মীর কাশেম আলীর ফাঁসি: বিচারক যখন খুনি

লিখেছেন লিখেছেন আহমেদ ফিরোজ ০৯ মার্চ, ২০১৬, ০৮:৩৭:০৪ রাত



সবমিলে ১৪টি অভিযোগ জনাব মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে। এরমধ্যে কেবল ১১ ও ১২নং অভিযোগে তাকে প্রাথমিকভাবে ফাঁসির রায় দেয়া হয়। সর্বশেষ আপিল বিভাগের রায়ে ১২নং থেকে খালাস দিয়ে শুধুমাত্র ১১নং অভিযোগে তাঁর ফাঁসি বহাল রাখা হয়।

কি সেই ১১নং অভিযোগ??

১১নং অভিযোগে বলা হয়েছে: “একাত্তরের ঈদুল ফিতরের পর যে কোনো এক দিন(২৪ নভেম্বর) মীর কাসেমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে অপহণের পর নির্যাতন করে আলবদর সদস্যরা। নির্যাতনে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচ অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। ”

এই অভিযোগসহ সব অভিযোগের পক্ষেই রাষ্ট্রপক্ষ ১৯৭১ সালের বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং ডকুমেন্ট আকারে জমা দেন।

আশ্চর্যের ব্যপার হলো, রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টেই প্রমান হয় মীর কাশেম আলী ১১নং অভিযোগে বর্ণিত ঘটনার সময় ঘটনাস্থল চট্রগ্রামেই ছিলেন না!!!

শুনানিতে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে আদালত প্রশ্ন করেন, প্রসিকিউশনের ডকুমেন্টে দেখা যায় মীর কাসেম আলী ২৩ নবেম্বর ঢাকা ছিলেন। দুটি পত্রিকায় ছাত্রসংঘের তৎকালীন সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলীর যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। একটি পত্রিকার বিবৃতিতে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে তারা ঢাকা থেকে বিবৃতি দিয়েছেন। ২৩ নবেম্বর যদি মীর কাসেম আলী ঢাকা থাকেন তাহলে ২৪ নবেম্বর চট্টগ্রাম গিয়ে অপহরণ ঘটনার সাথে যুক্ত হওয়া কি করে সম্ভব যখন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই বিধ্বস্ত??



এটর্নি জেনারেল জবাবে বলেছিলেন, বিবৃতি যেকোন জায়গায় বসে দেয়া যায়(অথচ পত্রিকায় সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে তারা ঢাকা থেকে বিবৃতি দিয়েছেন)। আর ২৩ তারিখ ঢাকায় থাকলেও ২৪ তারিখ চট্টগ্রামে গিয়ে অপহরণের ঘটনা ঘটানো সম্ভব।

শুনানির শেষ দিকে আদালত এ বিষয়টি আবারো এটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন এটর্নি জেনারেল বলেন, যদি ধরেও নেই তিনি ২৩ তারিখ ঢাকা ছিলেন তবু ২৪ তারিখ চট্টগ্রাম গিয়ে অপহরণ করা সম্ভব।

কি আশ্চর্য ব্যপার!!! ‘যদি’ কিংবা ‘ধরে নেয়া’ তথ্যের উপর ভিত্তি করে কিভাবে একজনকে ফাঁসি দেয়া যায়???

অবাক করা ব্যপার হলো, এ অভিযোগ বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী হতে পারতেন তার(মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনের) আপন ভাই প্রফেসর ড. রাজিব হুমায়ুন। তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তা তার সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। কিন্তু তাকে এ মামলার সাক্ষী করা হয়নি!!!



কি কারণে আপন ভাইকে সাক্ষী করা হয়নি?? তার মত প্রফেসরকে দিয়ে শেখানো মিথ্যা বলানো সম্ভব হয়নি বলে?? মীর কাশেম আলী সত্যি তার ভাইকে হত্যা করে থাকলে তিনি নিশ্চই সাক্ষ্য দিতে আসতেন।

অন্যান্য যেসব সাক্ষী ডালিম হোটেলে অপহরণ ও নির্যাতন বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা সবাই এডভোকেট শফিউল আলমের কাছে এ ঘটনা জানতে পেরেছেন বলে দাবি করেছেন।

এডভোকেট শফিউল আলম ‘সেই সে সময় আনন্দ বেদনায়’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন তাকেও ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তার বইয়ে কোথাও মীর কাসেম আলীর নাম উল্লেখ করেননি।

এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করা হলে বলা হয়েছে, ভয়ে তিনি মীর কাশেমের নাম এড়িয়ে গেছেন!! অথচ তার বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। তিনি তার বইয়ে বেগম খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমান এবং এরশাদেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন!!

প্রশ্ন হলো, মীর কাসেম আলী কি খালেদা, জিয়া, এরশাদের চাইতেও পাওয়ারফুল লোক ছিলেন যে ভয়ে তার কথা বইতে উল্লেখ করেন নি?? কি হাস্যকর যুক্তি!!!

স্বাধীনতার পর দালাল আইনে ৩২ হাজার মামলা হলো। কিন্তু মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে কোথাও একটি মামলাও হলো না। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত গোয়েন্দা রিপোর্টে কোথাও মীর কাসেম আলীকে আলবদরও বলা হয়নি।

অভিযোগে মীর কাশেম আলীকে আলবদর বলা হলো, তাহলে তৎকালিন গোয়েন্দা রিপোর্টে তাকে আলবদর বলা হয়নি কেনো??

১১নং অভিযোগের বিন্দুমাত্রও রাষ্ট্রপক্ষ প্রমান করতে পারেনি। প্রসিকিউশনের এমন ব্যর্থতা দেখে স্বয়ং প্রধান বিচারপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “প্রসিকিউশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এসেছে”



প্রধান বিচারপতি তখন ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনায় খুবই মর্মাহত। মামলার এভিডেন্স দেখলে, এগুলো পড়লে আমাদের খুব কষ্ট লাগে। মামলাগুলো যখন আমরা পড়ি, তখন আমাদের গা ঘিনঘিন করে তাদের মামলা পরিচালনা দেখে। সব মামলায় এটা হয়ে আসছে।’

এরপর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্যে আদালতে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি। তার বক্তব্যের মধ্যে এটা অনুধাবন করেছি, “মীর কাশেম আলীর মামলায় আর মৃত্যুদন্ড দেয়ার সুযোগ নেই”



কিন্তু অবশেষে আমরা কি দেখলাম?? আমরা অতি আশ্চর্য এর সাথে দেখলাম যুক্তি তর্কের তোয়াক্কা না করে অভিযোগ প্রমাণের তোয়াক্কা না করে ঠিকই মীর কাশেম আলীর ফাঁসি বহাল রাখা হলো!!!

রায়টা কি তাহলে ভারত থেকেই আনা হলো??



দুই মন্ত্রী আর বিচারপতির মধ্যে সেই পুরনো ”আমি দাঁড়ায়া যামু আপনি ধমক দিয়া বসায়া দিবেন” নাটক কি লোকদেখানো নিরপেক্ষতার আইওয়াশ??

স্বয়ং বিচারক যখন খুনির ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন ন্যয়বিচার কিংবা বিচারের ত্রুটি নিয়ে কথা বলাটাই সময়ের অপচয়!!

তবে ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না। ইতিহাস এই মিথ্যা ও ভ্রষ্ট রায়ের বিচার একদিন করবেই।

বিষয়: বিবিধ

৬১৯৯ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

361988
০৯ মার্চ ২০১৬ রাত ০৯:৫৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : খুনিরাই যে বিচারক এর দায়িত্ব নিয়েছে!
০৯ মার্চ ২০১৬ রাত ১০:০২
299958
আহমেদ ফিরোজ লিখেছেন : নিয়োগদাতা যখন খুনি, নিয়োগকৃত ব্যাক্তি খুনিই হবে।
361999
০৯ মার্চ ২০১৬ রাত ১১:৫৭
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : এতো মিথ্যা শুনতে শুনতে প্রতিক্রিয়া জানানোর অনুভূতিও নষ্ট হয়ে গেছে।
362018
১০ মার্চ ২০১৬ সকাল ০৬:২০
শেখের পোলা লিখেছেন : সেদিনের আর কত বাকী? আর কত অপেক্ষা করতে হবে জানিনা৷
362039
১০ মার্চ ২০১৬ দুপুর ১২:১৩
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : জানিনা সেই দিন আসতে আর কতো বাকী? তবুও সেই দিনের প্রতিক্ষায় রইলাম!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File