" যুক্তি, তর্ক -বিতর্ক ও সহনশীলতা "
লিখেছেন লিখেছেন এন্টি পয়জন ১১ মার্চ, ২০১৫, ০৪:৪৯:১৯ বিকাল
" নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল "
" দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল "
প্রবাদ দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত। আবার দুটোই সত্য। যখন যেটা বলা দরকার আমরা সুবিধামত ব্যবহার করি।
পৃথিবীর প্রায় সকল বিষয়েই এরকম আপেক্ষিকতা আছে। নেগেটিভ পজিটিভ দুটো দিকই লক্ষ্য করা যায়।
ধরুন আপনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন : বাংলাদেশের বিজয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত!
অথবা লিখেছেন : রুবেলের অসাধারণ বোলিংয়ে মুগ্ধ! অভিনন্দন রুবেলকে!!
অথবা লিখেছেন : " বৃটিশদের পরাভূত করে আবারো বিজয় ছিনিয়ে আনল বাঙালি। ঠিক যেভাবে ৪৭ সালে বিজয় এনেছিলাম।
এখন আপনার স্ট্যাটাস বিভিন্ন পরিবেশে থাকা বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের নিকট বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
কেউ কমেন্ট করবে।
দেশের এই দুর্দিনে যখন প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হচ্ছে তখন এই সামান্য ক্রিকেট নিয়ে উল্লাস মানায় না।
২য় ব্যক্তির মতামত : রুবেলের মত ধর্ষকের প্রসংশায় পঞ্চমুখ হলেন। দুদিন আগেও তার সমালোচনা করলেন আর এখন একটু ভাল বোল করায় তাকে মাথায় তুলছেন!! একেই বলে হুজুগে বাঙ্গালী।
৩য় ব্যক্তির মতামত : খেলার সাথে রাজনীতি মেশান কেনো? কোন দেশকে ক্রিকেটে হারানোকে যারা জাতির বিরুদ্ধে বিজয় মনে করে তারা মূর্খ।
উপরের প্রত্যেকের কমেন্টের সত্যতা আছে। আবার এই স্ট্যাটাসেরও যৌক্তিকতা আছে। এই স্ট্যাটাসের নেগেটিভ পজিটিভ উভয় দিকই আছে।
বাংলাদেশের বিজয়ে আজকে দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের আনন্দ মিছিল হয়েছে। হরতাল শিথিল ঘোষণা করা হয়েছিল।
এই কর্মসূচিতে বিএনপির জন্য নেগেটিভ পজিটিভ উভয় দিকই ছিল। আবার আওয়ামী লীগের জন্যও উভয় দিক ছিল।
বিএনপির পজিটিভ হল বিজয় মিছিলের নামে ব্যাপক লোক নিয়ে শোডাউন করা।
আর নেগেটিভ হচ্ছে : দেশের এই স্পর্শকাতর গুমোট পরিস্থিতিতে সরকার যখন চরম অস্বস্তিতে তখন আনন্দ মিছিল করে পরিস্থিতি হালকা করে দেয়া। সরকার কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে।
ঠিক বিএনপির পজিটিভগুলো আ: লীগের নেগেটিভ আর নেগেটিভগুলো পজিটিভ।
সুতরাং স্থান কাল পাত্র ভেদে প্রত্যেকটি বিষয়ই যুক্তি ও বিতর্কের অবকাশ রাখে।
আজকে নাসির জামশেদ বা রবীন্দ্র যাদেজাহ নাকি কিসব ঔদ্ধতপূর্ণ মন্তব্য করেছে তাই দেশের অপমান হয়েছে। আত্ম অহমিকায় আঘাত লেগেছে।
কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করি আজকেই সীমান্তে এক নিরপরাধ বাংলাদেশীকে ভিনদেশীরা হত্যা করেছে। এতে কি দেশের অপমান হয়নি? দেশের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেনা? এখন হয়তো এটা সেটা বলে একটা উত্তর দিয়ে দিবেন। হয়তো ব্যাপারটা এমন যে " অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর "
আমি সেদিন স্ট্যাটাস দিয়েছি : " আল্লাহর মাইর শুরু। লতিফ সিদ্দিকী প্যারালাইজড। তার বর্তমান চেহারাটা দেখতে ইচ্ছে করছে। "
# ফ্রেন্ডলিস্টের একজন সম্মানিত আমেরিকা প্রবাসী সোস্যাল সংগঠনের নেত্রী বিনয়ের সাথে ইনবক্সে বললেন : কিছু মনে করবেন না। শত্রুর ক্ষতি কামনা করা মুসলমানদের আইডিয়োলজি নয়।
আমি তার কথায় ১০০% সহমত জানিয়ে সমর্থন করলাম। কেননা উনার স্থানে উনি সঠিক। আমার মনে যে আরও দশটা কথা বলার ছিল তা সংবরণ করলাম। কেননা পৃথিবীতে কথার শেষ নেই যুক্তির শেষ নেই মতেরও শেষ নেই। একই বিষয় স্থান কাল পাত্র ভেদে বিভিন্ন হবে এটাই স্বাভাবিক।
সবচেয়ে বিব্রত অবস্থায় পরলাম অভিজিৎ হত্যার পর।
ফ্রেন্ডলিস্টের কেউ কেউ আলহামদুলিল্লাহ পড়ে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করছে। আবার কেউ কেউ এটাকে চরম অন্যায় গর্হিত ও ইসলাম বিরোধী কাজ বলে স্ট্যাটাস দিচ্ছে।
আমি এই চরম স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এক লাইনও লেখার সাহস পাইনি।
দেশের সিংহভাগ মানুষ যখন ইসলামিক চেতনার অধিকারী নয়। তারা অবশ্যই মানবিক চেতনাই লালন করবেন। আপনি যখন অভিজিতের খুনে আনন্দ প্রকাশ করবেন তখন নিঃসন্দেহে ওই তরুনদের নিকট ইসলাম ভয়ংকর বর্বর ধর্ম হিসেবে পরিচিত হবে। ইসলাম বিদ্বেষীরা এই সুযোগ কাজে লাগাবে।
আবার এটাও সত্য অভিজিৎ যেই অন্যায় করেছে তার বিপরীতে ঘৃনা ও ক্ষোভ প্রকাশ ১০০% যৌক্তিক।
ইসলামের দৃষ্টিতেও এই গুপ্তহত্যার পক্ষে বিপক্ষে অনেক কথা আছে।
এই ব্যাপারে মন্তব্য করতে হলে কোরআন হাদিসের জ্ঞান থাকা যেমনি জরুরি তেমনি পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনার প্রজ্ঞা থাকাও জরুরি।
সেদিন এক মুসলিম ভাই উপহাস করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন : আমাদের সমাজে মোল্লা আর নাস্তিকদের জীবনই সবচেয়ে অনিরাপদ এবং সস্তা।
অর্থাৎ তিনি চরমপন্থা অবলম্বনকারীদের ঠাট্টা করেছেন।
অভিজিতের মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ করলে একশ্রেণীর নিকট আপনি পশু আর প্রতিবাদ জানালে একশ্রেনীর নিকট কাফের হয়ে যাবেন। অথচ আমরা সবাই একই দেশের একই ধর্মীয় ভাই ভাই। তাহলে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা কতটা সিরিয়াস ও স্পর্শকাতর বিষয়।
# সেদিন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুলে ইসলামপন্থী জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে শিশুসহ প্রায় সত্তর জনকে হত্যা করে। এই ঘটানাকে অতিরঞ্জিত করে বিশ্ব মিডিয়ায় পুরোদমে প্রচার করা হয়। আর অমনি মুসলিম খৃস্টান নির্বিশেষে সারাবিশ্বে ছিঃছিঃ রব পড়ে যায়। কেউ বলে জঙ্গিরা এত বর্বর!!? আবার কেউ সরাসরি ইসলামকে বর্বর বলে শোরগোল ফেলে দেয়।
কিন্তু ওই ঘটনার পূর্ব কাহিনী, কার্যকারণ ও প্রেক্ষাপট কেউ জানেও না জানার আগ্রহও নেই। এই পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে হাজার হাজার নিরিহ নারী শিশু হত্যা করেছে শুধু জঙ্গি দমনের নামে। তালেবানদের পরিবার হত্যা করেছে। তারই প্রতিশোধ নিতে স্কুলে হামলা চালিয়েছিল ওরা। সেই খবরগুলো বিশ্ব মিডিয়ায় আসেনি।
কারা প্রতিরোধ যোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা আর কারা হানাদার বাহিনী তা আন্তর্জাতিক মিডিয়া দেখে বুঝতে পারবেন না। কেননা মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ শাসক গোষ্ঠীর হাতেই থাকে। আর অত্যাচারিত জনগন অরণ্যে রোদন করে বেড়ায়।
মনে রাখবেন দূর্বল কখনো সবলের উপর উপযাচক হয়ে হামলা চালায় না। নিপীড়নের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌছলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই দূর্বল সবলের উপর হামলা করে। মৃত্যু নিশ্চিত জানা সত্বেও। স্কুলে হামলাকারী কেউ জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি।
এই কাহিনী তালেবানরা বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরতে ব্যর্থ। কেননা তাদের হাতে বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স নেই। যেহেতু নেই সুতরাং তাদেরকে আরো ধৈর্য ধরতে হবে। আরো মার খেলেও চুপ থাকতে হবে।
কেননা আপনি যখন নির্জন এলাকায় অনেকগুলো সন্ত্রাসী দ্বারা আক্রান্ত হবেন তখন পাল্টা মার দেয়ার সুযোগ থাকেনা। মার দেয়ার চেষ্টা করাও বোকামি। একটা আঘাত হয়তো করতে পারবেন কিন্তু জীবিত ফিরে আসতে পারবেন না। ওই মুহুর্তে জান নিয়ে ফিরে এসে বন্ধুদের সংগঠিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যতবড় সন্ত্রাসী কাজই করেন না কেন সেটা হবে সমাজ স্বীকৃত। আর ক্ষমতায় না থেকে ছোট ইট পাটকেল ছুড়লেও আপনি অপরাধী, জঙ্গি। কেননা সমাজে আপনার স্বীকৃতি নেই।
# সবসময় সব জায়গায় সত্য কথাটা বলে দেওয়া সাহসের কাজ বটে তবে প্রজ্ঞার কাজ নয়। এটা উচিত নয়।
আমি একটি প্রতিষ্ঠানে জব করেছিলাম। যখন আমাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুললাম তখন বস বললেন : মায়ের শাড়ি ছেড়া বলে কি আপনি সবাইকে বলে বেড়াবেন? নিজের দোষ ঢেকে রাখতে হয়।
# রাসুল সা: এর কাছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাহাবী প্রশ্ন করেছেন : ইসলামে সর্বোত্তম কাজ কোনটি? তিনি একেকজনকে একেক উত্তর দিয়েছেন। কেননা তিনি ব্যক্তি ও ব্যক্তির পরিস্থিতি বিবেচনা করে উত্তরগুলো দিয়েছিলেন।
# চোরের শাস্তির বিধান রয়েছে এক হাতের কব্জি থেকে কেটে দেয়া। কিন্তু কি পরিমাণ সম্পদ চুরি করলে হাত কাটা যাবে তার বর্ননা কোরআন হাদীসে নেই। এই সমস্যার সমাধানে উলামাগন কেয়াস করেছেন মোহরানার পরিমাণ থেকে।
যেহেতু স্ত্রীর লজ্জাস্থানের হাদিয়া স্বরুপ মোহরানা প্রদান করা হয় সেহেতু এক অঙ্গের মুল্য ওই মোহরানার পরিমাণ ( কমপক্ষে ১০ দিরহাম) থেকে নির্ধারণ করা হয়। মোহরানার পরিমাণ সম্পদ চুরি করলে হাত কাটা যাবে।
অর্থাৎ যুগে যুগে নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে উম্মতের আলেমদের কিয়াস (অনুমান) ও গবেষণার (ইজতেহাদ) সুযোগ রয়েছে।
সুতরাং যুক্তি, তর্ক বিতর্কের শেষ নেই। কোন বিষয়ে চরমপন্থা অবলম্বনের সুযোগ নেই। এটা ভাবার অবকাশ নেই যে আমিই ১০০% সঠিক বাকিরা ভুল।
শেষ এবং ফাইনাল বলে কিছু নেই
# ইসলামে মৃত প্রানী খাওয়া হারাম কিন্তু নিরুপায় অবস্থায় প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে খাওয়া জায়েজ।
অর্থাৎ কোন কোন ক্ষেত্রে ইমার্জেন্সি মুহুর্তে আইন পরিবর্তনযোগ্য।
# কোরআন হাদিস ও কিছু Universal truth ব্যতীত কোন কিছুই স্থিতিশীল নয়। সব কিছুই পরিবর্তন যোগ্য।
# হাদীসে আছে, রাসুল সা: বলেছেন : আমার উম্মতদের মাঝে মতানৈক্য রহমত স্বরুপ।
অপর হাদীসে, " দ্বীনের বিষয়ে যখন গবেষকগন (মুজতাহিদগন) কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হবেন তখন সেটা সঠিক হলেও পূন্য এবং ভুল হলেও পূন্যের ভাগিদার হবেন।
অর্থাৎ আপনার বিতর্কের উদ্দেশ্য যদি হয় সৎ এবং ইতিবাচক। সত্যকে জানার আগ্রহে যদি বিতর্ক হয় তবে ফলাফল অবশ্যই ভাল আসবে। নতুবা ফেতনা কলহ সৃষ্টির কারনে আপনি অপরাধী হবেন। পাপের ভাগিদার হবেন। যুক্তি বিতর্ক মতানৈক্য হোক গড়ার উদ্দেশ্যে, ভাঙার উদ্দেশ্যে নয়।
তাই আসুন আমরা আরো বেশি সহনশীল, বিনয়ী প্রজ্ঞাবান ও উদার হই। একটি সুন্দর শান্তিময় পৃথিবী গঠনে সচেষ্ট হই।
বি:দ্র: আমার উপরের কথাগুলো ১০০% সঠিক নাও হতে পারে। আপনি মতানৈক্য করতেই পারেন।
এই মতানৈক্য আছে থাকবে। এর মাঝেই আমাদের বেঁচে থাকা।
বিষয়: বিবিধ
৩২৬৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন