বগুড়া জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ গোলাম ছাকলাইন ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৬:৪২:০১ সন্ধ্যা
স্বাধীন বাংলাদেশে শুয়ে আছে রক্তের উপরে। শুধুমাত্র সামান্য ক’টি মানুষের রক্ত নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত নদীর ধারার উপরে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের উৎসর্গ পাত্রটি হৃদয়ে ধারণ করে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এর আগে আর কখনো এতো রক্তের নির্গমন দেখেনি। মানবিক ও লৌকিক বাস্তবতার এতো ত্যাগ খুব কম দেশই স্বাধীনতার জন্য বিসর্জন দিতে পেরেছে। বাংলাদেশ তাই হয়ে উঠেছে মুক্তিকামী মানুষের এক বিস্ময়কর রক্তরঞ্জিত প্রত্নশক্তি। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে তুলেছিল এই শাশ্বত সৃষ্টি, এই অমর কীর্তি। অর্জিত সে কীর্তির উপর আজ বসবাস করছে পনেরো কোটি স্বাধীন বাঙালি। সর্বসুবিধা ভোগ করছে একটি স্বাধীন দেশের। নেতানেত্রী বনে যাওয়ার, মন্ত্রী, আমলা, ডাক্তার, ব্যবসায়ী প্রকৌশলী বনে যাওয়ার অফুরন্ত সুযোগ ভোগ করছে। একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে কাজ করার সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। একাত্তরের বাঙালি রুখে দাঁড়াতে না পারলে, এতো ত্যাগ বিসর্জন না হলে, বাঙালিদের চিরকাল পাকিস্তানি উপনিবেশিক শেকলে বন্দী থেকে ভৃত্যের মতো বসবাস করতে হতো। মুক্তিযুদ্ধের এই ত্যাগকে আজ যারা হেয় প্রচার করছে, তারাই এই রাষ্ট্রের সর্বসুবিধা ভোগের আয়াসে চেটেপুটে খাচ্ছে। পাকিস্তানিদের পদলেহনকারী এই নির্লজ্জ দালালরা লক্ষ লক্ষ বাঙালির আত্মোৎসর্গকে হাজার মানুষের হত্যাকান্ড হিসেবে কটুক্তি করে থাকে। স্বাধীনতাকে খাটো করে দেখার এই প্রবৃত্তি জন্ম নেয় একধরনের হীনমন্যতা বোধ থেকে।
পাকিস্স্তানিদের দালালি করার অবৈধ ও অশ্লীল সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত হওয়ার অপমান বোধ থেকে তারা এই নেতিবাচক প্রচার প্রচারণা চালাতে তৃপ্তি বোধ করে। মুষ্টিমেয় সংখ্যালঘিষ্ট এই তাহজীব তমুদ্দুনজীবী গোষ্ঠী এ ধরনের নিন্দাবাদের স্রষ্টা ও প্রচারক। যুদ্ধাপরাধ সেসময় এরাই ঘটিয়েছিল। বুদ্ধিজীবি হত্যা, ধর্মের নামে নারকীয় অত্যাচার উৎপীড়ন, খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষন প্রভৃতি নারকীয় দুঃশাসনিক কর্মকান্ড এদের মাধ্যমেই বিকাশ ঘটেছিল উপনিবেশিক শাসকের নির্দেশে বা ছায়ায়। এরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়টিকে এতকাল পরে এদেশের মানুষকে বিভক্ত করার কৌশল হিসেবে প্রচার করে। যুদ্ধাপরাধ নিয়ে এদের মস্তিষ্ক প্রসূত উদ্ভাবনা যে শুধু বিকৃত চিন্তার ফসল তা কিন্তু নয়। এটা হচ্ছে অপরাধকে আড়াল করার এক ধরনের অপকৌশল। কেননা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নিজেদের কৃতকর্ম তাদের আতঙ্কিত করে তুলছে। এদেশের মানুষের এই নবজাগরণ তাদের এতটাই ভীত করে তুলেছে যে, পূর্বকৃত্যের ভুলের মাশুল গোপন করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে। সমাজ ও ইতিহাস সচেতন মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে বিভ্রান্ত করে তোলার জন্য তারা একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি চেতনার এক সুষমা মন্ডিত আভা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির এক অসাধারণ প্রেরণার উৎসমুখ।
-সেক্টর কমান্ডারদের একাংশ
যে প্রেরণায় এক মহত্তম দুঃসাহসের বাস্তবায়ন আমরা ঘটাতে পেরেছি। সত্তরের নির্বাচনকে ব্যর্থ করে দেওয়ার অশুভ পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ফলেই এর সূচনা হয়। সারাদেশে পাকিস্তান বিরোধী তীব্র আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। বগুড়াও সেই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটি প্রতিটি মহল্লায় কমিটি তৈরী করে অতন্দ্র প্রহরার ব্যবস্থা করে। প্রতিদিন মিছিল ও জনসভা চলতে থাকে। ছাত্রজনতার মিছিলে শ্লোগানে উচ্চারিত হতে থাকে। তেসরা মার্চের অধিবেশন হতে হবে, নইলে বাংলা স্বাধীন হবে। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। সে সময় সারা দেশের মতো বগুড়াও ছিল ছাত্রজনতার মিছিলের শহর।
- বগুড়ার কৃতি সন্তান শহীদ জিয়াউর রহমান
বগুড়া জেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সে বিশাল জনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এমন বস্ত্তনিষ্ঠ প্ররোচনা দানকারী, সময়োপযোগী ও স্পর্শকাতর ভাষণ গোটা বিশ্বে প্রায় নজিরবিহীন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
বগুড়ার রাজনৈতিক আন্দোলনে এতে নতুন শক্তি ও মাত্রা যুক্ত হয়। বগুড়ার আপামর জনসাধারণ সেই প্রথম এক দুর্নিবার শক্তি অর্জন করে। স্বাধীনতা একমাত্র স্বাধীনতাই হয়ে ওঠে বাঙালির জন্য তাৎপর্যবহ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের এই পলিমাটিতে স্বাধীনতার এক অলৌকিক চেতনার বীজ বুনে দিয়ে যায়। তবে বড় কাজটি করেন শহীদ জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন জিয়াউর রহমান জীবন বাজি রেখে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। যা সারা বিশ্বে মূহূর্তে ছড়িয়ে পরে। মার্চ মাসব্যাপী এই আন্দোলন চলতে থাকে সমানতালে। একাত্তর এনে দিয়েছিল তরুণ ও নবীন প্রজন্মের কাছে এক বাধা না মানার আগ্নেয় উত্তাপ। ২৫ মার্চ আসে সেই কালরাত্রি। পাকিস্তানি বাহিনী পৈশাচিক শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ ছাত্র জনতার উপর। চলে ক্র্যাক ডাউন। জার্মানীতে হিটলারী হলোকস্টও যার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়।
এ দুঃসংবাদে প্রমত্ত হয়ে ওঠে বগুড়া। চারিদিকে নানা গুজব ও আশঙ্কা। সামরিক আইনের জাতাকল ভেঙ্গে ফেলার পণ। এসময় সংবাদ পাওয়া যায় যে, রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান আর্মি ট্যাংক ও সাঁজোয়া বাহিনী সহ বগুড়ার দিকে মার্চ করছে। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সদর রাস্তা ব্যারিকেডে ভরে ওঠে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত কর্মপ্রয়াসে। যে যেভাবে পারে আর্মস সংগ্রহ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পাকিস্তানি আর্মি বগুড়ায় প্রবেশকালে মাটিডালিতে ব্যারিকেড দেওয়া অবস্থায় এক রিক্সাচালককে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধে তিনিই প্রথম শহীদ হন। তিনিই প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। সড়কপথে কালিতলা হাটে পাকিস্তানি আর্মি শক্ত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আধুনিকভাবে সুসজ্জিত পাকিস্তানি আর্মির সাথে কমব্যাট যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পাকিস্তানি আর্মির গুলিতে বড়গোলায় মুক্তিযোদ্ধা আজাদ শহীদ হন। রেলগেটে মালট্রেনের বগি দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানি আর্মি বেশ শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। রেললাইনের আশেপাশে কতিপয় দরিদ্র দোকানদারকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। পাকিস্তানি আর্মি রেলগেট পার হতে না পেরে সেখানেই থমকে যায়। ছাত্রনেতা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যবৃন্দ এই মুক্তিযোদ্ধার রাইফেল ও বন্দুক সহ পাকিস্তানি আর্মির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়। সকাল ৪টা থেকে প্রায় ১১টা পর্যমত্ম এই ভয়ঙ্কর লড়াই চলে। পাকিস্তান আর্মি আর কোন সুবিধা করতে না পেরে রেলগেট এর ঘুমটি ও বড়গোলা থেকে পিছু হটতে থাকে। বগুড়ার মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে সেদিন যে অসীম সাহস, ধৈর্য্য ও মনোবল দেখিয়েছিল ইতিহাসে তা বিরল এক দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। পাকসেনারা মহিলা কলেজে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি আর্মিরা যখন এভাবে রিট্রিট করছিল, তখন বড়গোলার মোড়ে তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের ছাদ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অসীম সাহসে চ্যালেঞ্জ করে। পাক আর্মি নিচ থেকে তাদের ঘিরে ফেলে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে পাক আর্মির হাতে তারা স্যারেন্ডার করতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা সেখানে নির্মমভাবে মোস্তাফিজার রহমান চুন্নু ও টিটুকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে। হিটলুকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে যায়। শোনা যায় হিটলুকে তারা মেরে ফেলে তার লাশ লুকিয়ে ফেলে। বগুড়ার প্রথম পর্যায়ের এই মুক্তিযুদ্ধ ও সড়কপথে জনতার লড়াই আজো আমাদের স্মৃতি বিস্মৃতিতে এক মহান ত্যাগের মহিমা হয়ে আছে। আজো চোখ মুদলে দেখি জেগে ওঠে অজস্র দৃশ্য। যেন অন্তহীন এক চলচ্চিত্র তার সবাক দৃশ্য ছড়িয়ে দেয়। আমরা যারা কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ চোখের সামনে অবিরাম ঝলমল করে ওঠা দৃশ্যের পর দৃশ্য। এ দৃশ্য বেদনার ও বিষন্নতার। এ দৃশ্য যুগপৎ আনন্দ ও সুখের। এ দৃশ্য ত্যাগ ও অর্জনের। ত্যাগ ও অর্জন বিশাল। আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ যার নাম। যে বাংলাদেশে আজো মুক্তিযুদ্ধের নামে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। যে বাংলাদেশকে ‘‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি আরো রক্ত দেবো, তবু এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুঞ্জয়ী এই ঘোষণা আজো আমাদের রক্তে প্রচন্ড আলোড়ন জাগায়। শিহরণ তোলে। আবেগ সৃষ্টি করে। যে উদ্দীপনায় আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। আর বাংলাদেশের রক্তাক্ত ভূমিতে সমস্ত চক্রান্ত খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে।
২৫ শে মার্চে প্রতিরোধের যুদ্ধে বগুড়া।
২৫ শে মার্চে কালো রাত্রিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার জন্য রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রস্ত্তত হয়ে আছে। বগুড়া থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানতে পারেন যে, একদল পাকিস্তানি সৈন্য রংপুর থেকে রওনা হয়েছে। রাতের মধ্যে শেষ করে দিবে বগুড়ার সমস্ত মানুষকে। হত্যাযজ্ঞের নীল নকসা তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সমস্ত জেলায় একসাথে অপারেশন চালানো হবে। এ খবর পাওয়া মাত্র দ্রুত জীপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। চিৎকার করে আসন্ন বিপদের কথা প্রচার করলেন-‘‘জাগো জাগো বগুড়াবাসি। রংপুর থেকে আর্মি রওনা দিয়েছে। রাস্তায় ব্যারিকেড লাগাও প্রতিরোধ কর। জাগো জাগো’’। বগুড়া শহরের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় জীপ নিয়ে প্রচার করলেন ওসি সাহেব। এর মধ্যে মমতাজ উদ্দিন, হায়দার আলী, এ কে মজিবর রহমান, মোশারফ হোসেন মন্ডল, লাল ভাই, তপন, স্বপন, ডাঃ জাহিদুর রহমানের সাথে দেখা করলেন ওসি সাহেব। খুলে বলল সমস্ত ঘটনা। আশ্বাস দিল আপনারা প্রতিরোধ করুন, পুলিশও থাকবে।
সমস্ত শহরে রাতের অন্ধকার চিরে শ্লোগান ভেসে উঠল
বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
সাইরেন বেজে উঠল কালিতলা মসজিদ থেকে রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে নিমিশের মধ্যে সমস্ত বগুড়া শহর মিছিলে মিছিলে আর শ্লোগানে কেঁপে উঠল। সবাই মিলে রংপুর রোডে গাছ ব্যারিকেড সৃষ্টি করল। পাকিস্তানের আর্মিরা ধীরে ধীরে দানবের মত এগিয়ে আসছে বগুড়া শহরের দিকে। পাকিস্তানি আর্মিদের জীপগুলো এসে থামলো, দেখলো রাস্তা বড় বড় গাছের ডাল দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা। পাকিস্তানের সৈন্যরা ব্যারিকেড সরালো এবং মোকামতলার দিকে রওনা হলো। ঠেঙ্গামারার দিকে এসে পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ির লড়ি থামল। পাকিস্তানি মেজর ইশারা দেয়ার সাথে সবাই দ্রুত পজিশন নিল। তারপর বলল ফায়ার। প্রথমে বুকে গুলি খেয়ে পাখির মত গাছ থেকে ঢলে পড়ল ঠেঙ্গামারার রিকসা চালক তোতা। এই তোতাই বগুড়ার প্রথম শহীদ।
বগুড়ায় সংঘটিত উল্লেখযোগ্য মুক্তিযুদ্ধ
১। নসরতপুর রেলওয়ে স্টেশনে যুদ্ধঃ
সময়টা ১৯৭১ এর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ কিংবা নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হবে। আদমদীঘি উপজেলাধীন নসরতপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাহাড়ারত পাকিস্তানি সৈনিক এবং রাজাকারদের পাকড়াও করার জন্য একরাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মনসুর রহমান, ইয়াকুব আলী, মোজাম্মেল হক, মোখলেছার রহমান ও আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রায় দেড়-দু’শ মুক্তিযোদ্ধা অপারেশনে অংশগ্রহণ করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা পর্যদস্ত হয়ে রেল লাইন বেয়ে পশ্চিম দিকে সান্তাহারে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে হলুদঘর গ্রামের এন্তাজ নামের একজন রাজাকার চোখে গুলির আঘাত লেগে মারাত্মক আহত হয় এবং রাজাকার আবুল (বেলপাড়া), বছির (থলপাড়া), আজিজার (শাকোয়া), ফজলু (ধামাইল) ও আবের (হলুদঘর) অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।
২। আদমদীঘি রেলওয়ে স্টেশনে যুদ্ধঃ
সময়টা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি আদমদীঘি রেলওয়ে স্টেশনে থাকা পাকিস্তানি সৈনিক এবং রাজাকারদের ওপর বীরমুক্তিযোদ্ধা মিলেটারি আমজাদ হোসেন ও আবুল হোসেনের মুক্তিযোদ্ধা দল প্রবল আক্রমণ চালায়। দীর্ঘক্ষণ যাবত গুলি বিনিময় হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। অতঃপর পাকিস্স্তানি সৈন্যরা ক্রোলিং করে রেললাইন বেয়ে পশ্চিম দিকে সান্তাহারে পালিয়ে যায়। রাজাকার লুৎফর রহমান (তালসন), ছালাম (তালসন) সহ অজ্ঞাত পরিচয় আরো ৪/৫ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।
৩। কুসম্বীর যুদ্ধঃ
এ যুদ্ধটি হয় ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, শনিবার দিন। সকালে আদমদীঘি থানা সদর পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্প হতে (প্রায় ১০০ জন পাকিস্তানি সৈনিক দক্ষিণে রাণীনগর থানাধীন ভান্ডার গ্রাম যায়। খবরটি জনৈক সংবাদদাতা আদমদীঘির পাশে রামপুরায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিলেটারি আমজাদ হোসেন ও এল,কে, আবুলকে দেয়। খবর চেয়ে উভয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাঁদের সঙ্গীয় সহযোদ্ধাদের নিয়ে কুসম্বী গ্রামে এসে রাস্তা সংলগ্ন ঝোপ ঝাড় বেষ্টিত এক উঁচু পুকুর পাড়ে এ্যাম্বুশ করে থাকে ভান্ডার গ্রাম যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যাম্বুশের সামনে সদর রাস্তাটি ভাঙ্গা এবং কর্দমাক্ত ছিল। এই পথেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ফিরে আসবে। অনেক প্রতীক্ষার পর প্রায় ত্রিশ জন পাক আর্মি ফিরে এসে রাস্তার ভাঙ্গা যায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে পিছনের দলের আসার প্রতীক্ষায়। একটু পরপর আরো দু’দল পাকিস্তানি সৈন্য এসে উক্ত স্থানে একত্রিত হয়। ওদের সংখ্যা তখন ১০০ জন।
এই ১০০ জনই মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ এ্যাম্বুশের মাঝে পড়ে। সঙ্কেত পাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। প্রথম ফায়ারেই অধিকাংশ পাকিস্তানি সৈন্যরা মারা যায়। বেঁচে থাকা সৈন্যরা পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। এ অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময় চলতে থাকলে রেলযোগে তালোড়া এবং সান্তাহার হতে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য এসে আদমদীঘি রেল ষ্টেশনে নেমে আক্রান্তদের ডিফেন্স দেয়ার জন্য এগুতে থাকে। ওরা মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে করতে কুসম্বীর দিকে এগিয়ে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তিযোদ্ধা দল এ্যাম্বুশ প্রত্যাহার করে পালিয়ে যায়।
তালসনের সোনাতন গাড়োয়ানের গরুর গাড়িতে করে মৃত পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশ আদমদীঘি রেলওয়ে ষ্টেশনে নিয়ে আসে। পরে সোনাতন গাড়োয়ানের কাছ থেকে জানা যায়, ওই দিন কুসম্বার যুদ্ধে ৯৬ টি লাশই সোনাতন গাড়োয়ান গরু গাড়িতে করে আদমদীঘি রেলওয়ে ষ্টেশনে বয়ে এনেছিল।
৪। আদমদীঘি থানায় যুদ্ধঃ
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখে আদমদীঘি থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকারদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বীরমুক্তিযোদ্ধা মেলেটারি আমজাদ হোসেন, আবুল হোসেন এবং এলকে আবুলের মুক্তিযোদ্ধা দল। উদ্দেশ্য ছিল হযরত আদম বাবার পবিত্র ভূমি আদমদীঘি থানা সদর শত্রুমুক্ত করা।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমনের কাছে টিকতে না পেরে আর্মিরা সান্তাহারের দিকে পালিয়ে যায় এবং ৪/৫ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। এদিন হতে আদমদীঘি থানা সদর শত্রুমুক্ত হয়।
৫। ডালম্বা-পাইক পাড়া যুদ্ধঃ
এ যুদ্ধটি হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর। বিভিন্ন স্থানে তাড়া খেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়ক বেয়ে সান্তাহার-নওগাঁর দিকে পায়ে হেঁটে পালাচ্ছিল। পলায়নপর একদল পাক সেনার ওপর এদিন বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের ডালম্বা-পাইকপাড়া নামক স্থানে বীরমুক্তিযোদ্ধা মিলেটারি আমজাদ হোসেন এবং মিলেটারি আব্দুল হাকিম (বড় আখিরা) এর সঙ্গীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে ডহরপুর গ্রামের মৃত নীলচাঁদ প্রামানিকের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সাত্তার শহীদ হন। তাঁর এফএফ নং ৪৪৩৯। কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যরা সান্তাহারের দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
৬। শহীদ সুজিত গেটে দুর্ঘটনাঃ
এটা ছিল ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। এটা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ নয়। একটি সমাপ্তি দুর্ঘটনা মাত্র। শহীদ সুজিত বর্মণ ছিলেন ময়মনসিংহের ছেলে। তিনি সান্তাহারের বীরমুক্তিযোদ্ধা এলকে আবুলের গ্রুপে যুদ্ধরত ছিলেন শ্যামলা বর্ণের ছিপছিপে সুজিতের মুখমন্ডল ছিল গোলাকার। স্বাস্থ্য ছিল ক্ষীণ। ১৯৭১ সালে তিনি বি,এস,সি ক্লাশে পড়তেন।
এই মুক্তিযোদ্ধার এইটুকু তথ্যই জানা গেছে। তিনি ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা রোড রেল ক্রসিংও বলা হয়। সেখানে শহীদ সুজিত রেললাইনের ওপর একই সাথে ৮টি এন্ট্রি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে ট্রেন আসার সাথে সাথে ব্লাস্ট করার প্রতীক্ষায় থাকেন। কিন্তু সংযোগ প্রদানে ভুল থাকার কারণে কিংবা তারে কোনো লিকেজ থাকার কারণে অথবা অন্য কোনো ত্রুটির জন্য ট্রেন আসার আগেই মাইনগুলোর বিস্ফোরণ ঘটে এবং সে মাইন বিস্ফোরণের আঘাতে সুজিত ঘটনাস্থলে শহীদ হন। এই মুক্তিযোদ্ধার কোনো পিতৃপরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
৭। সান্তাহারের যুদ্ধঃ
তারিখটা ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এদিন সান্তাহার শহরকে মুক্তিযোদ্ধারা তিনদিক হতে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে করতে শহরের ভেতর প্রবেশ করতে থাকে। একদল মুক্তিযোদ্ধা বীরমুক্তিযোদ্ধা মিলেটারি আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে টিয়র পাড়া ব্রিজ হয়ে কলোনীর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। অন্যদল হালালিয়া ষ্টেশন হতে রেললাইন বেয়ে দক্ষিণ দিক হতে অগ্রসর হয়। তৃতীয় দলটি অগ্রসর হয় উত্তর পশ্চিম কোণ দিয়ে। ত্রিমুখী আক্রমনের তোড়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরূপায় হয়ে পশ্চিমে নওগাঁ শহরে পালিয়ে যায়। গুটিকতক বিহারি রাজাকার ধরা পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এবং গুলি করে তাদের হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা।
এইদিন সান্তাহার শত্রুমুক্ত হয়। ফলে সমগ্র আদমদীঘি উপজেলাই শত্রুমুক্ত হয়। কথিত আছে হযরত আদম বাবা ইয়াসিনী বহু যুগ আগে এখানে আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য। তিনি আদমদীঘি সদরে আস্তানা গেড়ে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। তখন পানীয় জলের খুবই অভাব ছিল। হযরত আদম বাবার অনুরোধে রাণীভবানী হযরত আদম বাবার আস্তানার দু’পাশে মস্তবড় দু’টি দীঘি খনন করে দেন। এই দীঘি দু’টির নাম দেয়া হয় আদমদীঘি। সেই থেকে এ স্থানটির নামও হয়ে যায় আদমদীঘি।
হযরত আদম বাবার পবিত্র ভূমিতে অত্যাচারী পাকিস্তানি সৈন্যরা দম্ভভরে টিকতে পারেনি। পৃথিবীর বিখ্যাত যুদ্ধবাজ সৈনিক হয়ে তাঁদের পরাস্ত হতে হয়েছে বাংলার দামাল সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হযরত আদম বাবার পবিত্র ভূমি আদমদীঘি শত্রুমুক্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৌর্য বীর্যের কারণে আদমদীঘিবাসী বুক ভরে নেয় মুক্ত নিঃশ্বাস। উপভোগ করে স্বাধীনতার স্বাদ। দু’দিন পর ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ন বিকেল ৪টা ২১ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইষ্টার্ন কমান্ড প্রধান আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে নিঃশর্তভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে যৌথবাহিনীর কাছে। সমগ্র বাংলাদেশ হয় শত্রুমুক্ত।
মুক্তিযোদ্ধা তথা বাঙালি জাতি অর্জন করে বিজয় ।
তথ্যসূত্র: Click this link
বিষয়: বিবিধ
২০৯১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন