বিএসসি পাশ ভিক্ষুকের সাথে ৭ মিনিট ৩২ সেকেন্ড!

লিখেছেন লিখেছেন যোবায়ের আহমদ ১০ মার্চ, ২০১৫, ০৮:৩০:০৫ সকাল

- পড়াশুনা কী করেছেন?

- জগন্নাথ থেকে ম্যাথামেটিক্সে বিএসসি করেছি ১৯৯০ সালে।

- আপনি তো টিউশনি করতে পারেন চাইলে। ভিক্ষা করার তো দরকার নেই।

- আপনাদের চট্টগ্রামে এসে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ছাত্র পড়াতে গেলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাই।

- এমএসসি করেন নাই?

- তার আগেই অসুস্থ হয়ে গেলাম!

ব্যস্ত রাস্তার পাশে একটা বিপণীর সামনে ছায়ায় দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা করছি আমার সফর সঙ্গীদের জন্য। যাব পতেঙ্গা সীবিচ। এমন সময় এলোকটি এল। কিছু সাহায্য চাইল তাঁর অসুস্থতার কথা বলে। কথায় ছিল একটু বাংলা আর ইংলিশের মিশ্রণ । মনে হল শিক্ষিত। আমি সাথে সাথে ভিক্ষা দিলাম না। একটা কথোপকথনে জড়িয়ে গেলাম। ছিলাম একা একা দাঁড়িয়ে। সময় কাটানোর ভাল কোন উপায় নিয়ে চিন্তা করছিলাম। সুতরাং আজকের ভিক্ষুকটাকে একটু বাজিয়ে দেখা যায়। সময় তো আছে!

- তো থাকেন কোথায়?

- আগ্রাবাদে যাত্রী ছাউনিতে। রাতে ওখানে ঘুমাই।

- এখন তো দেখছি একেবারে খালিহাতে! কাপড়-চোপড় ইত্যাদি কী করেন?

- একটা দোকানে রেখে এসেছি।

- ফ্যামিলিতে আর কেউ নেই।

- না।

- বাবা-মা?

- ছিলেন। এখন নেই। প্রপার্টি যা ছিল নিজের চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে ফেলেছি।

- বিয়ে শাদী করেন নাই?

- একটা মেয়ে ছিল আমার জীবনে। কিন্তু বিয়ে হয় নাই!

এজায়গায় এসে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল! ক্ষণিকের জন্য কল্পনা করতে লাগলাম তাঁর উচ্ছল যৌবনের কথা। তখনকার দিনে তো আজকের মত মোবাইল ছিল না। নিশ্চয় কোন একটা কিছু নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তাঁদের মাঝে। বেচারা এরপর জীবনে আর বিয়েই করেন নি! সে এক অনন্ত প্রেম!

- সে মেয়েটির কি বিয়ে হয়েছে?

- হ্যাঁ হয়েছে। বেশ সুখের জীবন যাপন করছে। কোটিপতি স্বামী পেয়েছে। দোয়া করি ও যেন সারাজীবন সুখে থাকে। এটাই আমার সুখ।

মাজহার না কী একটা নাম বলেছিলেন তাঁর। এখন মনে করতে পারছি না। তবে শুরুতে ‘ম’ ছিল। এটা বেশ মনে আছে। ধরেন, তাঁর নাম মাজহার। যেসব লোক নিজেদের রোগের কথা বলে ভিক্ষা করে, তাদেরকে ভিক্ষা দিতে একটু যাচাই করে দিই। একবার আমাদের বাসায় এরকম এক ভিক্ষুক এল। তাঁর শারীরিক দুর্বলতা ও বিভিন্ন অসুখের কথা বলে ভিক্ষা চাইল। নিজের ভাই ডাক্তার হবার সুবাদে বাসায় হরেক রকমের ঔষধ থাকত। আমি সেখান থেকে কিছু ভিটামিন জাতীয় ঔষধ তাঁকে দিলাম। লোকটা চলে যাবার ঘণ্টা খানেক পর বাইরে যাবার সময় আমাকে বেশ আশ্চর্য হতে হল। দেখলাম সিঁড়ির নিচে আমার দেয়া ঔষধগুলো পড়ে আছে! তাই এ লোকটাকে আরেকটু বাজিয়ে দেখা যায়।

মাজহার সাহেব জানালেন, তিনি অনেক বছর যাবৎ ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। বছরে একবার করে পুরো শরীরের রক্ত বদলাতে হয়।রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ! রেয়ার গ্রুপ! এত ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্ত কীভাবে ম্যানেজ করেন, জানতে চাইলাম।

- টাকা হলে এভরিথিং পজিবল। টাকা দিতে পারলে ডাক্তাররাই ম্যানেজ করে দেন।

- প্রতিদিন এভাবে কত টাকা সাহায্য পান?

- প্রতিদিন তো বের হই না। যেদিন বের হই ৩০০-৪০০ টাকা হয়। এতটুকু হলেই চলে যাই। আর ভিক্ষা করি না।

লোকটার এ পর্যন্ত কথাগুলো আমার বিশ্বাস হল। নিজের পকেটে ততবেশি টাকা ছিল না। ৫০ টাকা দেব মনে মনে ভাবছিলাম।তিনি জানালেন, আমি যদি তাঁকে ১০০ টাকা দেই তাহলে আজকে আর ভিক্ষা করবেন না। আমি আমতা আমতা করছিলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

-আপনাদের জন্য ১০০ টাকা তেমন কিছুই না। ১০০টাকা দান করলে আপনার কী এমন ক্ষতি হবে?

চিন্তা করে দেখলাম, ৫০ টাকা দিতে পারলে ১০০ টাকাও দেয়া যায়। কতই আর বেশি? মাত্র ৫০ টাকা বেশি! শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুরোধের কাছে পরাজিত হলাম।

বেশ ভাল লাগল তাঁর জীবনের দর্শন জেনে। এই যে প্রতিদিন মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে নিজের জীবন যাবপন করেন,চিকিৎসা করেন অথচ এই দুনিয়ায় নিজের বলতে কেউ নেই। কী স্বপ্ন নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন? আমাদের জগত সংসারে প্রায় সবার একটাই উদ্দেশ্য থাকে। নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু করা।

- তো আপনার জীবনে এখন বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কী?

- দেখেন, আমার পরিবার নেই। নেই কোন সম্পত্তি। এখন বেঁচে থাকার একটাই উদ্দেশ্য সুস্থ থাকতে হবে। যতদিন সুস্থ আছি নিজের ঈমান- আমল যেন ঠিক রাখতে পারি। স্রষ্টার গাইডলাইনগুলো যেন মেনে চলতে পারি।

এর মাঝে আসরের সালাতের আযান শোনা গেল। তিনি নামাযে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

- কিছু মনে না করলে আপনার কী একটা ছবি তুলতে পারব ?

- শিউর শিউর। তুলতে পারেন অফকোর্স



ছবি তোলার পর তিনি নিজেই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করলেন। আমি দোয়া চাইলাম। তিনি বিদায় নিয়ে সালাতের জন্য চলে গেলেন। আমি তাঁর চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একসময় তিনি অগণিত মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেলেন।

বিষয়: বিবিধ

১০৮৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

308144
১০ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৯:৩৫
জোনাকি লিখেছেন : ছবি কই?
এদের জন্য কিছু করতে মঞ্চায়। Sad
ধন্যবাদ
308146
১০ মার্চ ২০১৫ সকাল ০৯:৫২
নাজমুল আহসান লিখেছেন : বড় কঠিন-নির্মম এবং রোমান্টিক বাস্তবতা
308149
১০ মার্চ ২০১৫ সকাল ১০:১০
হতভাগা লিখেছেন :
মাজহার সাহেব জানালেন, তিনি অনেক বছর যাবৎ ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। বছরে একবার করে পুরো শরীরের রক্ত বদলাতে হয়।


০ ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে বছর বছর রক্ত বদলালে কি এ রোগে অনেক বছর টিকে থাকা যায় ?

রক্ত কি একবারে চেন্জ করা হয় নাকি একটু একটু করে চেন্জ করা হয় ?

ভিক্ষার মাধ্যমে কি ক্যান্সারের মত একটা রোগের চিকিতসা করা যায় তাও আবার অনেক বছর ধরে ?

ব্লাড ক্যান্সারের চিকিতসা ব্যয় অন্যান্য ক্যান্সারের চেয়ে কম ব্যয়বহুল না ।

মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে এরা ব্যবসা করে
308156
১০ মার্চ ২০১৫ সকাল ১১:১১
নেহায়েৎ লিখেছেন : আল্লাহু আলম
308162
১০ মার্চ ২০১৫ সকাল ১১:৫১
দ্য স্লেভ লিখেছেন : দারুনভাবে উপস্থাপন করলেন। কিন্তু ব্লাড ক্যান্সার সোজা বিষয় নয়। এ রোগে ভোগা মানুষের পক্ষে এভাবে সহজে চলাফেরা অতটা সহজ নয়। আর এটা ব্যয়বহুল ব্যপার।,,আমার ততটা ধারনা নেই। আল্লাহই ভাল জানেন। আল্লাহ তার কল্যান করুক
308187
১০ মার্চ ২০১৫ দুপুর ০২:০৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
308196
১০ মার্চ ২০১৫ দুপুর ০২:৫০
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : ভাই - প্রবাসে এরকম অনেককে পাওয়া যায়। কখনো বিশ্বাস হয় আবার কখনো বিশ্বাস হয় না। খুবই ভাল হয়েছে। ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File