প্রিয় ফুল, অকৃত্রিম ঘ্রাণ
লিখেছেন লিখেছেন ম রণতরী খান ২৮ মে, ২০১৫, ১১:২৭:৩৩ রাত
কলেজ গেট থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই রেল লাইন। দু’ধারে বস্তি। মাঝ দিয়ে ঝক ঝক করে ছুটে চলে ট্রেন। ব্যাপারটা ততদিনে নিয়ম হয়ে গেছে। বিকেল ছাপিয়ে আগুয়ান সন্ধ্যায় রেল লাইন ধরে হাঁটি। কখনো সখনো মগবাজার চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে হাঁটার ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলি। তারপর আবার হাঁটি।
ভিন্ন রকম এক ‘বয়োজেষ্ঠ কৈশোর’র মুখোমুখি আমি। মাথায় নানারকম ভাবনা। কখনো কবিতা, কখনো গল্প। এই কিছু একটা করতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেয়া তো আবার শুরু করা। সবকিছু থেকে আনন্দ খুঁজে নেয়ার এক অপার আগ্রহও। সারাক্ষণ মুখে লেগে থাকে চিরেচেনা স্বভাবসুলভ হাসি। বেসুরা গলায় গাওয়া গান। হৈ-হুল্লোড়। সপ্তাহান্তে চলে ওয়ান্ডারল্যান্ড, ইয়ুথ ক্লাব, ফয়েস লেক, নন্দন পার্কের কনসার্ট।
সেদিনের শেষ বিকেলটিও অন্য দশটি দিনের মতো ছিল। আমি আমার মতোই রেললাইন ধরে হাঁটছিলাম। কখন যে মানুষটি আমার মুখ চেপে ধরল বোঝার সুযোগই পেলাম না। ‘এই ছেলে রাস্তায় এভাবে কেউ একা একা হাসে না’। তার কথা শুনে আমি এবার হো হো করে হেসে দিলাম। হ্যাঙলা গড়নের শরীর, মুখে কাঁচা-পাকা দাঁড়ি। আমার ডান হাতটা দু’হাতে চেপে আছে। লোকটার মধ্যে কী যে মায়া, ছিনতাইকারী ভেবে ভয় পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই। একটা নিরীহ ভাবও দেহ ভঙ্গিতে।
মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসছে। ‘নামাজ পড়ো?’ প্রশ্ন করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমরা নামাজ পড়তে মসজিদে যাই। নামাজ শেষে রেললাইনের ঘাসে বসি। তিনি গান ধরেন…
গান শেষ করে হাসেন। কেমন লাগলো জানতে চান না। আবার গান ধরেন। শিশুর মতো আনন্দ করতে জানেন মানুষটি।মনে ধরে আমার।
গানের ফাঁকে ফাঁকে আমার গল্প শুনতে চান। আমি বলে যাই। খুব স্থির হয়ে শোনেন তিনি। ক্ষণে ক্ষণে আমার মাথায় হাত বোলান। তার এমন আচরণে আমার সত্যিই কান্না পেয়ে যাচ্ছে। লোকটি ভাবলেশহীন।
হঠাৎ রাস্তায় পাওয়া এক মানুষের সাথে আমি স্থির হয়ে ছিলাম। কিন্তু সময় চলে গেছে সময়ের মতো। কলেজের হোস্টেল বন্ধ হয় ১১টায়। এবার তাই আমাকে উঠতেই হয়। কীভাবে আবার তার দেখা পাবো। আমার চোখে মুখে এবারও খানিকটা উদ্বেগ। তিনি হয়তো পড়ে ফেলেন আমাকে। মুচকি হেসে বললেন, ‘এ পথে আবার এসো।আমাকে পেয়ে যাবে’।
সত্যিই পেয়ে যাই আমি। পেয়ে পাগল হয়ে হয়ে যাই। মানুষটির নাম আমি জানি না। জানি না সে কি করে। তবে এতটুকু বুঝতে পারি, তার কাছে আমি নিরাপদ। তাকে মনের সব কথা খুলে বলা যায়। হাজারো অপরাধের স্বর্গরাজ্য এই ঢাকায় তিনি একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমার আগ্রহের কথা শোনে তিনি খুব খুশি হলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, যা পারো, করে যেতে হবে। এতো ভাবনার কিচ্ছু নেই।
তাকে জানালাম, বাংলা সাহিত্য বলতে আমি বুঝি ‘শাহবাগের আজিজ সুপার’। আজ যারা বাংলা সাহিত্য চর্চা করছে তাদের সবার আড্ডাস্থল এই মার্কেটটি। অথচ আমি আজিজ সুপারে যাই না। ওখানকার কাউকে চিনি না। তাদের না চিনে আমি কীভাবে বাংলা সাহিত্য নিয়ে কাজ করবো!
তিনি আমার এ উদ্বেগের কথা শুনলেন। কোনো উত্তর না দিয়ে একদিন নিয়ে গেলেন এক লাইব্রেরিতে। সেখানে আমি প্রথম চিনলাম, আমার দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য বা অনুবাদ সাহিত্যের একদমই আনাড়ি কিছু মুখ। নসিম হিজাজী, আহসান হাবিব ইমরোজ, আবুল আসাদ, আসাদ বিন হাফিজ প্রমুখ। এখানেই ঘুরতে এসেই এক বুড়া অধ্যাপকের নামের সঙ্গে প্রকৃত পরিচয় হলো আমার। তার কিছু বইও পড়া হয়ে গেলো নতুনভাবে।
এতকিছুর পরও আজিজ সুপার নিয়ে আমার মধ্যে সংশয় থেকে গেলে তিনি জোর গলায় বললেন ‘আজিজ সুপারের কাছে বাংলা সাহিত্য কেউ বর্গা দেয়নি। আজ তুমি এখানে শুরু করো। কাল এটাই আর একটা আজিজ সুপার হবে। জায়গা বা নাম দিয়ে কখনো কাজের বিচার করতে যেও না’।
নাহ, আমি এখন আর কোনোভাবেই কাউকে বিচার করি না। এরপর থেকে আমার মনে আর কোনো সংশয় ছিল না। তিনি আমাকে একদিন দেখিয়ে দিলেন সেই বুড়া লেখককে। এক মসজিদে বসে আমি তার খুৎবা শুনছি। আমার মতো আরও বহু তরুণ মনোযোগ দিয়ে এসব শুনছে। এভাবেই তিনি আমাকে দিলেন নতুন এক জগতের সন্ধান।
যে জগতের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। যে সব বিষয়ে আমি ছিলাম বেখেয়াল। খুব অবহেলায়ই কাটিয়ে দিয়েছি দীর্ঘ একটি সময়। তিনি এসে আমাকে নিয়ে গেলেন সেই জগতে। আমি তাই অনেক কিছুই রুদ্ধশ্বাসে গেলার চেষ্টা করছি। আমার চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে নতুন নতুন সব দুয়ার। যেখানে প্রবেশ করতে একজন ‘গুরু’ দরকার।
কিন্তু নাম না জানা এ মানুষটিকে কতদিন পাবো আমি। তাকে যে বড় ক্লান্ত দেখায়। এক বিকেলে আমি তার কাছে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যম জানতে চাইলাম। তিনি হেসে বললেন, ‘এই পথই আমার পথ। এই পথে থেকো, আমাকে পাবে...!’
(প্রিয় ব্যক্তিত্ব: চলবে)
বিষয়: Contest_priyo
১৩৬৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার আগের কোন লিখা পড়েছি বলে মনে হচ্ছে না তবে এই লিখাটি খুবি ভালো লেগেছে! প্রতিটি অনুভূতি খুব সতেজ এবং ভালোলাগাময়!
যে ফুল, যার ঘ্রান জীবনের সঠিক পথের দিশা খুঁঁজে পেতে সাহায্য করে তা তো প্রিয় হবেই!
প্রিয় নিয়ে আপনার লিখাটির সফলতা কামনা করছি! শুভকামনা জানবেন!
এভাবেই কিছুমানুষ সমাজকে আলোর পথে নিয়ে যায়। অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া মানুষদের সংখ্যা খুবই কম। যারা আজ আলোর পথে মানুষকে ডাকে তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়।
আশা করছি পরবর্তি পর্বগুলোতে এই আলোকিত মানুষটির কথা আরও জানতে পারব। ধন্যবাদ।
তবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে চেষ্টা করে যাওয়া।উৎসাহ দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।ভাল থাকবেন।
অনেক ভাল লেগেছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন