বাঙালী মুসলিম জাতির পূনর্জাগরন করাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ......
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ বিন সিরাজ ০১ জুলাই, ২০১৫, ০৬:২৫:২৭ সন্ধ্যা
আমাদের বিংশ শতাব্দীর মুসলিম ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৯০১ সাল থেকে । এই সময়ের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ হয় এবং বঙ্গভঙ্গ রদও হয়েছিল । ১৯০৬ সালের অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এর জন্ম, আবার ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা । এই সব গুলোই যেন জাতি ভুলে গেছে । এটা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে মনে হয় অনেকটা পরিকল্পিত ভাবে । এই পরিকল্পিত ভুলিয়ে দেয়ার কাজটা কে করেছে ? হতে পারে এটা লিখিতভাবে যদি বলা নাও যায় অন্তত এতটুকু বলা যায়, ভারতের কিছু বুদ্ধিজীবী, কিছু না কিছু পত্রিকা এই ভূমিকা পালন করেছে । বাংলাদেশের কিছু না কিছু পত্রিকা, কিছু না কিছু বুদ্ধিজীবী এই ভূমিকা পালন করেছে যাতে এই দেশের ইসলামী সত্তা এবং এর আগের ইতিহাসটা বাদ দিলাম, অন্তত বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসটা যেন ভুলে যায় ।
আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিন । ৯৪ বছরে পা দিল ঢাবি । এটি যেমন একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তেমনি পরবর্তীতে এটি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল । যে ঘটনা গুলোর কথা স্মরন করে আমরা গর্ববোধ করি । কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা কি আজ বাস্তবায়ন হয়েছে ? আজ আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের হাল-চাল দেখলে মনে হয় সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হওয়াতো দূরের কথা তা আর আলোর মুখ দেখতে পারেনি । যাদের জন্য যে উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আজ তারাই সবচেয়ে অবহেলিত । তারা আজ স্বাধীন ভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে না । তাদের জাতিগত সেম্বল শরীরে থাকলে তাদেরকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে মাশুল আদায় করা হয় । তবে এই ঘৃন্য কাজ গুলো যারা করে তারাও ঐ সম্প্রদায় ভুক্তই । তারা গায়ে-গতরে ও নামে ঐ সম্প্রদায়ের পাক্কা সদস্য হয়েছে বটে তাদের ধ্যান ধারণা, চিন্তা-চেতনা সবই আজ সেদিনের ঐ সকল বিরুদ্ধবাদীরা অক্টোপাসের মত আষ্টেপিষ্টে দখল করে নিয়েছে । তারা আজ নিজে থেকে চিন্তা করতে পারে না । নিজের ভালো কি তা তারা বুঝতে পারে না । এই প্রতিষ্ঠানটি এই ৯৪ বছরে অনেক জ্ঞানী-গুণীর জন্ম দিয়েছে, তবে তারা অধিকাংশই বুদ্ধিবৃত্তিক ও চেতনা গত ভাবে প্রতিবন্ধি ।
ঢাবি প্রতিষ্ঠার সাথে বঙ্গভঙ্গ রদ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । আর বঙ্গভঙ্গ রদ ছিল মুসলিম স্বার্থের সাথে জড়িত । বঙ্গভঙ্গ রদ করার ঘোষনা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য ছিল আশাভঙ্গের কারন । বঙ্গভঙ্গ রদ-উত্তর পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য পূর্ববঙ্গ মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের অনুরোধে নবাব স্যার সলমুল্লাহ ৩০ ডিসেম্বর ১৯১১ ঢাকায় এক বৈঠক আহবান করেন । এই বৈঠকে গন্যমান্য মুসলিম নেতারা অংশগ্রহণ করেন । বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, “পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের অনুভূতি ও বিশেষ ভাবে মুসলমানদের স্বার্থ উপেক্ষা করে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণায় মুসলমানরা তাদের গভীর দুঃখ ও ব্যাপক হতাশার কথা ব্যক্ত করছে । মহামান্য সম্রাট নিজেই এই ঘোষণা দেয়ায় সম্রাটের প্রতি সম্মান ও আনুগত্যের কারণে মুসলমানদের প্রতিবাদ থেকে দূরে থাকা ছাড়া গত্যান্তর নেই ।” ৩ মার্চ ১৯১২ কোলকাতার সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় । এতে সভাপতিত্ব করেন নবাব সলিমুল্লাহ । মুসলিম লীগের এই অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গ রদ করার উপর সর্বসম্মতিভাবে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় । বলা হয়, “মুসলমানদের অনুভূতি ও বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বঙ্গভঙ্গ রদ করায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ গভীর হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করছে এবং আশা করছে যে, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ।”
২৯ জানুযারী ১৯১২ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ তিন দিনের জন্য ঢাকা সফরে আসেন । নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের এক মুসলিম প্রতিনিধি দল ৩১ জানুয়ারী ১৯১২ শাহবাগে গভর্নর জেনারেলের সাথে সাক্ষাত করেন । অবহেলিত মুসলিমদের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন । এতে গভর্ণর জেনারেল বলেন, মুসলমানদের জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ববঙ্গের জন্য একজন বিশেষ শিক্ষা অফিসার নিয়োগের বিষয়ে সরকার সেক্রেটারী অব স্টেটের কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।
২ জানুয়ারী’১২ সালে এই ঘোষণা প্রকাশিত হওয়ার পরই শুরু হয় হিন্দুদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ । হিন্দু ভদ্রলোকদের কাছে মুসলমানদের জন্য এ রকম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা গ্রহনযোগ্য ছিল না । নেতৃস্থানীয় হিন্দু ও ইঙ্গভারতীয় সংবাদপত্র ‘The Bengali’ এবং ‘The Statesman’ পত্রিকায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চরম নিন্দা জ্ঞাপন করে । গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা থেকে কোলকাতায় ফিরলে ড রাস বিহারী ঘোষের নেতৃত্বে ১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯১২ একটি প্রতিনিধিদল গভর্নর জেনারেলের সাথে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধীতা করে । এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজা পিয়ারী মোহন মুখার্জী, বাবু ভূপেন্দ্রনাথ বসু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, অম্বিকা চরণ মজুমদার, দ্বারকানাথ চক্রবর্তী, যাত্রামোহন সেন প্রমুখ । তারা গভর্নর জেনারেলের কাছে স্মারক প্রদান করে । স্মারকে উল্লেখ করা হয়, “It is feared that the creation of a separate university at Dacca will be in the nature of an internal partition a break-up of the national life of the people now happily re-united.” স্মারকলিপিটির ভাষা ছিল চাতুর্যপূর্ণ । তাদের ভাষায়, বঙ্গভঙ্গ রদের মধ্য দিয়ে জাতীয় জীবনে জনগন আনন্দের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে । এ রকম অবস্থায় ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাটা হবে জাতীয় জীবনে অভ্যন্তরীন ভাগ সৃষ্টি করা । স্মারক লিপিতে আরো বলা হয়, যেহেতু পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষক, সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য কোন উপকার করা সম্ভব নয় ।(The deputationists argued that, “the vast majority of Moslems there [Eastern Bengal] were agriculturists on whom the university would hardly confer any appreciable benefit”)
বলা বাহুল্য যে, ভাইসরয়ের কাছে স্মারকলিপি প্রদানকারীরা ছিল সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দুষ্ট । সমাজবিজ্ঞানীরা প্রশ্নাতীত ভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে, একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শিক্ষার সুযোগ সামাজিক সচলতা এনে দেয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পূর্ববংগের পশ্চাদপদ দরিদ্র মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে ।
ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু ভদ্রলোকেরা ‘মোক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে আখ্যায়িত করে বিদ্রুপ করতে শুরু করে । বংগভঙ্গ রদ পরবর্তী সময়ে অনেক দরকষাকষির পর মুসলমানদের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করতে দীর্ঘ ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয় । এই দীর্ঘ সময়ে তথাকথিত হিন্দু ভদ্রলোকেরা এহেন কোন ষড়যন্ত্র ছিলনা যা তারা করেনি । কিন্তু সেদিনের মুসলিম নেতৃবৃন্দের দৃঢ়তা এবং প্রজ্ঞার কাছে হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের সকল ষড়যন্ত্র ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় । প্রতিষ্ঠিত হয় অবহেলিত মুসলিমদের পূনর্জাগরনের তীর্থস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । হিন্দু সাম্প্রদায়িক এবং বাম রামদের থাবার নিচে অবহেলিত মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা কতটা দূরহ ব্যাপার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কন্টকাকীর্ণ ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে ।
কিন্তু মুসলমানদের দুর্ভাগ্য সে সময়ে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিতের হার কম থাকায় ঢাবির শিক্ষক হন অধিকাংশই হিন্দু । ফলে মুসলমানরা শিক্ষিত হয়েছে বটে মরে গেছে তাদের জাতি সত্তার চেতনা । যে ঘুরে দাঁড়ানোর চেতনা নিয়ে তারা এই প্রতিষ্ঠানের জন্য সংগ্রাম করেছিল তা আর পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি । আস্তে আস্তে এক সময় তা শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায় । এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিত মুসলমানরা আজ হয়ত অনেক শিক্ষিত হয়েছে কিন্তু তাদের চেতনা, আচার, আচরণ হয়েছে সেইদিনের বিরোধীতাকারীদের মতই । সে দিনের মুসলিম চেতনা তথা তাহযিব-তামাদ্দুন যদি ঠিক থাকত তবে আজ বাঙ্গালী মুসলিম জাতির চিন্তাগত এই করুণ পরিনতি হত না ।
যারা আজ চেতনার কথা বলেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্ব করেন । এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আজ সমাজের অনেক উচু স্তরে বাস করছেন, তারাই সমাজের নেতা । তারা কি পারবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেতনায় আগামীর বাংলাদেশ গড়তে ……???
বিষয়: বিবিধ
২০২৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দুর্ভাগ্য সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন ইসলাম বিরোধিতার ঘাঁটি।
ঠিক বলেছেন । আমরা কতই না দুর্ভাগা ……
মন্তব্য করতে লগইন করুন