আজো পান খেয়ে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে কেউ আমার পাশে দাঁড়ালে মনে হয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা (র) যেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ………!!!

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ বিন সিরাজ ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:২৪:৩৪ রাত



মানুষের জীবনে এমন কিছু মুহুর্ত আসে যা হয় অপ্রত্যাশিত অথচ স্মরনীয় । সে হয়ত কোন দিন চিন্তাও করে না যে এমন মুহুর্ত আসবে এবং তা অতিক্রম করার সময়ও সে ভাবে না ঐ মুহুর্তটি পরবর্তীতে তার জন্য অনেক গর্বের হতে পারে । কেউ তা গুরুত্ব দিক আর না দিক সেই মুহুর্তটি সে তার হৃদয়ে চিরকাল বেঁধে রাখে । বিশাল সমূদ্রের মাঝে ঝড়ের কবলে পড়ে দিকভ্রান্ত কোন ক নাবিক একটি নিরাপদ ভূখন্ড পাওয়ার আশায় যখন পেরেশান হয়ে যায় এবং এমন একটি স্বর্গরাজ্যের কল্পনা সে হৃদয়ে অংকন করে যা সে কখনো চোখে দেখেনি । হঠাৎ দূর থেকে সেই স্বর্গরাজ্য দেখতে পেলে সে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে এবং সে মাটির প্রথম স্পর্শ তার জীবনের সেরা পাওয়া হিসেবে পরিগনিত হয় । অথবা একজন শূন্য হৃদয়ের মানুষ যখন কাউকে পাওয়ার আশায় তার ধ্যানে মগ্ন থাকে অথচ সে কখনো তাকে দেখেনি কিন্তু সেই মানুষের ছবি তার হৃদয়ের ক্যানভাসে অংকিত রয়েছে বহুকাল ধরে অথবা তাকে অনেক দেখেছে কিন্তু তার সান্নিদ্ধ পাওয়ার আশায় সে সদায় ব্যাকুল থাকত । সেই মানুষটি যদি হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে কোন এক কাক ডাকা ভোরে তার সামনে দন্ডায়মান হয় তবে তার প্রথম সান্নিদ্ধ পাওয়ার প্রথম মুহুর্তটি নিঃসন্দেহে তার জীবনের সেরা মূহুর্ত হয়ে থাকে । সেটা হয় তার জন্য অনেক গর্বের । অনেক আবেগের । অনেক প্রেরণার । জীবনের বাঁকে বাঁকে চলতে চলতে সে যখন ক্লান্ত হয়ে যায় তখন হৃদয়ের জানালা খুলে সেই মুহুর্তটুকু দেখে সে এক চিলতে স্বস্তি পায় । পুলকিত হয় । নতুন করে পথ চলার প্রেরণা পায় ।

আমার এই একুশ বছরের জীবনে গর্ব করার মত তেমন কিছুই নেই । না আছে একাডেমিক ভালো রেজাল্ট, না আছে অন্য কোন প্রতিভা । ‘সফল’ বা ‘নিজের কোন কৃতিত্ব’ এ দুটি বিষয় যেন আমার ডিকশনারীতে নেই । তবুও এতটুকু জীবনে আমার এমন একটি মুহুর্ত আছে যা নিয়ে আমি সারা জীবন গর্ব করব । যেদিন ইতিহাসের মহানায়কটি কারাগারে আমার কপালে চুম্বন করেছিল সেই মুহুর্তটি আমার জিবনের সবচেয়ে সেরা মুহুর্ত । সেদিনের আগে তাঁকে অনেক দেখেছি । তাঁর অনেক কথা শুনেছি । ২০০৯ সালের সদস্য সম্মেলনে তিনি যখন সকলের কাছে তাঁর শাহাদাতের জন্য দুয়া চেয়েছিলেন সেদিন কয়েক হাজার সদস্যের সাথে আমিও ‘আমিন’ বলেছিলাম । কিন্তু সেদিন কি ভেবেছিলাম, এই মহান মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন বহু দূরে না ফেরার দেশে ! কারাগারে যেদিন ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসের মুকুটহীন সম্রাট আমার মত অযোগ্য ও নগন্য মানুষের কপালে চুম্বন করেছিলেন সে মুহুর্তটি আমি আমার হৃদয়ের ফ্রেমে বেঁধে রাখব চিরকাল । অনেকের কাছে এটি মামুলি ব্যাপার হতে পারে কিন্তু আমার কাছে তা অনেক বড় পাওয়া । আজ থেকে বহু বছর পর জীবনের গোধূলী লগ্নে দাঁড়ানোর সুযোগ যদি হয় তবে সন্ধ্যার ধ্রুব তারা এবং আগামীর নতুন সূর্যদের বলব, ‘আমি শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার (র) সাথে জেল খেটেছি ………’

শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার (র) সেদিনের কথা গুলো আজো আমার কানে বাজে,

সময়টি ছিল ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের কোন একদিন সকাল বেলা । আমার আবাসস্থল তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মাধবীলতা সেল (৯০সেল)। আমার বিল্ডিং এর পাশেই চম্পাকলি সেল । সেখানে থাকতেন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের আরেক সিংহ পুরুষ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী । তাঁকে এক নজর দেখার জন্য আমরা মাধবীলতার তিন তলায় দাঁড়িতে থাকতাম । তিনি পায়চারী করতেন । আমরা সালাম দিলে তিনি হাত তুলে সালাম নিতেন আর দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে দুয়া করতেন ।

সেই দিন সকাল বেলা কারা ফটকে গিয়েছিলাম সাক্ষাতের জন্য । ফেরার সময় আমতলায় অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই দেখা হয়ে গেল বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা (র) এবং মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাহেবের সাথে । কারাগারে তাঁদের সাথে সেদিনই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাত । মুহাম্মদ কামারুজ্জামান সাহেবের সাথে এর আগে বাইরে কথা বলার সুযোগ হলেও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা সাহেবের সাথে ঐদিনই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাত । তাদের সাথে কারা পুলিশ ছিল । তাদের সাথে সাক্ষাত বা কথা বলা আমাদের জন্য নিষেধ ছিল । কিন্তু তাদের দেখে আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না । কারাগারে যারা যাননি তাদের কাছে কারাগারের পরিস্থিতি উপলব্ধি করাটা একটু কঠিন । প্রবল স্রোতে একজন ডুবন্ত মানুষ কোন একটি অবলম্বন পেলে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় তেমনি কারাগারে এই মহান মানুষদেরকে দেখে আমরা সকল কষ্ট ভুলে যেতাম । তাদের দেখলে কত যে তৃপ্তি পেতাম তা বলে বোঝাতে পারব না । কারা কর্তৃপক্ষের নিষেধ সত্বেও আমি দৌড়ে গিয়ে শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা (র) কে জড়িয়ে ধরলাম । মনে হল যেন তিনি কত আপনার, তাকে কত জনম জনম ধরে চিনি । তিনিও আমাকে স্বস্নেহে জড়িয়ে ধরলেন । আমি এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম যে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না । মনে হল হৃদয়ের সকল আবেগ যেন পুঞ্জিভূত হয়েছে আজ । ক্লান্ত কোন এক মুসাফির প্রকান্ড কোন এক বৃক্ষের ছায়ায় বসে সে যেমন পরম শান্তি পায়, তাঁর বুকে মাথা রেখে তেমনি আমিও যেন তাই অনুভব করলাম । ভাবলাম এভাবেই যদি তাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে পারতাম চিরকাল । কিন্তু পৃথিবীর নিয়মেতো আবেগের কোন স্থান নেই বরং বাস্তবতাকে পুঁজি করেই সে এগিয়ে যায় । তিনি তাঁর হাত দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিলেন এবং বললেন, “ইসলামী আন্দলনের কর্মীদের চোখে অশ্রু মানায় না । আমাদের জন্য কারাগার হল বিশ্রামাগার এবং উত্তম শিক্ষালয় । আর আমাদের নির্দিষ্ট কোন ঘর নেই । আমাদের ঘর হল, রাজপথ(জিহাদের ময়দান), হাসপাতাল কিংবা কবর । কখনো টেনশন করবে না । দেখবে এক সময় ঝড় থেমে যাবে………………” । এরপর আরো কিছু কথা হল ………। তিনি আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ খবর নিলেন । তারপর মুচকি হেঁসে বললেন, “অফিস করতে (কোর্ট হাজিরা) যাচ্ছি । আমাদের জন্য দুয়া করো ……………”

আমি তাঁর কাছে দুয়া চাইলাম । তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন । দু’হাতে মাথা টেনে কপালে চুমু দিলেন । গালে হাত দিয়ে আদর করে দিলেন । এই মহান মানুষটি আমার মত নগন্য মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেছেন এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া ।

সেদিন তাঁর গায়ে ছিল সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা ও চাদর । তিনি পান খাচ্ছিলেন । তাঁর শরীর থেকে পান ও আতর মিশ্রিত মিষ্টি একটি সুবাস আসছিল । তিনি আমার সাথে মুসাফাহা করে সামনে পা বাড়ালেন । গেইটের ওপারে না যাওয়া পর্যন্ত আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । তাঁরা গেইটের ওপারে যাওয়ার পরেও গেটের ফাঁকা দিয়ে তাদের দেখার চেষ্টা করলাম । এক সময় তারা আড়াল হয়ে গেলেন …………………।

তাঁর হাঁটার আলাদা একটি ভংগি ছিল । পাঞ্জাবি আর চাদর পড়া তাঁর হাটার ছবি যখন মনে হয় তখন মনের অজান্তেই চোখের পানি চলে আসে । চিৎকার দিয়ে তখন কাঁদতে ইচ্ছে করে । মনে হয় কোন এক পরম আপনজনকেই হারিয়ে ফেলেছি । তিনিতো আমার রক্তে সম্পর্কের কেউ না তারপরেও কেন এমন হয় আমি জানি না ।

সেদিনের তাঁর পান ও আতর মিশ্রিত মিষ্টি সুবাস এখনো আমার নাকে লেগে আছে । আজো পান খেয়ে পাঞ্জাবি পড়ে কেউ আমার পাশে দাঁড়ালে মনে হয় শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাই (র) যেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ………………

আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন এই মহান মানুষটিকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন ……………

বিষয়: বিবিধ

১৩৪২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

297157
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
297163
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৪৫
সাইমুম হাবিব লিখেছেন : ভালো লেগেছে লেখাটা.... ধন্যবাদ
297169
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১১:৩৫
সামসুল আলম দোয়েল লিখেছেন : লেখাটা ভালো লাগল।
আব্দুল কাদের মোল্লা সাহেব বিতর্কিত হতে পারেন, বিতর্ক হতে পারে তার রায় নিয়ে, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় তিনি ন্যায় বিচার পান নি।
297203
২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০২:১৩
আফরা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ ।
297223
২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:৫৭
কাহাফ লিখেছেন :
ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীরা এমনই হয়!
'আল্লাহর জন্যেই ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্যেই ঘৃণা করা' এমন মুমিনদের থেকেই প্রকাশ পায়!
আল্লাহর জমিনে তাঁর আইন বাস্তবায়নের তৌফিক মহান রব দান করুন! শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে জান্নাতের মেহমান করে নিন আল্লাহ! আমিন ছুম্মা আমিন!!
297374
২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১২:০৫
বুঝিনা লিখেছেন : কাহাফ লিখেছেন :
ইসলামী আন্দোলনের নেতা কর্মীরা এমনই হয়!
'আল্লাহর জন্যেই ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্যেই ঘৃণা করা' এমন মুমিনদের থেকেই প্রকাশ পায়!
আল্লাহর জমিনে তাঁর আইন বাস্তবায়নের তৌফিক মহান রব দান করুন! শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লাকে জান্নাতের মেহমান করে নিন আল্লাহ! আমিন ছুম্মা আমিন!!
301620
২৫ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল ১১:৪৬
মুক্তভাবনা লিখেছেন : “ইসলামী আন্দলনের কর্মীদের চোখে অশ্রু মানায় না । আমাদের জন্য কারাগার হল বিশ্রামাগার এবং উত্তম শিক্ষালয় । আর আমাদের নির্দিষ্ট কোন ঘর নেই । আমাদের ঘর হল, রাজপথ(জিহাদের ময়দান), হাসপাতাল কিংবা কবর । কখনো টেনশন করবে না । দেখবে এক সময় ঝড় থেমে যাবে………………” । অসাধারন এক উক্তি!!!
301721
২৫ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৮:৪০
মুহাম্মদ বিন সিরাজ লিখেছেন : জি ভাই,সত্যি অসাধারণ উক্তি !!! আমি কখনো ভুলবনা । @মুক্তভাবনা

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File