চলুন মনকে বুঝি-১০
লিখেছেন লিখেছেন মিশু ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫, ১২:৪৭:১০ দুপুর
আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ.
প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন মানুষের উপর ফরয এবং তাকে প্রতিহত করা একজন মানুষের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আবু হাযেম রহ. বলেন, তুমি তোমার দুশমনের সাথে যেভাবে যুদ্ধ কর, তার চেয়ে আরও বেশি যুদ্ধ কর তোমার প্রবৃত্তির সাথে।
হুলিয়্যাতুল আওলিয়াহ ২৩১/৩
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“অক্ষম সে ব্যক্তি যে তার নফসকে তার প্রবৃত্তির অনুসারী বানায়”
ইবনে মাযাহ: ৪২৬০ হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
এ হাদিসে যে ব্যক্তি নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তাকে অক্ষম বলা হয়েছে। বাস্তবে সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সে যখন তার প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না তার চেয়ে দূর্বল ব্যক্তি দুনিয়াতে আর কেউ হতেই পারে না।
আজ আমরা অনেকেই নিজেদের এই অবস্থানে দূর্বলতার পরিচয় দিচ্ছি। ফলে অধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের মন শতদিকে শতভাবে বিচরন করতেই থাকে। এই মনকে একান্তে প্রশ্ন করে করে যদি এগুনো যায়, তাহলে নিজের কাছেই প্রবৃত্তির আসল রুপ ধরা পরে যাবে, ফলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে কোন পথে যাবো।
ঈমান একটি কাল্পনিক অবস্থা যা ধরে দেখানো যায় না। তবে অন্তরে এর অবস্থান থাকলে বাস্তব কাজ ও ব্যবহারের সাথে ঈমানের সম্পর্ক টের পাওয়া যায়। এই কাল্পনিক অবস্থার মাধ্যমে বুঝ শক্তিরও প্রকাশ ঘটে। এর কারন হচ্ছে জীবন্ত সত্তা অর্থাৎ মানুষের বিবেকের মাঝে ঈমানের অবস্থান। আর এই অবস্থাকে দিয়েই মুমিন ব্যক্তি পথ চলাকে সিরাতুল মুস্তাকীমের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
আল্লামা ইব্ন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, মানবজাতিকে শুধু তার নফস বা প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে কখনোই শাস্তি দেয়া হবে না, তাকে শাস্তি দেয়া হবে, প্রবৃত্তি ও নফসের অনুকরণ ও অনুসরণ করার উপর। যখন মানবাত্মা কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করে, কিন্তু সে তা না করে মানবাত্মাকে তা থেকে বিরত রাখে, তাহলে তাকে কোন প্রকার শাস্তি পেতে হবে না, বরং তার জন্য এ বিরত থাকা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইবাদত ও ইসলামী শরীয়তের নেক আমল বলে পরিগণিত হবে। মাজমুয়ায়ে ফাতওয়া ৬৩৫/১০
এ হল একজন সত্যিকার মুসলিমের অবস্থা। সর্বদা তার নফস তাকে বিভিন্ন খারাপ ও মন্দ কাজের নির্দেশ দিতে থাকে। আর সে তার নফসের সাথে যুদ্ধ করতে থাকে এবং নফসের নির্দেশ অমান্য ও বিরোধিতা করে আল্লাহকে ভয় করতে থাকে, যার মধ্যে এ ধরনের গুণ পাওয়া যাবে সে ব্যক্তিই হল সত্যিকার ঈমানদার ও প্রকৃত মুমিন। আর এ ধরনের ঈমানদারের জন্য রয়েছে জান্নাত ও উত্তম প্রতিদান।
আল্লাহ রাব্বূল আলামীন বলেন,
“আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল”।
সূরা নাযিয়াত: ৪০-৪১
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুটি জিনিষকে স্পষ্ট করেন,
এক-যারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করে তার প্রবৃত্তির অবস্থান অনুযায়ী। শুধু ভয় করা যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহকে ভয় করতে হবে তার শান ও অবস্থান হিসেবে।
দ্বিতীয়ত- প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো হতে তাকে বিরত থাকতে হবে; মনে যা চায় তা করা হতে বিরত থাকতে হবে। নিজের নফস বা নফসের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হতে হবে। তখন তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা হল জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।
মোট কথা, প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী আমল করা ব্যতীত কাউকে কোন প্রকার শাস্তি দেয়া হবে না। কোন মানুষ যখন কোন গুনাহ করার ইচ্ছা করে বা তার গুনাহ করতে মনে চায়, শুধুমাত্র এর উপর তাকে কোন শাস্তি দেয়া হবে না। তবে যদি লোকটি তার ইচ্ছা ও আকাঙ্খা অনুযায়ী আমল করে, তখন তাকে তার আমল ও প্রবৃত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।
আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“আদম সন্তানদের জন্য ব্যভিচারের একটি অংশ অবশ্যই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, সে তার জীবদ্দশায় তা অবশ্যই অর্জন করবে। তার চক্ষুদ্বয়ের ব্যভিচার হল, খারাপ বস্তুর প্রতি দৃষ্টি, কর্ণদ্বয়ে ব্যভিচার হল, কোন খারাপ বা অশ্লীল কথার শ্রবণ, মুখের ব্যভিচার হল, শরীয়তের পরিপন্থী কথা, হাতের ব্যভিচার হল, নিষিদ্ধ কোন বস্তুকে স্পর্শ করা আর পায়ের ব্যভিচার হল কোন নিষিদ্ধ কাজের প্রতি অগ্রসর হওয়া। অন্তর আশা করে এবং ধাবিত হয়, লজ্জাস্থান তা সত্যে পরিণত করে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে। মুসলিম [২৬৫৭]
হাদিস দ্বারা একটি কথা প্রমাণ হয়, মানুষের অন্তরে যখন কোন খারাপ বা নিষিদ্ধ কাজের উদ্রেক হয়, তার জন্য তাকে কোন প্রকার শাস্তি পেতে হবে না এবং তাকে তার জন্য ভালো বা খারাপ বলে মন্তব্য করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার অন্তরের কাজটিকে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা বাস্তবায়ন না করে। তার হাত পা মুখ যখন তার অন্তরের কোন কাজকে বাস্তবায়ন করবে তখন তার উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিধান চালু হবে।
ইবনে কাইয়ূম রহ. ইসলামের মধ্যম পন্থার ব্যাখ্যায় বলেন, 'মানুষ কখনো প্রবৃত্তি থেকে আলাদা হতে পারবে না, যতদিন সে আছে ততদিন তার প্রবৃত্তিও আছে, এর থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব, তাই ইসলাম তাকে প্রবৃত্তি থেকে আলাদা হতে বলেনি বরং তা নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন তাকে নারীর প্রতি আসক্তি ত্যাগ করতে বলেনি, বরং তাকে বিবাহের নির্দেশ দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে তার চাহিদা পূরণ করার বিধান দিয়েছে। এভাবেই ইসলাম মানুষের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানব জাতিকে নৈতিক পদস্খলন, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা থেকে রক্ষা করা।'
মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন,
হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তাঁর পথে চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না। ।
সূরা আত তাওবা ২৪
মূলত মহান আল্লাহ এই প্রেম ভালোবাসা অন্তরে দিয়ে আবার এর একটা শ্রেনী দিয়ে দিয়েছেন। সেই শ্রেনী এই আয়াত থেকে জানা যায়-
১। মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা
২। প্রিয় রাসূল স.এর প্রতি ভালোবাসা
৩। মহান আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূলের স. প্রদর্শিত পথে টিকে থাকার চূড়ান্ত প্রচেষ্টার ভালোবাসা
এরপর আসবে পিতা মাতা,স্ত্রী,সন্তান সন্ততি, ভাই বোন ও আত্মীয় স্বজন ইত্যাদি অন্যান্য ।
আমাদের পরিবারগুলোতে শুরুতেই এই ভালোবাসার স্তর শেখালে অনেক ধরনের ফেতনা থেকে নিজে পরিবার ও সমাজকে হেফাজত করা যেতো।
কিন্তু আমরা প্রথমেই সন্তানকে শেখাই,
তুমি কাকে ভালোবাসো? আম্মুকে না আব্বুকে?
আমরা শিখাই না যে, তুমি আম্মু আব্বুকে চতুর্থ স্থানে এসে ভালোবাসবে। প্রথম তিনটি স্থানের ভালোবাসা কে পাবে? ঐ আয়াতের কথা শিখিয়ে দেই কি?
আজ আমাদের সমাজে তরুন তরুনী হওয়ার আগেই বাল্যাবস্থায়ই দেখা যাচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসায় জড়িয়ে পিতা মাতার ভালোবাসাকেই গৌণ করে ফেলছে সেখানে প্রথম তিন স্তরের চিন্তাতো তাদের শিক্ষাতেই নাই। আর এরই ফলাফলে দেখা যায় মানসিক ও শারিরীক দুইভাবেই সন্তানটি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গান বাজনা,রাত জাগা বিভিন্নভাবে সময়ের অপূরনীয় অপব্যবহার করে জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষতি জানার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, এটা হলো হৃদয়ের বন্দিদশা, আর প্রীতিভাজনের জন্য দাসত্ব, প্রেম-ভালোবাসা অসম্মান, অপদস্থতা ও কষ্টের দরজা।
হৃদয় যখন আল্লাহর মহব্বত ও স্মরণ থেকে শূন্য হয়ে যায়, আল্লাহর কাছে দুয়া-মুনাজাত ও আল্লাহর কালামের স্বাদ গ্রহণ করা থেকে যখন শূন্য হয়ে যায় তখন নারীর ভালোবাসা, ছবির প্রতি আগ্রহ, গান-বাজনা শোনার আগ্রহ তার জায়গা দখল করে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন
’ ইশক বা প্রেম একটি মানসিক ব্যাধি। আর যখন তা প্রকট আকার ধারণ করে শরীরকেও তা প্রভাবিত করে। সে হিসেবে তা শরীরের পক্ষেও ব্যাধি। মস্তিষ্কের জন্যও তা ব্যাধি। এ-জন্যই বলা হয়েছে, এটা একটা হৃদয়জাত ব্যাধি। শরীরের ক্ষেত্রে এ ব্যাধির প্রকাশ ঘটে দুর্বলতা ও শরীর শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।‘
তিনি আরও বলেন, [দ্র: মাজমুউল ফাতওয়া: ১০/১৩২] ’ পরনারীর প্রেমে এমন সব ফাসাদ রয়েছে যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেও গুনে শেষ করতে পারবে না। এটা এমন ব্যাধির একটি যা মানুষের দীনকে নষ্ট করে দেয়। মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে নষ্ট করে দেয়, অতঃপর শরীরকেও নষ্ট করে।‘
শূন্য, দুর্বল, পরাস্ত হৃদয়েই শুধুমাত্র অনৈতিক ও অযৌক্তিক ভালোবাসা স্থান পায়। আর বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসা ওই হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না যে হৃদয়ে আল্লাহর ভালোবাসা ভর্তি রয়েছে ।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, 'পানাহার, পোশাক-আশাক, অবৈধ ভালবাসা ও গান-বাজনায় মগ্নতা মানুষকে উন্মাদ বানিয়ে দেয়। কারো অন্তরে যখন তার ভালবাসার বস্তুটির চিত্র ফুটে উঠে, তখন সে তাতেই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, এগুলো একাকার হয়ে যায় তার সত্তার সঙ্গে, যা থেকে উত্তরণ সম্ভব হয় না তার পক্ষে। এমন হয় কখনো লোভের কারণে, যেমন সম্পদ, সম্মান ইত্যাদির জন্য। কখনো হয় ভয়ের করণে, যেমন দুশমন বা অন্য কারো আতঙ্কে আতঙ্কিত ব্যক্তির অন্তর। প্রবৃত্তির অনুসারীরা আরো অনেক কারণে পানিতে নিমজ্জিত ব্যক্তির ন্যায় প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে আপাত-মস্তক নিমজ্জিত হয়ে থাকে।' (মাজমুআতুল ফতওয়া : ১০ / ৫৯৪)
যা কিছু মানুষের মনোজগৎ ও বিচার-বিবেচনা শক্তিকে নষ্ট করে দেয়ার মাধ্যম তা বন্ধ করার জন্য শরিয়ত সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছে। আর প্রেম-ভালোবাসা, নরনারীর সম্পর্ক, সব থেকে বড় ব্যাধি ও মারাত্মক আপদ।
শায়খ ইবনে তাইমিয়াহ রা. বলেন: [দ্র:মাজমুউল ফাতওয়া: ১০/১৩৫] হৃদয় যদি একমাত্র আল্লাহকে ভালবাসে, দীনকে একমাত্র তার জন্য একনিষ্ঠ করে, তাহলে অন্য কারও ভালোবাসার মুসীবত তাকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রেম-ভালোবাসার কথা তো বহু দূরে। প্রেম-ভালোবাসায় লিপ্ত হওয়ার অর্থ, হৃদয়ে আল্লাহর মহব্বতের অপূর্ণতা। এ-কারণে ইউসুফ আলাইহিস সালাম, যিনি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে মহব্বত করতেন, তিনি এই মানবীয় ইশক-মহব্বত থেকে বেঁচে গেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
(এমনি ভাবেই হয়েছে যাতে আমি তার থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয় সে আমার মনোনীত বান্দাদের মধ্যে একজন ছিল।) [ সূরা ইউসূফ: ২৪]
বিষয়: বিবিধ
১১৩৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আপনার লিখাগুলো খুব কমই এড়িয়ে যেতে পারি, আজও পারলাম না। আপনার লেখা পড়ি আর নিজেকে শোধরানোর সুতীব্র ইচ্ছা জেগে উঠে মনে। আপনি লিখে যান, আপনার নিয়মিত পাঠক হতে গর্ববোধ করব।
জাযাকাল্লাহী খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন