কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় চেতনার প্রতীক
লিখেছেন লিখেছেন আমিনুল হক ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০১:২৪:০০ দুপুর
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের গর্ব আমাদের অহঙ্কার। তিনি আমাদের জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীক। মরেও অমর হয়ে আছেন যিনি। কাজী নজরুল বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখেছেন তা অনবদ্য। তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও নাটক এদেশের মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে। মরা প্রানে দান করে জীবন। পথহারা পথিককে দেয় সঠিক পথের সন্ধান। তিনি ছিলেন গণ-মানুষের কবি, সাম্যের কবি, গরীবের কবি, ইসলামের কবি ও বিদ্রোহী কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম জীবনে নানা চড়াই উৎরাইয়ের ফাঁকে বড় হয়েছেন। মাত্র দশ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করলেও দীর্ঘ জীবনের খুব কম সময়ই লেখালেখি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারপরও তিনি সাহিত্য জগতে যা দান করেছেন তা এক কথায় অনন্য। নজরুলের তুলনা নজরুল নিজেই। তিনি এলিট শ্রেণীর মানুষ ছিলেন না। তাই তার কবিতা ও লেখনী এলিটদের নিয়ে ছিল না।
কাজী নজরুল ইসলামের বড় পরিচয় তিনি একজন মুসলমান। ইসলামের সুমহান আদর্শ নজরুলকে আন্দোলিত করেছিল। ইসলামের আলোয় আলোকিত কবি নজরুল তাই হতে পেরেছিল সাম্যের প্রতীক। তিনি মুসলিম ছিলেন বলেই সব মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন। কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মধ্যে কাজ করেনি। সকল ধর্ম বর্ণ ও পেশার মানুষকে তিনি এক চোখে দেখেছেন। নিম্নের লাইনগুলো পড়লে যা অনুভব করা যায়ঃ
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম- ক্রীশ্চান।
মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।
নজরুল সকলের কবি হলেও নিজ সম্প্রদায়ের জন্য তার দরদের কোন কমতি ছিল না। মুসলমানদের উন্নতির জন্য তিনি চিন্তা করেছেন। মুসলমানদেরকে তিনি মূল্যবান দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বলেছেন:
দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছাড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত
কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
মুসলমানদেরকে তিনি ছোটখাটো ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখার আহবান করেছেন। তিনি ধর্মের নামে ভণ্ডামি একদম পছন্দ করতেন না। মানুষকে তিনি ইসলামের সঠিক শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দিতেন:
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ জোর করে নাও কেড়ে;
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!
নজরুলের কবিতায় ইসলামী ভাবধারা ব্যাপকভাবে ফুটে ওঠে। তার রচনায় আরবী ও ইসলামী শব্দের ব্যবহার আমাদেরকে বিস্মিত করে। ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশে নজরুলের গান, কবিতা ও রচনা ব্যাপক অবদান রেখেছে। ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মুহম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়.....সহ অসংখ্য ইসলামী সংগীত আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। নজরুল ছিলেন তেজোদীপ্ত ঈমানের অধিকারী। তিনি বলেন:
“চির উন্নত মম শির
শির নেহারী আমারি নত শির
ওই শিখর হিমাদ্রির।“
আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজে যেরকম আপদ-মস্তকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীও ছিল সাম্রাজ্যবাদ, অপশক্তি বিরোধী। কোন বাতিল শক্তির কাছে মাথা নোয়ানোর পাত্র তিনি ছিলেন না। তার সমসাময়িক অনেক বিখ্যাত কবিই ইংরেজদের পদলেহন করে ধন্য হয়েছেন। কিন্তু নজরুল সকল অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তাঁর ধমনীতে বেজে উঠেছে:
‘মহাবিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।’
‘কারার ঐ লোহ কপাট,
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্তজমাট শিকল পুজোর পাষাণবেদী
ওরে ও তরুন ঈশাণ, বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ
ধ্বংস নিশান উড়–ক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদী।’
কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও তিনি বাংলাদেশ নিয়ে ভেবেছেন। তাঁর অনেক কবিতার মধ্যে বাংলাদেশ শব্দের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। এথেকে আমরা নির্ধিদ্বায় বলতে পারি, নজরুল ছিলেন একজন খাটি বাংলাদেশপ্রেমিক। তিনি লিখেছেন:
সেই আমাদের বাংলাদেশ
রাজরানী আজ ভিখারিনী
কাঁদছে বনে লুটিয়ে কেশ।।
মুক্তধারা সেই নদী আজ মন্দগতি বন্ধনে,
সুনীল আকাশ অশ্রুমলিন নিপীড়িতের ক্রন্দনে।
ধূলায় ছিল সোনার রেণু ঘরে ঘরে সুখ-বিলাস
নিঃশ্বসিয়া ফিরছে হেথা চাঁদ কেদারের দীর্ঘশ্বাস।
বাতাসে হায় ফিরছে উড়ে বীর-প্রতাপের ভস্মশেষ।
কিন্তু যেই নজরুল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করেছেন সেই নজরুলই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত। নজরুল বন্দনার চেয়ে এখানে রবীন্দ্র কিংবা পরদেশীর বন্দনাই বেশী চলে। বাংলাদেশে এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শততম জন্মবার্ষিকী পালনের মহা উৎসব চলছে এবং তা চলবে বছরজুড়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথের আদর্শে আদর্শিত হওয়ার আহবান করেছেন। যে রবীন্দ্রনাথ খাটি মুসলিম বিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছেন; বঙ্গ ভঙ্গ রদের বিরোধীতা করেছেন; মুসলমানদের বিরুদ্ধে যার অনেক অবজ্ঞা তার আদর্শ গ্রহণের আকুল আবেদন কী অর্থ বহন করে? আমাদের প্রিয় কবি নজরুলকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আদর্শ মানতে হবে কেন? সমালোচকদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন স্বার্থপর কবি। বৃটিশদের কুর্ণিশ করে যিনি নোবেল কুড়িয়েছেন। নজরুলের প্রতিভার স্ফুরণ দেখে তাকে প্রতিহত করার নানান ফন্দি এটেছেন। নিজের ভাতিজী প্রমিলাকে কাজে লাগিয়ে নজরুলের জীবনকে ধ্বংস করার অভিযোগ আছে যার বিরুদ্ধে তাকেই পুরুস্কৃত করা হয়েছে নানানভাবে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বানানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে। অথচ নজরুলের অসংখ্য গান ও কবিতা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হওয়ার যোগ্যতায় রবীন্দ্রনাথের চেয়ে যোজন যোজন মাইল এগিয়ে। রবীন্দ্র বন্দনায় এদেশের মিডিয়াগুলোর অবদানও কম নয়। প্রত্যেক বছর তাকে কেন্দ্র করে অনেক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে এদেশের মিডিয়াগুলো। সম্ভবত: এবছরই বিটিভির স্ক্রীনের কোণায় রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ফটোর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি দেখতে পেলাম। কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় হরফে সংবাদের শিরোণাম লেখা হয়েছে ‘রবীন্দ্রময় দেশ’। সত্যিই সেলুকাস! অথচ নিজ দেশের জাতীয় কবিকে নিয়ে তেমন কোন মাতামাতি নেই। নজরুলের বই পুস্তক, গান-কবিতা প্রচার প্রসারের ভালো কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এদেশের বর্তমান প্রজন্ম তাই আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক নজরুলকে চেনে না।
কাজী নজরুল ইসলামের বড় অপরাধ তিনি মুসলিম হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন। যদি তিনি হিন্দু কিংবা অন্য ধর্মের হতেন তাহলে তার নোবেল পাওয়াটা কঠিন হতো না। আবার মুসলমান হয়েও যদি ইসলাম বিরোধী নাস্তিক হতেন তাহলেও মূল্যায়ন পেতেন অনেক। জাতীয় কবি হয়ে দায়সারা সম্মানের অপমান তাঁকে সইতে হত না।
‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরে বসে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’
এদেশের সরকার নজরুলের ওই অনুরোধ রেখেছেন এটিওবা কম কিসে(!) যাইহোক, নজরুল আমাদের সম্পদ। আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। নজরুলকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। যদি আমরা নজরুলের চেতনাকে সামগ্রিকভাবে লালন করতে পারি তাহলে বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে আমাদের ইজ্জত বাড়বে বৈ কমবে না।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের গর্ব আমাদের অহঙ্কার। তিনি আমাদের জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীক। মরেও অমর হয়ে আছেন যিনি। কাজী নজরুল বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখেছেন তা অনবদ্য। তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও নাটক এদেশের মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে। মরা প্রানে দান করে জীবন। পথহারা পথিককে দেয় সঠিক পথের সন্ধান। তিনি ছিলেন গণ-মানুষের কবি, সাম্যের কবি, গরীবের কবি, ইসলামের কবি ও বিদ্রোহী কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম জীবনে নানা চড়াই উৎরাইয়ের ফাঁকে বড় হয়েছেন। মাত্র দশ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু করলেও দীর্ঘ জীবনের খুব কম সময়ই লেখালেখি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারপরও তিনি সাহিত্য জগতে যা দান করেছেন তা এক কথায় অনন্য। নজরুলের তুলনা নজরুল নিজেই। তিনি এলিট শ্রেণীর মানুষ ছিলেন না। তাই তার কবিতা ও লেখনী এলিটদের নিয়ে ছিল না।
কাজী নজরুল ইসলামের বড় পরিচয় তিনি একজন মুসলমান। ইসলামের সুমহান আদর্শ নজরুলকে আন্দোলিত করেছিল। ইসলামের আলোয় আলোকিত কবি নজরুল তাই হতে পেরেছিল সাম্যের প্রতীক। তিনি মুসলিম ছিলেন বলেই সব মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন। কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা তাঁর মধ্যে কাজ করেনি। সকল ধর্ম বর্ণ ও পেশার মানুষকে তিনি এক চোখে দেখেছেন। নিম্নের লাইনগুলো পড়লে যা অনুভব করা যায়ঃ
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম- ক্রীশ্চান।
মসজিদ এই, মন্দির এই, গীর্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।
নজরুল সকলের কবি হলেও নিজ সম্প্রদায়ের জন্য তার দরদের কোন কমতি ছিল না। মুসলমানদের উন্নতির জন্য তিনি চিন্তা করেছেন। মুসলমানদেরকে তিনি মূল্যবান দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। বলেছেন:
দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছাড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত
কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
মুসলমানদেরকে তিনি ছোটখাটো ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখার আহবান করেছেন। তিনি ধর্মের নামে ভণ্ডামি একদম পছন্দ করতেন না। মানুষকে তিনি ইসলামের সঠিক শিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দিতেন:
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ জোর করে নাও কেড়ে;
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!
নজরুলের কবিতায় ইসলামী ভাবধারা ব্যাপকভাবে ফুটে ওঠে। তার রচনায় আরবী ও ইসলামী শব্দের ব্যবহার আমাদেরকে বিস্মিত করে। ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশে নজরুলের গান, কবিতা ও রচনা ব্যাপক অবদান রেখেছে। ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মুহম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়.....সহ অসংখ্য ইসলামী সংগীত আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। নজরুল ছিলেন তেজোদীপ্ত ঈমানের অধিকারী। তিনি বলেন:
“চির উন্নত মম শির
শির নেহারী আমারি নত শির
ওই শিখর হিমাদ্রির।“
আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজে যেরকম আপদ-মস্তকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীও ছিল সাম্রাজ্যবাদ, অপশক্তি বিরোধী। কোন বাতিল শক্তির কাছে মাথা নোয়ানোর পাত্র তিনি ছিলেন না। তার সমসাময়িক অনেক বিখ্যাত কবিই ইংরেজদের পদলেহন করে ধন্য হয়েছেন। কিন্তু নজরুল সকল অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। তাঁর ধমনীতে বেজে উঠেছে:
‘মহাবিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ-কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না।’
‘কারার ঐ লোহ কপাট,
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্তজমাট শিকল পুজোর পাষাণবেদী
ওরে ও তরুন ঈশাণ, বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ
ধ্বংস নিশান উড়–ক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদী।’
কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও তিনি বাংলাদেশ নিয়ে ভেবেছেন। তাঁর অনেক কবিতার মধ্যে বাংলাদেশ শব্দের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। এথেকে আমরা নির্ধিদ্বায় বলতে পারি, নজরুল ছিলেন একজন খাটি বাংলাদেশপ্রেমিক। তিনি লিখেছেন:
সেই আমাদের বাংলাদেশ
রাজরানী আজ ভিখারিনী
কাঁদছে বনে লুটিয়ে কেশ।।
মুক্তধারা সেই নদী আজ মন্দগতি বন্ধনে,
সুনীল আকাশ অশ্রুমলিন নিপীড়িতের ক্রন্দনে।
ধূলায় ছিল সোনার রেণু ঘরে ঘরে সুখ-বিলাস
নিঃশ্বসিয়া ফিরছে হেথা চাঁদ কেদারের দীর্ঘশ্বাস।
বাতাসে হায় ফিরছে উড়ে বীর-প্রতাপের ভস্মশেষ।
কিন্তু যেই নজরুল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করেছেন সেই নজরুলই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত। নজরুল বন্দনার চেয়ে এখানে রবীন্দ্র কিংবা পরদেশীর বন্দনাই বেশী চলে। বাংলাদেশে এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শততম জন্মবার্ষিকী পালনের মহা উৎসব চলছে এবং তা চলবে বছরজুড়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথের আদর্শে আদর্শিত হওয়ার আহবান করেছেন। যে রবীন্দ্রনাথ খাটি মুসলিম বিরোধী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছেন; বঙ্গ ভঙ্গ রদের বিরোধীতা করেছেন; মুসলমানদের বিরুদ্ধে যার অনেক অবজ্ঞা তার আদর্শ গ্রহণের আকুল আবেদন কী অর্থ বহন করে? আমাদের প্রিয় কবি নজরুলকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে আদর্শ মানতে হবে কেন? সমালোচকদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন স্বার্থপর কবি। বৃটিশদের কুর্ণিশ করে যিনি নোবেল কুড়িয়েছেন। নজরুলের প্রতিভার স্ফুরণ দেখে তাকে প্রতিহত করার নানান ফন্দি এটেছেন। নিজের ভাতিজী প্রমিলাকে কাজে লাগিয়ে নজরুলের জীবনকে ধ্বংস করার অভিযোগ আছে যার বিরুদ্ধে তাকেই পুরুস্কৃত করা হয়েছে নানানভাবে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বানানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে। অথচ নজরুলের অসংখ্য গান ও কবিতা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হওয়ার যোগ্যতায় রবীন্দ্রনাথের চেয়ে যোজন যোজন মাইল এগিয়ে। রবীন্দ্র বন্দনায় এদেশের মিডিয়াগুলোর অবদানও কম নয়। প্রত্যেক বছর তাকে কেন্দ্র করে অনেক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে এদেশের মিডিয়াগুলো। সম্ভবত: এবছরই বিটিভির স্ক্রীনের কোণায় রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ফটোর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি দেখতে পেলাম। কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় হরফে সংবাদের শিরোণাম লেখা হয়েছে ‘রবীন্দ্রময় দেশ’। সত্যিই সেলুকাস! অথচ নিজ দেশের জাতীয় কবিকে নিয়ে তেমন কোন মাতামাতি নেই। নজরুলের বই পুস্তক, গান-কবিতা প্রচার প্রসারের ভালো কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এদেশের বর্তমান প্রজন্ম তাই আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক নজরুলকে চেনে না।
কাজী নজরুল ইসলামের বড় অপরাধ তিনি মুসলিম হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন। যদি তিনি হিন্দু কিংবা অন্য ধর্মের হতেন তাহলে তার নোবেল পাওয়াটা কঠিন হতো না। আবার মুসলমান হয়েও যদি ইসলাম বিরোধী নাস্তিক হতেন তাহলেও মূল্যায়ন পেতেন অনেক। জাতীয় কবি হয়ে দায়সারা সম্মানের অপমান তাঁকে সইতে হত না।
‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরে বসে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’
এদেশের সরকার নজরুলের ওই অনুরোধ রেখেছেন এটিওবা কম কিসে(!) যাইহোক, নজরুল আমাদের সম্পদ। আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। নজরুলকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। যদি আমরা নজরুলের চেতনাকে সামগ্রিকভাবে লালন করতে পারি তাহলে বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে আমাদের ইজ্জত বাড়বে বৈ কমবে না।
বিষয়: বিবিধ
১৪০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন