ইব্রাহিম (আ)এর জাতির কথা -পর্ব:১

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ গোলাম ছাকলাইন ০২ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৬:৩৯:৫৭ সন্ধ্যা

হযরত নূহ (আ) এর পর হযরত ইবরাহীম (আ) প্রথম নবী, যাঁকে আল্লাহ তায়ালা ইসলামের বিশ্বজনীন দাওয়াত প্রচারের জন্যে নিযুক্ত করে। তিনি প্রথমে স্বয়ং ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত এবং শাম ও ফিলিস্তিন থেকে আরব মরুর বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য ও বন্দেগীর অর্থাৎ ইসলামের দিকে মানুষকে আহবান জানান। অতঃপর নিজের মিশনের প্রচার কল্পে বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর খলীফা নিযুক্ত করেন। পূর্ব জর্দানে আপন ভাইপো হযরত লুত (আ) কে এবং শাম ও ফিলিস্তিনে আপন পুত্র হযরত ইসহাক (আ) কে এবং আরবের অভ্যন্তরে স্বীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র হযরত ইসমাইল (আ) কে নিযুক্ত করেন। তারপর আল্লাহ তা আলার আদেশে মক্কায় এমন এক ঘর তৈরী করেন, যার নাম কাবা। এ ঘরকেই তিনি আল্লাহর হুকুমে তাঁর মিশনের কেন্দ্রস্থল হিসাবে গণ্য করেন। (তাফহীমুল কুরআন, সূরা হুদ, টীকা-৭৪)

ইবরাহীম (আ) এর জন্মস্থান

হযরত ইবরাহীম (আ) যে শহরে জন্মগ্রহণ করেন তা শুধু আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলেই জানতে পারা যায়নি, বরঞ্চ তাঁর যুগে সে অঞ্চলের মানুষের যে অবস্থা ছিল তার উপরেও আলোকপাত করা হয়েছে। স্যার লিওনার্ড উলী(Sir Leonard woolley) তাঁর Abraham Lindon 1953 নামক গ্রন্থে গবেষণার যে ফল প্রকাশ করেছেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।

উর শহর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও তামাদ্দুনিক জ্ঞাতব্য বিষয়

আনুমানিক ২১০০ খৃষ্টপূর্ব কালে হযরত ইবরাহীম (আ) এর অভ্যুদয় হয়েছিল বরে বিশেষজ্ঞগণ আজকাল সাধারণভাবে স্বীকার করেন। সে সময়ে উর শহরের লোকসংখ্যা আড়াই লক্ষের কাছাকাছি ছিল। হয়তো বা পাঁচ লক্ষও হতে পারে। শহরটি একটি বিরাট ব্যবসা ও শিল্পকেন্দ্র ছিল। একদিকে পামীর এবং নীল গিরি থেকে সেখানে পণ্যদ্রব্যাদি যেতো এবং অন্যদিকে এনাতোলিয়ার সাথেও তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। যে রাজ্যের এ রাজধানী ছিল, তার সীমানা বর্তমান ইরাক থেকে উত্তর দিকে কিছুটা কম এবং পশ্চিমে কিছু বেশী ছিল। দেশের অধিকাংশ লোকেরই পেশা ছিল শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষে সে যুগের যেসব শিলালিপি হস্তগত হয়েছে, তা থেকে জানতে পারা যায় যে, জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিকোণ ছিল নির্ভেজাল বস্তুতান্ত্রিক। সম্পদ অর্জন করা এবং বহুল পরিমাণে ভোগ বিলাসের দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করা ছিল তাদের জীবনের লক্ষ্য। সুদের বাজার অত্যন্ত গরম ছিল। মানুষ ছিল বেনিয়া মনোভাবাপন্ন। তারা একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতো এবং পরস্পরের মধ্যে মামলা মোকদ্দমা চলতো খুব বেশী। তাদের দেব দেবীর কাছে তাদের দোয়া বেশীর ভাগ হতো দীর্ঘায়ু, সচ্ছলতা ও ব্যবসার উন্নতির জন্যে। অধিবাসী তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল।

একঃ আমীলু। এরা চিল উচ্চশ্রেণীর লোক। পূজারী, সাধারণ বেসামরিক কর্মচারী এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

দুইঃ মিশকিনু। এরা ছিল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও কৃষিজীবী।

তিনঃ আরদু অর্থাৎ ক্রীতদাস।

এ তিন শ্রেণীর মধ্যে প্রথম শ্রেণী বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল। তাদের ফৌজদারী ও দেওয়ানী অধিকার অন্যান্যদের থেকে পৃথক ছিল। তাদের জান মালের মূল্যও অন্যান্যদের থেকে বেশী ছিল।

হযরত ইবরাহীম (আ) এর হিজরতের পথ

এ ছিল সে শহর ও সমাজ যেখানে হযরত ইবরাহীম (আ) চোখ খুলেন। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের যে অবস্থা আমরা তালমুদে দেখতে পাই, তাতে তিনি আমীলু শ্রেণীর একব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পিতা রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নমরূদের নিকট তিনি রাজ্যের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মচারী(Chief officer of the state)ছিলেন।

দেব দেবী, দেব মন্দির ও পূজাপার্বণ

উরের শিলালিপিতে প্রায় পাঁচ হাজার দেব দেবীর নাম পাওয়া যায়। দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন আরাধ্য দেবতা ছিল। প্রত্যেক শহরের একজন রক্ষক থাকতো। তাকে রব্বুল বালাদ বা মহরের রব বলা হতো। তাকে মহাদেব বা রাইসুল আলেহা মনে করা হতো এবং তাকে সকল দেব দেবী থেকে অধিক শ্রদ্ধা করা হতো। উর শহরের রব্বুল বালাদ ছিল নান্নার (চন্দ্রদেবতা)। তার নামানুসারে পরবর্তীকালের লোকেরা এ মহরের নাম কামরিনা বলেছে। দ্বিতীয় বৃহৎ শহর ছিল লারসা যা পরবর্তীকালে উরের পরিবর্তে রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। তার রব্বুল বালাদ ছিল শাম্মাস(সূর্যদেব)। এসব বড়ো দেব দেবীর অধীনে অনেক ছোটো ছোটো খোদা বা দেব দেবীও ছিল। তাদের অধিকাংশ আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের মধ্য থেকে এবং অল্পসংখ্যক পৃথিবী থেকে নির্বাচন করা হতো। মানুষের ছোটে ছোটো প্রয়োজনের সম্পর্ক ছিল এদের সাথে। পুতুলের আকারে তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছিল এবং তাদের সামনে সব রকমের পূজা পার্বণ করা হতো। মানুষের ছোটো খাটো প্রয়োজনের সম্পর্ক ছিল এদের সাথে। পুতুলের আকারে তাদের প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছিল এবং তাদের সামনে সব রকমের পূজাপার্বণ করা হতো। নান্নারের প্রতিমূর্তি উর শহরের সর্বোচ্চ পাহাড়ের উপরে একটি সুরম্য অট্টালিকায় স্থাপিত ছিল। তার নিকটে নান্নারের স্ত্রী নানগুলের মন্দির ছিল। নান্নারের মন্দির ছিল রাজপ্রাসাদের মতো। তার শয়নকক্ষে প্রতি রাতে একজন পূজারিণী তার বধূ সাজতো। মন্দিরে বহু স্ত্রীলোক দেবতার নামে উৎসর্গীকৃত চিল। তাদেরকে দেবদাসী(Religious Prostitutes-ধর্মীয় বেশ্যা) বলা হতো। সেসব নারীদেরকে খুব সম্মানের চোখে দেখা হতো যারা তাদের খোদা বা দেবতার নামে তাদের কুমারীত্ব উৎসর্গ করতো। সম্ভবত একবার দেবতার পথে নিজেকে কোন অপরিচিত পুরুষের দেহ সঙ্গিনী করে দেয়াকে মুক্তির পথ মনে করা হত। এ ধর্মীয় বেশ্যাবৃত্তি থেকে আনন্দ সম্ভোগ যে অধিকাংশ পূজারীই করতো তা না বললেও চলে।

নান্নার দেবতার মর্যাদা

নান্নার শুধুমাত্র দেবতাই ছিল না। বরঞ্চ দেশের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ জমিদার, বিরাট ব্যবসায়ী, বড়ো শিল্পপতি এবং দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরাট শাসক ছিল। বহু সংখ্যক বাগ বাগিচা, জমি ও ঘর বাড়ী এ মন্দিরের নামে ওয়াকফ করা হত। এসবের আয় ছাড়াও কৃষক, জমিদার ও ব্যবসায়ী তাদের সকল প্রকার শস্য, দুধ, সোনাদানা, কাপড় প্রভৃতি মন্দিরে নজর স্বরূপ পাঠাত। মন্দিরের পক্ষ থেকেই বিরাট আকারে ব্যবসা করা হতো। এসব কাজ কর্ম দেবতার নৈকট্য লাভের জন্যে পূজারীগণ এবং তাদের রায় খোদারাই রায় মনে করা হতো। স্বয়ং রাজ পরিবারের শাসন কর্তৃত্বের উৎসও ছিল এ নান্নার দেবতা। প্রকৃত বাদশাহ ছিল নান্নার এবং দেশের শাসক তার পক্ষ থেকেই দেশ শাসন করতো। এ সূত্র অনুযায়ী দেশের বাদশাহ স্বয়ং আরাধ্য দেবতাদের মধ্যে গণ্য হতো এবং দেবতাদের মতো তাদেরও পূজা করা হতো।

নমরূদ রাজ্যের সূচনা, উন্নতি ও অবসান

উরের যে শাহী খান্দান হযরত ইবরাহীম (আ) এর জমানায় শাসক ছিল, তার প্রথম প্রতিষ্ঠাতার নাম ছিল উরনামু। সে হযরত ঈসা (আ) এর জন্মের দু হাজার তিনশ বছর আগে এক বিরাট রাজ্য স্থাপন করে। পূর্বে সূসা এবং পশ্চিমে লেবানন পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। তার থেকে এ পরিবার নামু নাম গ্রহণ করে যা আরবী ভাষায় নমরূদ হয়ে পড়ে। হযরত ইবরাহীম (আ) এর দেশ থেকে হিজরত করার পর এ পরিবারের উপর উপর্যুপরি ধ্বংসলীলা শুরু হয়। প্রথমে আয়লামীনগণ উর শহর ধ্বংস করে এবং নমরূদকে তার দেবতা নান্নারসহ ধরে নিয়ে যায়। অতঃপর লারসায় একটা আয়লামী শাসন কায়েম হয় যার অধীনে উর অঞ্চলের অধিবাসীরা গোলামে পরিণত হয়। অতঃপর আরব বংশোদ্ভূত একটি পরিবার বেবিলনে শক্তিশালী হয় এবং লারসা ও উর উভয়কে অধীনস্থ করে ফেলে। নান্নারের প্রতি উরবাসী যে বিশ্বাস পোষণ করতো, এসব ধ্বংসলীলার পর তা ক্ষুন্ন হয়ে পড়ে। কারণ নান্নার তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি।

পরবর্তী যুগে হযরত ইবরাহীম (আ) এর শিক্ষার প্রভাব

পরবর্তী যুগে সে দেশের লোকের উপর হযরত ইবরাহীম (আ) এর শিক্ষার প্রভাব কতটা পড়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু ১৯১০ খৃষ্টপূর্বে বেবিলনের বাদশাহ হামুরাবী (বাইবেলের আমুরাফিল) যে আইন রচনা করেছিলেন তাতে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নবীগণের আলোকবর্তিকা থেকে গৃহীত আলোকেরেই সাহায্য নেয়া হয়েছিল। এসব আইনের বিস্তারিত শিলালিপি ১৯০২ খৃষ্টাব্দে জনৈক ফরাসী প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকের হস্তগত হয়। তিনি তাঁর ইংরেজি অনুবাদ (C.H.W. john The dldest Code of Law নামে ১৯০৩ খৃষ্টাব্দে প্রকাশ করেন। এসব আইনের মূলনীতি ও খুঁটিনাটি বিষয়ের সাথে হযরত মূসা(আ) এর শরীয়তের সাদৃশ্য রয়েছে।

পরিপূর্ণ মুশরিকী তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা

এ যাবত যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করা হয়েছে তা যদি সঠিক হয়, তাহলে তার থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যে, হযরত ইবরাহীম (আ) এর জাতি যে শিরকে লিপ্ত ছিল তা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পৌত্তলিক পূজা পার্বণের সমষ্টিই ছিল না। বরঞ্চ প্রকৃতপক্ষে সে জাতির গোটা অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা ঐ আকীদা বিশ্বাসের ভিত্তিতে চলতো। তার মুকাবিলায় হযরত ইবরাহীম (আ)তাওহীদের যে দাওয়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তার প্রভাব শুধু প্রতিমা পূজার উপরেই পড়েনি, বরঞ্চ শাহী খান্দানের খোদা হওয়ার দাবী, তাদের কর্তৃত্ব প্রভুত্ব, পূজারী ও উচ্চ শ্রেণীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং সমগ্র দেশের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার উপর তা এক চরম আঘাত হেনেছিল। তাঁর দাওয়াত বহন করার অর্থ এই ছিল যে, নীচ থেকে উপর পর্যন্ত গোটা সমাজ প্রাসাদ চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে হবে। তারপর তাকে আবার তুন করে তাওহীদের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্যে হযরত ইবরাহীম (আ) এর আওয়াজ ধ্বনিত হওয়ার সাথে সাথে সর্বসাধারণ, নমরূদ ও পূজারীগণ সকলে একত্রে সে আওয়াজ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যে বদ্ধপরিকর হলো। (তাফহীমুল কুরআন, সূরা আশ শুয়ারা, টীকা-৯৯)

নমরূদের মুশরিকী ব্যবস্থার পর্যালোচনা

অ থেকে আজ পর্যন্ত সকল মুশরিক সমাজের এ একই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, তারা আল্লাহ তা আলাকে রব্বুল আরবাব অর্থাৎ সকল রবের রব এবং সকল খোদার খোদা বলে তো মানে কিন্তু শুধু একাকী সেই রবকে এবং সেই খোদাকে মাবুদ বলে স্বীকার করে না।

মুশরিকগণ সর্বদা খোদার খোদায়িকে দুভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। এক অতি প্রাকৃতিক খোদায়ি যা কার্যকরণ পরম্পরার উপর কর্তৃত্বশীল এবং যার দিকে মানুষ তার প্রয়োজন পূরণ ও বিপদ আপদ দূর করার জন্যে ধাবিত হয়।

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

356055
০৩ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৫:০৯
সাদাচোখে লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম।
আজকের পৃথিবীতে ও আমরা সকল খোদার উপরের খোদার সাথে জেনে, না জেনে, বুঝে না বুঝে আরো অনেক খোদা বানিয়ে নিয়েছি।
পার্থক্য এই যে, আমাদের এই খোদা কখনো গডফাদার, কখনো পীর দরবেশ, কখনো লিডার। আবার কখনো কোন প্রতিষ্ঠান, কিংবা দেশ কিংবা সংগঠন।
আল্লাহ আমাদের বুঝার শক্তি বাড়িয়ে দিন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File