আমার পাইলস অপারেশন ও কিছু অভিজ্ঞতা...
লিখেছেন লিখেছেন দিল মোহাম্মদ মামুন ০২ এপ্রিল, ২০১৭, ০৩:৪৮:০৫ দুপুর
১৫ই জানুয়ারি দেশ থেকে আসার পর ১৫/২০ দিন মোটামুটি ভালো ছিলাম, তারপর শুরু হলো অবিরত রক্তক্ষরণ। প্রতিবার টয়লেটে যাওয়া মানেই ১০০মি.লি করে ফ্রেস ব্লাড অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া। টয়লেটের পুরো কমোড ব্লাডে টকটকে লাল হয়ে যেত। অনেক ওষুধ খেয়েছি, কিছুতেই কাজ হয়না, যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। সারাদিন ব্যাথা করতো, ঝাল জাতিয় কিছু খেলে অবস্থা যেন আরোও বেগতিক হয়ে যেত। এতটাই ব্যস্ততার মধ্যে দিনগুলো যাচ্ছিলো, হসপিটালে যাওয়ার মত সময় বের করাটাও মুশকিল।
১৩ই মার্চ একান্ত বাধ্য হয়েই আবুধাবি ইউনিভার্সাল হসপিটালে গেলাম। হসপিটালটি যেমন অত্যাধুনিক তেমনি ডাঃ ও সেবার মানও খুব ভালো। বিকাল তিনটায় ইন্ডিয়ান জেনারেল সার্জেন ডাঃ রজনী কান্তের শরণাপন্ন হলাম। ডাক্তার আমার সব কথা মনযোগ দিয়ে শুনার পর নার্সকে নির্দেশ দিলেন আমাকে পাশের কক্ষে নিয়ে শোয়ানোর জন্য। নার্সের সাথে সাথে কক্ষে প্রবেশের পর নার্স আমাকে প্যান্ট খুলে বেডে শুইতে বললেন। আমি তাই করলাম, নাছোড়বান্দি নার্স এবার আমাকে শর্টপ্যান্টও খুলতে বললেন। স্বাভাবিকভাবে ইতস্তত বোধ করলাম, কিন্তু উপায় নেই! ২২/২৩ বছর বয়সী সুন্দরি নার্সের কথায় আমাকে তাও করতে হলো! এ যেন ইজ্জতের উপর চরম আঘাত! আমার ইজ্জতের তোয়াক্কা না করে নার্স হাসিমুখে তার পেশাগত দায়িত্বপালন করতে লাগলো। ইতোমধ্যে ডাঃ এসে অনেক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন। তারপর অনেকটা হতাশ হয়ে আমাকে বললেন, আপনি এখন ডেঞ্জারাস পজিশনে আছেন, দ্রুত অপারেশন না করলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা শতভাগ!!! কি আর করা! অপারেশনে রাজী হয়ে গেলাম। ৮টি টেস্ট করতে বললেন এবং ২ দিনের ওষুধ দিয়ে বলনেন, অপারেশনের ডেইট ফোনে জানানো হবে। অপারেশনের ৮ঘন্টা পুর্ব থেকে খানাপিনা সব বন্ধ রাখতে হবে। টেস্টের জন্য রক্ত আর মল দিয়ে আসলাম। দুইদিন পর আমাকে হসপিটাল থেকে ফোনে জানানো হলো ১৬ই মার্চ বিকাল ৪টায় আমার অপারেশন, দুইঘন্টা পূর্বে আমাকে হসপিটালে পৌঁছতে হবে।
যথাসময়ে হসপিটালে উপস্থিত হলাম, প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য জিজ্ঞেস করে আমাকে পেপারে স্বাক্ষর করতে বলা হলো। তারপর আমাকে সিটে ভর্তি করানো হলো, ড্রেস চেঞ্জ করা হলো, একটা ইনজেকশন দেওয়া হলো, কিছুক্ষণ পর টয়লেটে গিয়ে ফাইনালি পাকস্থলী পরিষ্কার করতে বলা হলো যদিও ৮ঘণ্টা খানাপিনা বন্ধ থাকায় পাকস্থলী পরিষ্কারই ছিল! বিকাল চারটায় আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো। জেনারেল সার্জেন ডাঃ রজনী কান্তের নেতৃত্বে ৪ জন নার্স ও ৩ জন ডাক্তার আমার অপারেশনের জন্য প্রস্তুত। ৭ জনের এই দলের সামনে আমি আবারো বেইজ্জতি হতে যাচ্ছি ভেবে খারাপ লাগলো! আমার ইচ্ছায় তো আর হচ্ছেনা! আল্লাহ ভরসা...
মেরুদন্ডের শেষপ্রান্তে কোমর বরাবর তিনটা ইনজেকশন দেওয়া হলো। এই ইনজেকশন গুলো আমাকে এতটাই যন্ত্রণা দিয়েছে যা প্রকাশ করার মত ভাষা জানা নেই। অপারেশনের পজিশনে আমাকে রাখা হলো, ২ মিনিটের মধ্যেই কোমর থেকে নিচের অংশ সম্পূর্ণ সেন্সলেছ হয়ে গেলো! অপারেশন টিম তাদের কাজ শুরু করলো, আমি প্রথম থেকে মহান আল্লাহকে স্মরণ করে আসতেছি, কিন্তু এবার একটু শব্দ করেই পবিত্র কোরানের মুখস্থকৃত সূরা গুলো তিলাওয়াত করতে লাগলাম। কৌতূহলবসত শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার শরীরের নিচের অংশকে নাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, এই মুহূর্তে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার কোন কমান্ড মানতেছেনা! সাথে সাথে মনে পড়ে গেলো সূরা ইয়াছিনের ৬৫ নং আয়াতের কথা- "আজ আমি এদের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছি, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে এরা দুনিয়ায় কি উপার্জন করে এসেছে" এ যেন পবিত্র আয়াতের বাস্তব প্রমাণ পেয়ে গেলাম! চোখের পানি অবিরত বের হচ্ছে, তখন আল্লাহর কাছে বার বার বলেছি, হে আল্লাহ, হে পরওয়ারদেগার, সেই কঠিন মুহূর্তে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষি বানাইওনা।
প্রায় ৪০মিনিট পর ডাঃ রজনী কান্ত হাসিমুখে আমাকে বললেন, "অপারেশন সাকসেসফুল" প্রতি উত্তরে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ্। জানিনা আমার প্রতি উত্তরটা অমুসলিম ডাঃ কিভাবে নিয়েছেন! তারপর অপারেশন থিয়েটার থেকে আমাকে কেবিনে নিয়ে আসা হলো। ফিলিপিনো নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম আমার নিম্ন অঙ্গের সেন্স আসতে কতক্ষণ লাগবে? সে বললো প্রায় চার ঘণ্টা, একটা রিমোট দিয়ে বললো, যখনই কোন কিছুর প্রয়োজন হবে, এই বাটনে চাপ দিলেই আমি তৎক্ষণাৎ হাজির হবো। নির্দিষ্ট সময় পর পর আমি সেলাইন ও ইনজেকশন দিয়ে যাবো। তারপর wifi password দিয়ে আমাকে বললো, ইউ ক্যান এনজয়। অত্যাধুনিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কেবিনে আমি একা পড়ে আছি, এতটাই ক্লান্তি অনুভব করতেছিলাম যে ৫/৭ মিনিটের মধ্যেই ঘুম চলে আসলো। প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা পর আমার ঘুম ভাঙ্গলো। মনে হচ্ছে নিম্নাঙ্গে সেন্স ফিরে আসতেছে, আমার পাগুলো একটু একটু নড়াচড়া করতে পারতেছি। বিকাল তিনটা থেকে একের পর এক সেলাইন চলতেছে, নিম্নাঙ্গ সেন্সলেছ থাকার কারণে এতক্ষন প্রস্রাবের প্রচণ্ড চাপ অনুভব না করলেও এখন মনে হলো প্রস্রাবের চাপের কারণেই ঘুম ভেঙ্গে গেল!
রিমোটে চাপ দেওয়ার সাথে সাথে নার্স প্রস্রাব করার একটা পাত্র নিয়ে উপস্থিত হলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার প্রস্রাবের চাপ এসেছে সেটা জানলে কি করে? হাসি মুখে উত্তর দিলো, সেন্স আসার পর প্রস্রাবের চাপ আসবে এটা স্বাভাবিক। টয়লেটে গিয়ে প্রস্রাব করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম, কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল অনুভব করলাম যে, দাঁড়ানোর শক্তিও পেলাম না। তাই বেডে বসেই করতে হলো।
আমার দ্বীনি ভাইয়েরা শারীরিক অবস্থা ও হসপিটালে আমার অবস্থান জানার জন্য বার বার ফোন দিচ্ছিলেন। তাই আমার শারীরিক অবস্থা ও অবস্থান জানিয়ে ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম। এবার সবাই এক গ্রুপের পর অন্যগ্রুপ এসে এসে দেখা করলেন। আলহামদুলিল্লাহ্ সবাইকে কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগলো, আমি যে অপারেশনের রুগী, সেটা ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম। কুয়েতে সরকারী হসপিটালে কর্মরত ডাঃ গনী আহমেদ (আমার বাবার বন্ধু) বার বার ইমোতে কল দিয়ে আমার শারীরিক খোঁজখবর নিলেন, উপদেশ ও সাহস দিলেন। উনার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ।
পরের দিন দুপুর ২টায় ডাঃ রজনী কান্ত এসে পরীক্ষানিরীক্ষার পর আমার শারীরিক অবস্থা কেমন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, প্রচন্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও ঠিকমতো প্রস্রাব হচ্ছেনা, আর অন্যকোন সমস্যা অনুভব করতেছিনা, আলহামদুলিল্লাহ আমি সুস্থবোধ করতেছি। ডাঃ বললেন, যতক্ষণ ব্যাথা থাকবে, ততক্ষণ প্রস্রাবে সমস্যা হবে, কমপক্ষে ১৫ দিন যাবতীয় শক্ত ও মসলা জাতীয় খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। ৫ দিনের জন্য মেডিসিন দিয়ে বিকেল ৩টায় হসপিটাল থেকে আমাকে রিলিজ দেওয়া হলো। বাসায় আসার ৩০ মিনিট পর থেকে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো। একদিকে হসপিটালে দেওয়া পেইনকিলার ইনজেকশনের মেয়াদ শেষ অন্য দিকে রাতের খাবারের পর প্রদত্ত ওষুধ খেতে হবে! কিন্তু এই লম্বা সময়টা কিভাবে পার করবো? দাঁড়ালেও ভালো লাগেনা, বসলেও ভালো লাগেনা, শুয়ে থাকলেও ভালো লাগেনা। ভয়ংকর অসহ্য যন্ত্রণা! চিৎকার করে কান্নাও করতে পারতেছিনা, আবার সহ্যও করতে পারতেছিনা। আমার শারীরিক অবস্থা জানার জন্য মোবাইলে একের পর এক কল আসতেছে, কিন্তু রিসিভ করার মত মানসিকতা নাই। ভাবলাম, রাতের ওষুধটা এখন খেয়ে নিলে হয়তো এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো। খাওয়ার কোন ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কেবল ওষুধ খাওয়ার জন্য owts ও কিছু ফল খেলাম। ওষুধ খাওয়ার প্রায় ১ ঘন্টা পর ব্যাথা কমতে শুরু করলো। বাড়ি থেকে বার বার মেসেজ দিচ্ছে, কল করার পর আমার মা শুধু কান্নাই করলেন, যেন আমার বড় কোন বিপদ হয়ে গেছে! স্ত্রীর সাথে কথা বললাম, তার ও একই অবস্থা, কান্নার জন্য কথাই বলতে পারেনা! অথচ আমার চোখে পানি নাই। এ যেন ডাইরেক্ট কানেকশন! ব্যাথা এখানে আর কান্না ওখানে!! শুধু দোয়া করতে বললাম। রাতটা ও পরের দিনটা কিছুটা ব্যাথার মধ্যেই কাটলো। পরের দিন রাত ১১টার দিকে হঠাৎ টয়লেটের চাপ অনুভব করলাম, পায়খানা একটু শক্ত টাইপের ছিল। টয়লেট থেকে বের হওয়ার পর পরই প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো, যদিও ১ঘন্টা পূর্বে ওষুধ খেয়েছিলাম। সারারাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাতে পারলাম না।
কল্পনা করতে লাগলাম, আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম, তখন মাকে কত কষ্ট দিয়েছি। হয়তো মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যাবার পর মা আর বাকিরাত ঘুমাতে পারেননি। আহারে মা জননী! কথাগুলো ভেবে চোখ দুটো বার বার অশ্রুসিক্ত হলো। ফজরের নামাযের পর ঘুম আসলো।
সিলেটের কৃতি সন্তান জনাব মুদ্দাছির ভাইয়ের কথা না বললেই নয়। তিনি সারারাত ডিউটি করেও ক্লান্ত শরীর নিয়ে সকালে আমার জন্য ডাক্তারের সাজেশন অনুযায়ী খাবার রান্না করতেন। একটু সহযোগিতাও করতে দিতেন না, উনার জন্য মন থেকেই দোয়া এসে যায়।
আলহামদুলিল্লাহ্, ৭ দিন পর থেকে আমি পুরোপুরি সুস্থবোধ করতেছি। দ্বীনি ভাইদের আন্তরিকতা আমি কখনো ভুলবোনা।
বিষয়: বিবিধ
২০৪৯ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহ।
জাজাকাল্লাহ।
জাযাকাল্লাহ খায়ের
খাবারের মধ্যে শাক সবজি বেশী বেশী খাবেন এবং পানি খেতে অবহেলা করবেন না।
শিক্ষনিয় লেখায়ার জনন্য অনেক ধন্যবাদ।
মরহুম গোলাম আজম সাহেবের রক্ত আমাশয় হয়েছিল ৫০এর দশকে, তাহার জীবনিতে পড়েছি পায়খানার রাস্তা দিয়ে স্যালাইনের মাধ্যমে মেড়ীসিন ড়ুকিয়ে জিবানু ধংস করা হয়েছিল। খাওয়ার ঔষদ মল ঘরে পোছেনা তাই। চিকিৎসা করেছিল বিখ্যাত প্রপেসর নুরুল ইসলাম সাহেব।
জাযাকাল্লাহ খায়ের।
মন্তব্য করতে লগইন করুন