হজ্জ ও কোরবানী

লিখেছেন লিখেছেন শুভ্র ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৩:২৬:৩০ দুপুর

কোরানের আলোতে প্রচলিত হজ্জ, তারিখ এবং বিশ্বব্যপি পশুহত্যা বৈধ নয়।

হজ্জ অর্থ: সংকল্পবদ্ধ হওয়া, কসম বা শপথ করা। কোরবানী অর্থ: ত্যাগ করা উৎসর্গ করা বা বিরত থাকা। অর্থাৎ লোভ, হিংসা, মোহ, ক্রোধ, যাবতীয় মিথ্যা, অন্যায়, অশ্লীল, অপস্বভাবকর্ম ত্যাগ করার শপথ এবং তা আজীবন রক্ষা করাকেই আরবিতে হজ্জ-কোরবানী বলা হয়।

প্রচলিত হজ্জে গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে থাকা, নির্দিষ্ট কাপড় পরা, মাথা কামানো, ৭ পাক ঘোরা, পাহাড়ে দৌড়া-দৌড়ি, পাথর চুম্বন, পাথর নিক্ষেপ করে কাল্পনিক শয়তান মারা, পশুহত্যা, কয়েক ওয়াক্ত নামাজ পড়া ইত্যাদি। আর ফেরত এসে কতিপয় দিন ঘরে বন্দী হয়ে থাকা। [সূত্র: সং. ইছলামী বিশ্বকোষ, ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ; ২য় খ. ২য় সংস্করণ; ই. ফা.]।

এখানেই যাবতীয় হজ্জের সমাপ্তি, অতঃপর বেস-ভূষায় হাজী খেতাবটি বংশ পরম্পরায় স্থায়িত্ব লাভ করে।

বিশ্বাস করা হয় যে, হজ্জের মওসুমে বিশ্বের সকল শয়তান পবিত্র মক্বা নগরীতে হাজির হয়! আর হাজিগণ পাথর ছুঁড়ে শয়তান মেরে ফেলে, কাল পাথর (হজরে আছওয়াদ) চুমুতে জীবনের সকল পাপ চুষে হাজিকে নিষ্পাপ করে বেহেস্তের অগ্রিম উত্তরাধিকার মনে করে; হেন কাল্পনিক ধারণার পক্ষে রচিত হয়েছে অসংখ্য হাদিছ।

হজ্জ সম্বন্ধে কোরানের উল্লেখযোগ্য আয়াত

১. অ এজ...সুজদীন [২: বাকারা-১২৫; ২২: হাজ্জ- ২৬]। অর্থ: এবং সেই সময়কে স্মরণ করো, যখন কাবাগৃহকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, ‘তোমরা ইব্রাহিমের দাঁড়াবার স্থানকেই ছালাতের স্থানরূপে গ্রহণ করো’ এবং ইব্রাহিম ও ইছমাঈলকে তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছি।

সহজ কথা: ‘সেই সময়কে স্মরণ করো’ অর্থাৎ পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে ইব্রাহিমের জীবনব্যাপী সংগ্রামের সফলতার পর কাবাগৃহ বা স্থানকে আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর এবং তার বিধি-বিধান ঘোষণার সময়কে স্মরণ করো! কাবা সমগ্র মানবজাতির মিলনকেন্দ্র হবে, অর্থাৎ বিশ্বদরবার, বিশ্বএস্তেমা বা মুছলিম জাতিসংঘের সদর দপ্তর বলে গণ্য হবে। এখান থেকেই বিশ্ব দিকনির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ করবে। ইব্রাহিমের দাঁড়াবার স্থানকে ছালাতের স্থান গ্রহণ করার অর্থ ইব্রাহিমের প্রণীত সামাজিক রীতি-নীতি আন্তর্জাতিকভাবে অনুসরণ করবে। মক্বার চতুষ্পার্শের লোক (বহিঃর্বিশ্ব), ভ্রমনকারীগণ (তাওয়াফীগণ), মক্বার অধিবাসী বা স্থানীয়গণ (এতেকাফকারীগণ), সমর্থক বা বিনীতগণ (রুকুকারীগণ) ও সদস্য, ঈমানদার বা ভক্তগণের (সেজদাকারীগণ) যাবতীয় নিরাপত্তা ও কল্যাণ বিধানের জন্য এই সদর দপ্তর সত্য, ন্যায় ও সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে। এবং তার সভাপতি বা ইমাম হবেন (তৎ সময়) যথাক্রমে ইব্রাহিম অতঃপর তার উত্তরাধিকারী ইছমাইল; তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে আপামর সকলের জন্য সমান ও ন্যায্য অধিকার, কর্তব্য ও ন্যায়সঙ্গত (পবিত্রা) স্বার্থ রক্ষণ।

২. ইন্নাছাফা...ইয়াক্তুমুন [২: বাকারা-১৫৮]। অর্থ: ‘সাফা-মারওয়া’ আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম। সুতরাং যে কেউ কাবাগৃহের হজ্জ কিংবা উমরা করে এই দুটির মধ্যে যাতায়াত করলে তার কোনো পাপ নেই এবং কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে সৎকর্ম করলে আল্লাহ পুরস্কারদাতা সর্বজ্ঞ।

সহজ কথা: ‘উমরা’ অর্থ ভ্রমণ বা ঘুরে বেড়ানো। পুনঃস্মরণীয় যে, কোরানের যে কোনো অনুবাদে বিশেষ করে বঙ্গানুবাদে গুরুত্বপূর্ণ আরবি শব্দের বঙ্গানুবাদ না করে বরং আরবিই নতুবা পারসি, উর্দু, বা হিন্দি ভাষা ব্যবহার করা হয়; অতঃপর ‘ শরিয়তি পরিভাষা’র নামে নিজেদের পছন্দমত ব্যাখ্যা জুড়ে দেয়া হয়।

মূলত বাক্যটির সার অর্থ: যারা ইব্রাহিমের নীতি বা সংবিধান স্বীকার করে এবং সেই নীতির ওপর কায়েম থাকার শপথ (হজ্জ) করার জন্য কাবায় হাজির হয় তারা পরদেশী হয়েও আরবের যথা-তথা স্বাধীনভাবে ভ্রমণের অধিকার আছে; আয়াতে উল্লিখিত ‘সাফা মারওয়া যাতায়াতে পাপ নেই’ অর্থাৎ আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনভাবে ভ্রমণে বাধা দিতে পারবে না। অর্থাৎ আরবদেশ বিশ্বের সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে (ওপেন স্টেট/ওপেন ট্রেড)।

৩. অ আতীম্মুল হাজ্জা... একাব [২: বাকারা- ১৯৬]। অর্থ: তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরা পালন করো, কিন্তু তোমরা যদি অসমর্থ হও তবে সহজলভ্য কুরবানী করো। যে পর্যন্ত কুরবানীর পশু তার স্থানে না পৌঁছে তোমরা মাথা মুণ্ডন করো না। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ পীড়িত হয় বা মাথায় ক্লেশ থাকে তবে সিয়াম বা কুরবানীর দ্বারা তার ফিদয়া দিবে। যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি হজ্জের প্রাক্বালে উমরা দ্বারা লাভবান হতে চায় সে সাধারণ কুরবানী করবে। কিন্তু যদি কেউ তা না পায় তবে তাকে হজ্জের সময় ৩ দিন এবং গৃহে ফেরার পর ৭ দিন এই ১০ দিন সিয়াম করতে হবে। এটা তোমাদের জন্য যাদের পরিজনবর্গ মসজিদুল হারামের বাসিন্দা নয়...।

সহজ কথা: আয়াতে ‘কোরবানী’ শব্দ নেই, আছে ‘হাদিয়া ও সদাকা,’ যার অর্থ: চাঁদা, দান-দাক্ষিণ্য ইত্যাদি। অথচ সেখানে আরবি ‘কোরবানী’ শব্দটি ৪ বার ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহর উদ্দেশ্যে কিছু করার অর্থ আল্লাহর ওয়াস্তে বা নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্তভাবে পরার্থে নিবেদিত হওয়া।

সমর্থকগণ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেখানে যেতে না পারলে যথাসম্ভব চাঁদা বা উপহারসামগ্রী পাঠিয়ে দেবে; ব্যক্তি বা দলীয় বিকৃত মাথার যাবতীয় ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে ইব্রাহিমের ধর্মনীতির আনুগত্যের প্রমাণ ও প্রতীক মাথা মুণ্ডন; জন্মগত অধিকারে পেট ও পিঠের সম-বণ্টন তথা সম-অধিকারের সংকল্প ধারণের প্রতীক একই মান/মাপের একই কাপড় ধারণ। অর্থাৎ একই মানব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ধনী ও গরিব শব্দদ্বয় চিরতরে মুছে ফেলার শপথ গ্রহণ।

এই আন্তর্জাতিক শপথ সমাবেশে উপস্থিত বিদেশি হাজিগণ সঙ্গত কারণে হাদিয়া বা চাঁদাসামগ্রী দিতে অসমর্থ হলে দুটি নির্দিষ্ট সময় ৩+৭ মোট ১০দিন উপবাস প্রায়শ্চিত্ত করে সম্মেলনের প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত রীতি-নীতির প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করবে।

স্মরণীয় বিষয় যে, পশুহত্যা হোক, কি হাদিয়া বা চাঁদাই হোক তা একমাত্র উপস্থিত শপথকারীদের জন্যই প্রযোজ্য, দুনিয়ার অন্যান্যদের জন্য নয়। এবং অসমর্থ বিদেশি হাজিগণ শপথকালে (হজ্জে) ৩টি ও দেশে ফিরে ৭টি রোজা রাখবে।

অতএব ধর্মের নামে দুনিয়াব্যপী ঘরে ঘরে পশুহত্যার পাশবিক হোলি খেলা সম্পূর্ণ অবৈধ, অমানবিক। অবিলম্বে তা বন্ধ করে ১৪শ’ বছরের অভিযুক্ত ধর্মের নামে পশু খুনির আসামি থেকে ব্যক্তি ও জাতিকে মুক্ত করা হোক।

‘কোরবানী’ শব্দটি সবিশেষভাবে আলোচ্য বিষয়; শব্দটি যে কোনো অনুবাদে যত্রতত্র অসংখ্য ব্যবহার দেখলেও মূল কোরানে কিন্তু এর ব্যবহার একেবারেই বিরল! সমগ্র কোরানে মাত্র ৩টি ছুরায় ৩বার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে: ৩ : ১৮৩; ৫: ২৭ ও ৪৬: ২৮ নং বাক্যে; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, সেখানেও পশুহত্যার কথা বলা হয়নি।

হজ্জ অনুষ্ঠানে গিয়ে কী হজ্জ/শপথ করবে

৪. আল হাজ্জু...আলবাব [২: বাকারা- ১৯৭]। অর্থ: হজ্জের মাসগুলো সকলেরই জানা আছে। যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ্জের ইচ্ছা করে তার জন্য স্ত্রীসহবাস অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ বৈধ নয়। ...এবং তোমরা পাথেয় সঙ্গে নিও, জেনে রাখ তাকওয়াই শ্রেষ্ঠতম পাথেয়...।

সহজ কথা: কেউ শপথ করতে (হজ্জে) রওয়ানা হওয়ার থেকে মিথ্যা, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, লোভ, হিংসা, মোহ, ক্রোধ প্রভৃতিসহ যে কোনো ধরনের অবৈধ যৌনাভোগ ইত্যাদি যাবতীয় গর্হিত কাজ ত্যাগ (কোরবানী) করার কসম (হজ্জ) করবে এবং পরবর্তী জীবনে তা রক্ষা করে চলার দৃঢ় মনোবলই (তাকওয়া) প্রধান পাথেয় ও বৈশিষ্ট্য। অতঃপর এ অনুষ্ঠান সমাধা করতে যেন অন্যের গলগ্রহ হতে না হয়।

৫. ইন্না...আলামীন [৩: এমরান-৯৬, ৯৭]। অর্থ: মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয় তা এই বাক্বায়, এটা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। এতে অনেক সুস্পষ্ট স্মৃতি জড়িত আছে ইব্রাহিমের আস্তানায়। এবং যে কেউ সেথায় প্রবেশ করে সে নিরাপদ হয়। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহে হজ্জ করা তার অবশ্য কর্তব্য এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।

সহজ কথা: ইট-পাথরের একটি ঘর বিশ্ব মানবের শান্তি ও মুক্তির দিশারীর অর্থ মূলত ঐ ঘরখানাকেই বুঝায়নি, কারণ তাতে আল্লাহর একত্ববাদ, নবী-রাছুল, কোরান ইত্যাদি গুরুত্বহীন ও গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে এবং পাথর বা মূর্তিবাদে অনুপ্রাণিত করে; অতএব ইব্রাহিমের প্রণীত গঠনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই বিশ্ব জগতের দিশারী বলে অভিহিত করা হয়েছে।

ধারণাটি এরূপ যে, জাতিসংঘে যেই ঢুকলো সেই-ই নিরাপদ হলো। তার অর্থ এ নয় যে, জাতিসংঘের অফিস ঘরে একবার ঢুকে বেরিয়ে আসলেই আজীবন নিরাপদ থাকা যায়। আরো পরিষ্কার ও নিশ্চিত করেই বলে দেয়া হয়েছে যে, কাবা বিশ্বজগতের দিশারী, ইহজগতের বাস্তব কল্যাণকামী; বেহেস্ত বা মৃত্যুর পরের কালের দিশারী বলা হয়নি!

শুধু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেই পাপ ক্ষমা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক যুক্তি প্রমাণ নেই। কারণ ঐ ঘরেই পৌত্তলিকদের ৩৬০টি মূর্তি ছিল অথচ মূর্তিগুলো কোনো নবীর আমলেই নিরাপদ ছিল না! আবুযেহেলগণ অহরহ ঐ ঘরে প্রবেশ করতেন এবং পৌত্তলিকদেরই অধিকারে ছিল; কিন্তু রাছুলের বিপরীতে ঐ ঘর তাদেরকে রক্ষা করেনি। তাছাড়া আরবি রাজাদের শাসনামলের কোনো এক সময় থেকে অদ্যাবধি ঐ ঘরে হাজির প্রবেশ নিষিদ্ধ এমনকি হজরে আছওয়াদ (কালীপাথর) ছোঁয়া-চুম্বনও নিষিদ্ধ; একমাত্র সৌদি রাজা এবং তার পরিবার ব্যতিক্রম হলেও তারা কোনো-অবস্থাতেই নিরাপদ নন বলেই ভোগ-বিলাসী ১৩শ বছরের ধরে রাখা ক্ষমতার নিরাপত্তার জন্য, স্ব-জাতি মুছলমান থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদেরই রচিত শরিয়তের দৃষ্টিতে কাফেরদের (?) পাহারায় ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন যাপন করছেন! সেখানে যাওয়ার সামর্থ থাকার মূল অর্থ অর্থ-সম্পদ নয়! বরং শপথ রক্ষার শক্তি-সামর্থ্য এবং এর নামই তাকওয়া।

৬. জাআলা...আলীম [৫: মায়েদা-৯] অর্থ: পবিত্র কাবাগৃহ, পবিত্র মাস, কুরবানীর জন্য কাবায় প্রেরিত পশু ও গলায় মালা পরিহিত পশুকে আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত করেছেন; এটা এই হেতু যে, তোমরা যেন জানতে পার যা কিছু আসমান ও জমিনে আছে আল্লাহ তা জানেন এবং আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।

সহজ কথা: এখানেও ‘কোরবানী ও পবিত্র’ শব্দ নেই, আছে ‘হারাম’ বা সংরক্ষিত/ নিষিদ্ধ; ‘কুরবানীর জন্য প্রেরিত পশু, গলায় মালা পরিহিত পশু’ আদৌ সেখানে নেই! আছে ‘হাদিয়া’ বা দান/চাঁদা ও ‘কালায়েদা’ বা পুষ্প, পত্রমালা, হার বা বেড়ি। প্রধান কথা হল নির্দিষ্ট মাসে সংরক্ষিত কাবায় প্রাপ্ত বিভিন্ন দানসামগ্রী সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ: ‘-আমি কি তাদের নিরাপদ সংরক্ষিত (হারামে) স্থান প্রতিষ্ঠিত (কিয়ামান) করিনি? যেখানে সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানি হয় আমার দেয়া (অর্থাৎ দান হিসেবে) রিজ্জিকরূপে; কিন্তু তারা অধিকাংশই বুঝে না (২৮: কাসাস-৫৭)।

সর্ব সাধারণের জন্য জাতীয় মালখানায় (গুদাম ঘরে) হাদিয়া/দান বা উপহার হিসেবে টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না, মালা-হার, ফল-মূল ইত্যাদির মতো পশুদানও স্বাভাবিক ছিল এবং সাধারণ ব্যক্তি মালিকানার পশু থেকে দানকৃত সার্বজনীন মালিকানার পশুগুলি আলাদা করার জন্য চিহ্নস্বরূপ তাদের গলায় বেল্ট বা মালা পরানো হতেও পারে! যেমন বিদেশে গৃহ পালিত কুকুর-বিড়ালের গলায় বেল্ট পরিয়ে রাখা হয়। তবে আয়াতে সরাসরি পশুর কথা উল্লেখ নেই।

৭. অ আজ্জিন...আমিক্বনি [২২: হাজ্জ-২৭] অর্থ: এবং মানুষের নিকট হজ্জ-এর ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও ক্ষীণকায় বাহনে চড়ে, আসবে দূর-দূরান্ত পথ অতিক্রম করে-।

সহজ কথা: কাবাঘর যে আজকের জাতিসংঘের মতো কাজ করবে, দুনিয়ার সম-বিশ্বাসীদের আহ্বান করবে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও দিক নির্দেশনা দেবে উক্ত আয়াতদ্বয় তার জ্বলন্ত সাক্ষী।

৮. লি ইয়াসহাদু... ফাকিরান [২২: হাজ্জ-২৮] অর্থ: যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থাগুলোতে হাজির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যা খাদ্য হিসেবে দান করেছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তকে আহার করাও।

সহজ কথা: আয়াতে পশুর কথা আছে। দান প্রাপ্ত পশুগুলি যেন ব্যক্তি/দলের স্বার্থে না রেখে আল্লাহর নামে অর্থাৎ পরার্থে যেন ব্যবহার করা হয়। উপস্থিত দেশী-বিদেশীদের খাদ্য সমস্যা যেন পূরণ করা হয়।

৯. ছুম্মা...আতিক্বিন [২২: হাজ্জ-২৯] অর্থ: অতঃপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে এবং তাদের মানত পূর্ণ করে এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন গৃহের।

সহজ কথা: ‘তাওয়াফ’ শব্দের প্রচুর অর্থের মধ্যে: টহল, প্রত্যাগমন, চারদিকে হাঁটা, ইতস্তত পরিভ্রমণকারী, যাযাবর, দেশান্তর, দীর্ঘ পর্যটন ইত্যাদি। (আরবি-ইংরাজি অভিধান, জে এম কাউয়ান)।

আয়াতটির সাধারণ কথা: অতীতের কৃত অপকর্মগুলো (অপরিচ্ছন্নতা) ত্যাগ করে পূত পবিত্র হও এবং প্রাচীন গৃহে যা শপথ করা হয়েছে (মানত) তা পুনঃপুনঃ বা সদাসর্বদা স্মরণ রেখে ঐ শপথের মধ্যেই যেন জীবন কাটাও (তাওয়াফ করো)।

পশু হত্যা হবে একমাত্র প্রাচীন গৃহ মিনায়, অন্য কোথাও নয়

১০. লাক্বুম...মুখবেতিন [২২: হাজ্জ-৩৩, ৩৪] অর্থ: এতে তোমাদের জন্য নানাবিধ উপকার রয়েছে এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য; অতঃপর তাদের কুরবানীর স্থান প্রাচীন গৃহের নিকট; আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সব পশু দিয়েছি সেগুলোর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে...।

১১. অলবুদনা... তাশকুরুন [২২: হাজ্জ-৩৬] অর্থ: এবং উটগুলো আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম; তোমাদের জন্য তাতে মঙ্গল আছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় তাদের ওপর আল্লাহর নাম লও। যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তোমরা তা আহার করো এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকে, ক্ষুধার্তকে। এভাবে আমি তোমাদের অনুমতি দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হওয়ার সুযোগ পাও...।

সহজ কথা: তৎসময় গবাদিপশু সহায়-সম্পদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হতো; মরুভূমির দেশ, যানবাহন ও খাদ্য সমস্যার দেশ মক্বায় হজ্জে দূর-দূরান্ত থেকে আগত অগণিত মানুষের সমাগম হেতু খাদ্যসমস্যাই ছিল প্রধান এবং দান-হাদিয়া হিসেবে আসতো পশুও। অতএব সেখানে প্রচুর পশুহত্যার অনুমতি দেয়া হয়েছে, উপস্থিত সকলের খাদ্য ঘাটতি পুরণের সহজ পন্থা হিসেবে; বলাই হয়েছে: এতে তোমাদের জন্য নানাবিধ উপকার রয়েছে এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ইহাতে আগত মানুষের খাদ্যাভাব পূরণ বা দেহতৃপ্তি ব্যতীত আল্লাহর সন্তুষ্টি, পাপ খণ্ডন বা বেহেস্তপ্রাপ্তির কোনোই আলামত নেই। পীরবাবার ওরশ, বিয়ে, সভা-সমিতির ছোট-বড় সমাবেশে পশুহত্যার উদ্দেশ্যই উল্লিখিত আয়াতের মূল উদ্দেশ্য। অতঃপর তাদের কুরবানীর স্থান প্রাচীন গৃহের নিকট; অর্থাৎ পশু হত্যা হবে একমাত্র মীনায়, দুনিয়ার অন্য কোথাও নয়।

ধর্মের নামে পশুহত্যা আল্লাহ গ্রহণ করেন না

১২. লাইয়ানালা...মুহছেনীন [২২: হাজ্জ-৩৭] অর্থ: আল্লাহর নিকট তাদের গোশত এবং রক্ত পৌঁছায় না বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের করায়ত্ব করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারো।

সহজ কথা: আরবি ‘নালুন’ অর্থ প্রধানত বখশিস, যাকে ছোয়াব/ লাভ বা পুণ্য বলা হয়; সুতরাং আয়াতে বর্ণিত ‘গোস্ত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছায়না’র পরিবর্তে ‘পশুর গোস্ত-রক্তে আল্লাহর নিকট কোনোই ছোয়াব/বখশিস নেই’ অনুবাদটিই সঙ্গত। অর্থাৎ ধর্মের নামে পশুহত্যা আল্লাহ গ্রহণ করেন না; আল্লাহ তা চান না, তার অপছন্দ হেতু তাতে কোনোই ছোয়াব-লাভ নেই।

‘তাকওয়া’ শব্দটি একাধিকবার দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে; বলা হয়েছে যে শপথকারীর প্রধান পাথেয় হচ্ছে ‘তাকওয়া’, যার অর্থ সতর্কতা, শপথ রক্ষার দৃঢ় মনোবল অর্জন। এই গুণ বা আনবিক শক্তি আল্লাহ মানুষের অধীন করে দিয়েছেন, আয়ত্ত করার সূত্র বাতলে (অধীন) দিয়েছেন; সুতরাং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বতা স্বীকার করো, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্তুতিবাদ করো। দ্বিতীয়ত: বিশাল জনসমাগমে চরম খাদ্য সমস্যার সহজ সমাধান দেয়ায় আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতে বলা হয়েছে।

চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র যাবতীয় সৃষ্টি যখন মানুষের অধীন করে দিয়েছেন, সেখানে পশু বা উট অধীন করে দিয়ে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব দাবির অনুবাদ শিশুসুলভ।

১৩. অ জায়ালু...ইয়াহকুমুন [৬: আনআম-১৩৬] অর্থ: আল্লাহ যে শস্য ও গবাদিপশু সৃষ্টি করেছেন তা থেকে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্দিষ্ট করে এবং আপন ধারণা অনুযায়ী বলে, ‘এক অংশ আল্লাহর জন্য, ২য় অংশ দেবতাদের জন্য (বাকিটা নিজেদের জন্য)।’ যা তাদের দেবতাদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের দেবতাদের কাছে পৌঁছে; তারা যা মীমাংসা করে তা নিকৃষ্ট।

সহজ কথা: প্রচলিত শরিয়ত পশুহত্যার গোস্ত প্রাগ্ পৌত্তলিকদের মতোই ভাগাভাগি করে যেমন : ১ ভাগ নিজের, ২ য় ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের এবং ৩ য় ভাগ আল্লাহর নামে, যা গরিব-মিছকীনদের ২/১ টুকরা করে বণ্টন করা হয়। এ রকম শরিকী ভাগ-বণ্টন আল্লাহ ঘৃণা করেন; আর প্রকৃতপক্ষে সকল ভাগই মানুষে খায়, আল্লাহ ফেরেস্তারা খায় না; সুতরাং ঐ ভাগ বাটোয়ারাগুলি প্রতারণা মাত্র।

প্রচলিত হজ্জ-কোরবানী সিনেমা নাটকের মত অবাস্তব বর্বর অনুষ্ঠান সর্বস্ব মাত্র: কোরানের সঙ্গে তার কোনোই সম্পর্ক যে নেই তা পাঠকগণ এক্ষণে তা স্বীকার করতে বাধা নেই; আর প্রকৃত ধর্ম-কর্মের সত্যা-সত্যের যুক্তির যুক্তি হলো পরীক্ষিত মানব কল্যাণ; অর্থাৎ আদেশ-উপদেশে বাস্তবিক এবং স্থায়ী মানব কল্যাণ প্রমাণিত হলে তা-ই সত্য-সনাতন ধর্ম, মানবধর্ম এবং উহাই ধর্মের কর্ম এবং কর্মের ধর্ম, শান্তিবাদ বা ইছলাম ধর্ম।

সিনেমা-নাটকের কিছু ফলাফল থাকলেও শরিয়তের ধর্মানুষ্ঠানাদির অপব্যয় ও ক্ষতি ছাড়া কোনো পরীক্ষিত কল্যাণ (ছোয়াব) আজ ১৪ শ বছরেও প্রমাণিত হয়নি এবং হয় না বলেই ধর্ম-কর্মের লাভ-ছোয়াব মরার পর পাবে বলে শরিয়ত সকল দায়-দায়িত্ব এবং জবাবদিহিতা এড়িয়ে যায়। তাই কাল্পনিক গুণা মাফ ও বেহেস্তের অবাধ ভোগের লালসায় বাস্তব জীবন বিপন্ন করে কোটি কোটি নিরীহ পশুর রক্তের হোলি খেলায় মুছলিম বিশ্ব মদমত্ত। এই বীভৎস অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে অবলা পশুরা কি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে না! অবশ্যই করে! নতুবা জোর যবরদস্তি করে হাত-পা বেঁধে হত্যা করতে হবে কেনো! আল্লাহর যদি আদেশই থাকত! তবে নিরীহ পশুরা অবশ্যই ইছমাইলের মতোই স্বেচ্ছায় শুয়ে পড়তো।

অবৈধ আয়ের কিছু অংশ বা সামান্য হালাল ভিটে-মাটি বিক্রয় করে, সন্তানদের ভিখারি করে মক্বায় গিয়ে চুল ফেলা, পাথর চুম্বন, বৃদ্ধ বয়সে ম্যারাথন দৌড় প্রভৃতি চরম অপচয় ব্যতীত আর কিছুই নয়। আর তারই অনুসরণে পশুর রক্তে রঞ্জিত হয় সমগ্র মুছলিম বিশ্ব! পালিত হয় আন্তর্জাতিক পশুহত্যা দিবস!

যারা পশুহত্যা করে তারা নিজকে প্রশ্ন করেই প্রচলিত হজ্জ-কোরবানীর ছোয়াব-ফজিলত সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেন, নিশ্চিত হতে পারেন বর্তমান কথিত মুছলিম জাতির স্বভাব-চরিত্র, বিশ্বের অপমানজনক অবস্থা-ব্যবস্থাজনিত ছোয়াবের নমুনা দেখে।

তাদের ভাবা উচিত যে, হজ্জে যাবতীয় গুণা যদি মাফ হয়েই থাকে! তবে হাজিগণ ফেরত এসে বা পশুহত্যার পর পরই নিষ্কলুষ, পবিত্র মাসুম মুছলমান কী করে পুনরায় অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, সুদ-ঘুষ, ধর্মব্যবসা ইত্যাদি যাবতীয় গুণার কাজে লিপ্ত হতে পারে! বরং পূর্বের গুণা মাফ হয়েছে এই মিথ্যা কল্পনা করে ততোধিক পাপকাজে লিপ্ত হয়ে সমাজে অশান্তি বৃদ্ধি করেন। এতেও কি প্রমাণ হয় না যে প্রচলিত হজ্জে গুণা মাপ হয়নি বা হয় না!

হজ্জের শব্দার্থ এবং আয়াতে বর্ণিত হজ্জের প্রকৃত উদ্দেশ্য লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য আরো বিশদভাবে বর্ণনা না করে সংক্ষেপে আজকের জাতিসংঘ, রেডক্রস, ইইসি, ওআইসি প্রভৃতি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার উদাহরণই যথেষ্ট বলে মনে করা যায়। যদিও সংস্থাগুলো কতিপয় ভোগ-বিলাসী, প্রতারক ক্ষমতাধরের অপব্যবহারে প্রকৃত কার্যক্রম অনবরত ব্যাহত হচ্ছে।

পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, ‘এখানে আসার যোগ্যতা যার আছে সে যেন অবশ্যই শপথ (হজ্জ) করে।’ কিন্তু যার যোগ্যতা আছে সে যেন পশুহত্যা করে এবং এর অনুসরণে দুনিয়াব্যাপী পশুহত্যার নির্দেশ কোরানের নেই। আর যোগ্যতা বলতে সংকল্প রক্ষার মনোবলকেই (তাকওয়া) শ্রেষ্ঠতম যোগ্যতা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব নিতান্ত জ্ঞানী-শিক্ষিত ধার্মিক, শপথ রক্ষায় সামর্থ্যবান ব্যতীত শপথ অনুষ্ঠানে (হজ্জে) যাওয়ার যোগ্যতা অন্য কারো নেই, নেই অধিকার। যতই সে হালাল/হারাম সম্পদশালী হোক না কেন!

একটি দেশের বছরে ৫০/৬০ হাজার নয় মাত্র ৫ হাজার লোকও যদি কোরান অনুযায়ী যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, লোভ, হিংসা ইত্যাদি না করার সংকল্প (হজ্জ) করে এবং তা বাস্তবে রক্ষা করে চলে তবে ৫ বছরের মধ্যেই ২৫ হাজার সৎ বা প্রকৃত ধার্মিক তৈরি হয়; এদের মধ্য থেকে জাতীয় সংসদে ৩ শত সদস্য থাকলে অচিরেই প্রত্যেকটি দেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ, উন্নত এবং শান্তিপূর্ণ এমনকি বিশ্বের দৃষ্টান্তমূলক বেহেস্তখানায় পরিণত করতে পারে।

পর্যায়ক্রমে সমস্ত বিচারক, শিক্ষক, আইনজীবী, সরকারি অফিস আদালত ও সচিবালয়ের অন্তত ডেপুটি সেক্রেটারি পর্যন্ত, সেনাবাহিনীর মেজর পর্যন্ত, পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ও সি পর্যন্ত অনুরূপ সংকল্পের (হজ্জের) আওতায় আনা সম্ভব।

সকল জাতির মধ্যেই শপথের (হজ্জের) বিধান ছিল এবং আছে, কিন্তু মানবজাতির একক ও অভিন্ন শান্তির ধর্ম, সত্য-সনাতন মানবধর্ম থেকে সমাজ সংস্কার ও উন্নয়ন নীতি অর্থাৎ প্রচলিত রাজনীতিটুকু আলাদা করে তীর্থস্থানগুলোকে অকর্মণ্য-অকেজো অনুষ্ঠানসর্বস্ব একটি নেশাগ্রস্ত নাটকীয় মঞ্চে ঐশীগ্রন্থ তোরাহ, গসপেল, বেদ-কোরানকে মনুষ্যরচিত ২ নম্বরী ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ, টেস্টামেন্ট এবং হাদিছের নিচে জিন্দা কবর দিয়েছে। আর অপরদিকে খণ্ডিত সংসদ ভবন বা রাজপ্রাসাদ তৈরি করে ব্যক্তি ও দলের ঘৃণ্য স্বার্থ রক্ষাকবচ নির্মাণ করেছে। ফলে ধুরন্ধর, অভিজ্ঞ প্রতারক, মোনাফেক শিক্ষিতগণ সংসদে; মৌলবাদী বর্বর, মূর্খগণ তীর্থমঞ্চে এবং এদের ভয়ে আদর্শ, ভদ্র, দার্শনিক, জ্ঞানী-বিজ্ঞানীগণ নিগৃহীত বা উপেক্ষিত হয়ে হাজার মাস বা বছর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আইয়্যামে জাহিলীয়, বর্বর-অন্ধকার যুগ বা ‘লাইলাতুল কাদর’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে; আর তাই বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ-সম্পদ, শক্তি খরচ হয় ব্রম্মা>অব্রম> আব্রাম>ইব্রাহিমের একক পরিবারের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী পরস্পর হত্যা, যবর দখল ও ভোগ-বিলাসিতায়!

ভাগ্যবান আরবজাতি আরবি কোরান পেয়েও রাজ-পারিবারিক ঘৃণ্য স্বার্থে দুনম্বরী অহি (হাদিছ) রচনা করে ইছলামকে ৫ স্তম্ভে বেঁধে ফেলে কোরানকে প্রত্যাখ্যান করেছে: ‘তোমার জাতি তো এটাকে মিথ্যা বলছে অথচ এটাই সত্য’ (দ্র: ৬: ৬৬)। ওরা মুছলিম বিশ্বকে প্রতারিত করে আজ ১৩শ বছর যাবত এক চেটিয়া ভোগ-বিলাসী রাজকীয় কায়েম রেখেছে। যার মধ্যে ইছলাম বা শান্তিবাদের মূল ও মৌলিক স্তম্ভ: পরিশ্রম, সততা, সুবিচার ও সমবণ্টন নীতি নেই।

বাদশা পরিবার-নিয়ন্ত্রিত ইছলামের মূল বিধানসহ হজ্জের বৈশিষ্ট্য আমূল পরিবর্তন করেছেন; এমনকি হজ্জের তারিখটি পর্যন্ত পরিবর্তন করতে দ্বিধাবোধ করেনি; তদুপরি ইচ্ছা হলে কারণ-অকারণে এমনকি হজ্জও বন্ধ রাখে; ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৬টি বছর সৌদ পরিবার হজ্জ বন্ধ রেখেছিল! কিন্তু বিশ্বের একটি দেশ বা মানুষ টু-শব্দটি করেনি।

হজ্জের তারিখ বৈধ নয়

কোরানে স্পষ্ট ঘোষিত হজ্জের দিন-ক্ষণ প্রধানত জিলহজ্জ মাসের ১ থেকে ৩ তারিখের মধ্যে নির্দিষ্ট। কিন্তু শরিয়ত কোরানের বিরুদ্ধে মাত্র হিংসার বশবর্তী হয়ে নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলেছে:

১৪. ইয়াছআলুনাকা...অল হাজ্জে... [২: বাকারা-১৮৯] লোকে তোমাকে নতুন চাঁদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে, বল! এটা মানুষের হজ্জের সময়-ক্ষণ নির্দেশক...।

ক. হুয়া-হিছাব... [১০: ইউনুস-৫] অর্থ: তিনিই সূর্যকে তেজঃস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর তিথি (স্তর) নির্দিষ্ট করেছেন যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়-কালের হিসাব জানতে পারো...।

সহজ কথা: উল্লিখিত ১৪ নং আয়াতে বর্ণিত ‘লোকে তোমাকে নতুন চাঁদ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে!’ আয়াতে ‘আহেল্লাত বা নতুন চাঁদ’ (আল-হেলাল-এর বহুবচন ‘আহেল্লাহ’) অর্থাৎ চন্দ্র মাসের ১লা থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত দিনগুলোকে ‘আহেল্লাত’ বলা হয় এবং এ সম্বন্ধেই প্রশ্ন করেছে। ‘ক’ নং আয়াতে বর্ণিত ‘কামার’ চাঁদ বা চন্দ্রমাস সম্বন্ধে প্রশ্ন করেনি। উত্তরে বলা হয়েছে যে, ‘আহেল্লাত’-এ মানুষের হজ্জের (শপথের) দিন-ক্ষণ ধার্য করা হয়েছে।

হেলাল বা ক্রিসেন্ট অর্থ চাঁদ নয় বরং নতুন চাঁদ; প্রতিপদ বা প্রথমা থেকে তৃতীয়া পর্যন্ত। আরবে আজও মাসের ১লা থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিনকে ‘আহেল্লাত’ বলা হয়। অতএব হজ্জের নির্দিষ্ট দিন-তারিখ যে মাসের প্রথম ৩ দিন, তাতে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই; আল্লাহর এই নির্ধারিত তারিখ খণ্ডন করার শক্তি-যুক্তি বিশ্বের কারো নেই! অথচ রাজতন্ত্র কোরানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে তা ৯-১২ তারিখে পরিবর্তন করে আল্লাহ-রাছুলের ওপর আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রচলিত হজ্জ হারাম-হালাল পার্থক্যবিহীন ধনীদের সাময়িক আমোদ-প্রমোদের অনুষ্ঠান হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত এবং তাদেরই বেহেস্তপ্রাপ্তির অবাস্তব ধারণা বিজড়িত অনুষ্ঠান; কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ গরিবদের বছরে এক টুকরা মাংস প্রাপ্তি ছাড়া বেহেস্তের আশা-ভরসা নেই। অবশ্য এ যুক্তি খণ্ডানোর জন্য এবং গরিবদের সান্ত¡নার জন্য শরিয়ত পূর্ব থেকেই মহানবীর নামে একটি আপত্তিকর অশ্লীল হাদিছ রচনা করে রেখেছে:

‘যাদের পশু কোরবানী করার সামর্থ্য নেই, অর্থাৎ গরিব ও অসমর্থগণ নির্ধারিত ১০ দিন ধরে রাখা নখ, চুল, গোঁফ ও যৌনলোম চেঁছে ফেললে পশু কোরবানীর সমান ছোয়াব পাবে।’ (তথ্য: আবু দাউদ, ১০ম খণ্ড, হাদিছ নং-২৭৮০, পৃ: ৭৩৫; প্রকাশক: বাং. তাজ কোং লিHappy

অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট-মন্ত্রী, রাজা-বাদশা, ইমাম-আলেম, পীর-কেব্লা প্রভৃতি পাক/ নাপাক ধনাঢ্যগণ হাজার/লক্ষ টাকা দিয়ে যে পশুটি কোরবানী করলো তার আনুপাতিক মান তাদেরই দুয়ারে ভুখা-নাঙ্গা এক টুকরা গোস্তপ্রার্থী একজন ভিক্ষুক বা গরিব হাজীর চেঁছে-ফেলা চুল আর যৌন লোমের সমান!

শরিয়তের এই অশ্লীল হাদিছ! এ লজ্জা, এ অপমান ঢেকে রাখার ফতোয়া এখন পর্যন্ত রচিত হয়নি! তাই ধনাঢ্যগণ এর জবাবদিহিতা চাইলে শরিয়তের আত্মগোপন ব্যতীত অন্য পথ খোলা নেই। আল্লাহ-রাছুলের ধর্ম তথা শ্রেষ্ঠ ধর্ম নিয়ে এহেন নির্লজ্জ উপহাস, যৌন কৌতুক মহানবীর নামে রচনা করতে বুক কাঁপেনি।

পেট ও পিঠের ন্যূনতম প্রয়োজন ছাড়া অতিরিক্ত সহায়-সম্পদ এবং যাবতীয় গর্হিত কথা-কাজ ত্যাগের সংকল্প আমৃত্যু পর্যন্ত যে রক্ষা করে চলতে পারে! কাবায় না গেলেও সেই-ই একমাত্র এবং প্রকৃত হাজী বা শপথকারী।

একজন হাজী মানেই পরম সৎ, মহান ত্যাগী, শুদ্ধ, বিশুদ্ধ, পরিশুদ্ধ, বলিষ্ঠ ও সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী; তিনি রৌশন জমিন; তিনি যে কোনো সন্দেহ ও বিতর্কের উর্ধ্বে; চরম বিশ্বস্ত, নির্ভরশীল, নেতৃস্থানীয় এবং পরম পূজনীয় ব্যক্তিত্ব।

আর যদি সে বার বার প্রচলিত লোক দেখানো নাটকীয় শপথ (হজ্জ) করে আর বার বার ভঙ্গ করে! তবে তার চেয়ে অভিশপ্ত কাফের, মোনাফেক সমাজে আর দ্বিতীয়টি থাকে না।

‘যারা ঈমান আনে এবং পরে অস্বীকার করে এবং বার বার ঈমান এনে বার বার অস্বীকার করে অতঃপর তাদের কুফুরি বৃদ্ধি পেতেই থাকে, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করেন না এবং তাদেরকে পথ দেখান না। মোনাফেকদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে ‘(৪: নিছা-১৩৭, ১৩৮)।

অতিরিক্ত আলোচনা

কথিত ‘কোরবানী’ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করলেও নিম্নবর্ণিত ৩টি আয়াত কোথাও উল্লেখ করা হয়নি বিধায় বিষয়টি অসম্পূর্ণ মনে হতে পারে:

১৫. [তথ্যসূত্র: ৫: মায়েদা- ২৭] আয়াতে আদমের দুই ছেলের কোরবানী সম্বন্ধে উল্লেখ আছে এবং সেখানে ‘কুরবানী’ শব্দটিই আছে কিন্তু কী ত্যাগ (কোরবানী) করেছিলেন তার কোনো উল্লেখ নেই। সেটা একটি নির্দিষ্ট ও আল্লাহর আদেশহীন ব্যক্তিগত ঘটনা এবং ঐখানেই তার পরিসমাপ্তি; তার ধারাবাহিকতা হাবিল-কাবিল বা পরবর্তী নবীদের বংশে কোনোই প্রমাণ নেই।

১৬. [তথ্যসূত্র: ২: বাকারা- ৬৭] এখানে মুছার গাভী হত্যার উল্লেখ আছে তবে তা অনুরূপ নির্দিষ্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তাও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা; মুছলমানগণ তার ধারাবাহিকতায় প্রচলিত কোরবানী করে না।

১৭. [তথ্যসূত্র: ৩৭: ১০২-১১০] ইব্রাহিমের পুত্র হত্যার পরিকল্পনা বিষয়ক সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়টি পরবর্তি প্রতিবেদনে লক্ষণীয়।

http://www.humanrelreformation.org/index.php?option=com_content&view=article&id=150&Itemid=140

বিষয়: বিবিধ

১৫৫৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

300810
১৯ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৪:৩২
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু............ শ্রদ্ধেয় শুভ ভাইয়া। অসাধারণ একটি লিখা মাশাআল্লাহ। আপনি হজ্জের উপকারিতা অপকারিতা, অর্থ ব্যয় এবং তাকওয়া রক্ষার উপর চমৎকার একটি প্রানবন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন আলহামদুলিল্লাহ্‌।
মহান রাব্বুল আলামীন আপনাকে সর্বাবস্থায় ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন এই প্রার্থনা রইলো।
300813
১৯ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৪:৫৭
শুভ্র লিখেছেন : আপনার জন্যও অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।
300841
১৯ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৮:৫৩

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File