আবার এমনও দেখা গেছে, অনেক বড় বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক বয়স্ক থাকেন বলে অবসরে যাবার সম্ভাবনা থাকায় তিনি কোন রিস্ক নিতে চান না। প্রকল্পের টাকা অনেক ধীরে খরচ করেন যাতে নিজেকে কোন বিতর্কের মুখোমুখি হতে না হয় চাকুরী জীবনের শেষ বয়সে এসে। শতভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা হল, প্রকল্পের সাথে জড়িতরা বিভিন্ন লেভেল টাকা পয়সার নয়-ছয় করেন। দুর্নীতিও করেন। আর সুদূর পরাহত হয়ে যায় কাংখিত উন্নয়ন।
- Zobayer Ahmed
বিষয়: বিবিধ
৮৭৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাধারণ মানুষের এতে কোন উপকার হয় না
মন্তব্য করতে লগইন করুন