বিষয়ঃ হাদিসের রাবীদের দোষ ও গুণ নির্ণয়ন

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ নূরুল্লাহ তারীফ ১০ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৫:২৯:২২ বিকাল

মাস্টার্সের সদ্য সমাপ্ত সেমিস্টারে একটা সাবজেক্ট ছিল “আল-জারহ ওয়াত তাদিল” (দোষ ও গুণ নির্ণয়ন)। পড়িয়েছেন শাইখ ইব্রাহিম আল-রঈস (আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিন)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস সম্ভার গ্রন্থায়নের পূর্ব পর্যন্ত রাবী বা মুহাদ্দিসের মুখ থেকে অথবা খাতা থেকে পঠিত হাদিস ছাত্ররা শুনে মুখস্ত করে নিত অথবা খাতায় লিখে রাখত। বর্ণনাকারীগণ সকলে মুসলমান হলেও সবার দ্বীনদারি একই মানের ছিল না। মানুষ হিসেবে মুখস্তশক্তিও একই পর্যায়ের ছিল না। তাই রাবীর দোষ-গুণ বা মান নির্ণয় ছিল অত্যাবশ্যক।

এ সাবজেক্টে সাহাবী পরবর্তী হাদিস বর্ণনাকারী বা রাবীর সংবাদের মান নির্ধারণের জন্য রাবীর দোষ-গুণ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়। রাবীর দ্বীনদারি ও সংরক্ষণগুণ (মুখস্তশক্তি ও হাদিসের খাতা সংরক্ষণ)- এ দুটো হলো প্রধান আলোচ্য বিষয়। কুফর, ফিসক (কবিরাগুনাহ বা পুনঃপুনঃ সগিরা গুনাহ), বিদআত, সাধারণ মিথ্যা, রাসূলের নামে মিথ্যা, ব্যক্তিত্বক্ষুন্নকারী আচরণ ইত্যাদি রাবীর দ্বীনদারিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অপরদিকে দুর্বল মুখস্তশক্তি, অধিকহারে বিপরীত বর্ণনা, বেশি বেশি ভুল করা, বার্ধক্যজনিত বা রোগজনিত কারণে মুখস্তশক্তিতে ত্রুটি আসা, ক্লাশে ঘুমানো বা অমনোযোগী থাকা, হাদিসের নোট খাতা পুড়ে যাওয়া, নোট খাতাকে সংযোজন ও বিয়োজন থেকে হেফাযত করতে না পারা ইত্যাদি রাবীর সংরক্ষণ গুণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রাবী-সমালোচকদের উক্তিগুলোর অর্থ বুঝা, একই উক্তির ভিন্নার্থে প্রয়োগ লক্ষ্য করা। সমালোকদের মধ্যে কারা কড়াভাষী, কারা অতি-নমনীয় এবং কারা পূর্ণ-ন্যায়বান তাদেরকে চেনা এবং বিরোধপূর্ণ উক্তিগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন অথবা অগ্রগণ্যতা প্রদান অথবা সিদ্ধান্তহীন অবস্থান গ্রহণ করার নীতিগুলো জানা। রাবী সমালোচকদের গ্রন্থগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া। যেমন- ইমাম বুখারীর ‘আল-তারিখ আল-কাবির’ (এতে রাবীর সংখ্যা: প্রায় ৩৫০০), ইবনে আবু হাতিম ‘আল-জারহ ওয়াত তাদিল’ (রাবীর সংখ্যা ৩০০০ এর কাছাকাছি), মিজ্জির ‘তাহযীবুল কামাল’ (রাবীর সংখ্যা প্রায় ৮০০০), ইবনে হাজারের ‘তাহাযিবুত তাহযীব’ (রাবীর সংখ্যা প্রায় ৯০০০); এছাড়া আরও অনেক গ্রন্থ ‘আল-ছিকাত’, ‘আল-দুআফা’, ‘আল-কাশেফ’, ‘আল-ইকমাল’ ইত্যাদি। এ সাবজেক্টে আমার এসাইনমেন্ট ছিল ইবনে হাজারের ‘তাহযীবুত তাহবীয’ এর দ্বিতীয় ১০০ পৃষ্ঠায় যে রাবীদের নাম, পরিচয় ও মান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এদের মধ্যে এমন রাবীগণ চিহ্নিত করা যাদের ব্যাপারে সমালোচকদের বক্তব্য বিরোধপূর্ণ। যেমন কেউ বললেন: তিনি ছিকাহ (দ্বীনদার ও সংরক্ষণ শক্তির অধিকারী), অন্যজন বললেন: দ্বীনদার; কিন্তু ভুল করেন। কেউ বলেন: তিনি অমুক শিক্ষকের হাদিসে ভুল করেন ইত্যাদি। এ ধরণের বিরোধপূর্ণ বক্তব্যগুলোর মাঝে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ২০টি নীতির কোন কোন নীতিটি প্রয়োগ করা যায় সেটা নির্ণয় করা। দীর্ঘ পরিশ্রম করে এ্যাসাইনমেন্ট তৈরী করলাম এবং প্রেজেন্টশনের আগে শাইখকে মেইলে কপি পাঠালাম। তা দেখে প্রেজেন্টশনের পূর্বে শাইখ বললেন: তোমাদের (আমি ও সহপাঠী ফয়সাল) এ্যাসাইনমেন্ট ভাল হয়েছে। কিন্তু প্রেজেন্টেশনের পর যখন এ্যাসাইনমেন্টের উপর একের পর এক সহপাঠীদের ও শিক্ষকের সমালোচনাগুলো পেশ করা শুরু হল তখন মনে হল: আমার মাথা ভোতা হয়ে গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে জবাব দেয়ার জন্য কিছুই মনে করতে পারলাম না। আলহামদুলিল্লাহ তবুও এ সাবজেক্টে এ+ পেয়েছি।

এ সাবজেক্ট পড়ে যা শিখলাম মুসলমানদের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে সেটাকে যদি মিলানোর চেষ্টা করি তাহলে দেখি-

-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী হাদিসবিদগণের এত ত্যাগ-কুরবানী, আলোচনা, পর্যালোচনা-বিচার-বিশ্লেষণ, হাজার হাজার পৃষ্ঠা গ্রন্থ রচনা ইত্যাদির মাধ্যমে সহিহ হাদিস ও বানোয়াট হাদিস আলাদা করে রেখে গেছেন। অধিকাংশ হাদিসের মান (সহিহ, হাসান, যয়িফ) আমাদের জন্য চিহ্নিত করে গেছেন। কিন্তু এর পরেও আপনি এমন কিছু মুসলমান পাবেন যারা এসব জ্ঞানের ছিটেফোটা খবরও রাখেন না। কিন্তু জোর গলায় বলবেন- হাদিস মানি না; কুরআনই যথেষ্ট।

-কাফের ও ফাসেক মিডিয়া মুসলমানদের মধ্যে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে তামশা দেখে। ঘটনা বা সংবাদকে রঙ মেখে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। আমরা যদি কুরআনের নির্দেশ মেনে কাফের ও ফাসেকের সংবাদ বা তথ্যকে শুরুতেই যাচাই-বাছাই এর তালিকায় রাখতাম তাহলে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত হতাম।

-কোন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দোষ বা গুণ উল্লেখ করার ক্ষেত্রে আমরা প্রায়শঃ ন্যায়ভ্রষ্ট হই। অথচ আমাদের পূর্বসুরি হাদিসবেত্তা সমালোচকগণ আল্লাহর দ্বীনের ক্ষেত্রে কারো সাথে খাতির বা বিদ্বেষ রাখেননি। সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলেন সুক্ষ্ম ও ন্যায়বান। উদাহরণতঃ সমালোচক ‘আলী ইবনে মাদিনি’ তাঁর নিজ পিতাকে হাদিস বর্ণনায় দুর্বল আখ্যায়িত করেছেন।

-সংবাদবাহকের দোষ-গুণের এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ মুসলিম হাদিসবিশারদগণ ছাড়া বিশ্বের আর কোন ধর্মাবলম্বী বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আছে মর্মে জানা যায় না।

বিষয়: বিবিধ

১৯৯০ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

300063
১০ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৮:৪৩
মোতাহারুল ইসলাম লিখেছেন : অনেক কিছু জানলাম। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
১০ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৯:০৯
242863
মুহাম্মদ নূরুল্লাহ তারীফ লিখেছেন : পড়ার জন্য আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
300067
১০ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১০:২১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
এই বিষয়টি আমাদের দেশের অনেক আলিম ও গুরুত্ব দেননা।
১২ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৪:১৬
243012
মুহাম্মদ নূরুল্লাহ তারীফ লিখেছেন : পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
300107
১১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৪:৫৬
পিপীলিকা লিখেছেন : ধন্যবাদ Thumbs Up
১২ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৪:১৭
243013
মুহাম্মদ নূরুল্লাহ তারীফ লিখেছেন : পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
345072
০৮ অক্টোবর ২০১৫ রাত ০৯:২৯
দ্য স্লেভ লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ খায়রান ভাই,অনেক কিছু জানলাম

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File