কি লাভ এত কষ্ট করে রোজা রেখে, যদি রোজার উদ্দেশ্যই না বুঝলেন!
লিখেছেন লিখেছেন দিল মোহাম্মদ মামুন ০৮ জুন, ২০১৬, ০১:৫২:০৮ দুপুর
রোজা শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরজ করা হয়নি, পূর্ববর্তী সব নবীর উম্মতদের উপরও রোজা ফরজ ছিল। কিন্তু কেন? রোজার মধ্যে এমন কি জিনিষ লুকায়িত আছে যা হাছিল করার জন্য প্রত্যেক নবীর উম্মতদের উপর রোজা ফরজ করা হলো? এর মূল উদ্দেশ্যই বা কি? আমরাতো প্রতি বছরই রোজা রাখি কিন্তু সেই জিনিষটি কি হাছিল করতে পেরেছি? আমি একটা উদাহরণের সাহায্যে সেই জিনিষটিকে পুরোপুরিভাবে চিনতে পেরেছি। সেটি হলো, যেকোনো কাজের পেছনে দুইটি জিনিষ থাকে - ১) উদ্দেশ্য, ২) উদ্দেশ্য হাছিলের জন্য গৃহীত পন্থা। যেমন ভাত বা রুটি খাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেঁচে থাকা ও দৈহিক শক্তি অর্জন করা। আর খাওয়ার কাজ সম্পন্ন করার জন্য চারটি পন্থা অবলম্বন করতে হয় - ১) খাবার প্রস্তুত করা ২) খাবার গুলোকে মুখে দেওয়া ৩) মুখের মধ্যে চিবানো ৪) এবং খাবার গুলোকে পাকস্থলীতে প্রেরণ করা। কিন্তু খাওয়ার জন্য এই চারটি পন্থা অবলম্বন করা হলেও এর আসল জিনিষ হচ্ছে উদ্দেশ্য হাছিল করা। এখন কেউ যদি ভাত বা রুটির পরিবর্তে মাটি বা ছাই খায় তাহলে তার খাওয়ার উদ্দেশ্য মোটেও হাছিল হবেনা, যদিও সে খাওয়ার চারটি পন্থা যথাযথ ভাবেই পালন করে।
আবার কেউ যদি ভাত বা রুটি খাওয়ার সাথে সাথেই বমি করে ফেলে এবং উদ্দেশ্য হাছিলের আশাকরে তাহলে সে হবে বড় নির্বোধ। কারণ ভাত বা রুটি যতক্ষণ পর্যন্ত পেটে গিয়ে হজম না হবে এবং রক্তে পরিণত হয়ে সারাদেহে ছড়িয়ে না পরবে ততক্ষণ পর্যন্ত খাওয়ার উদ্দেশ্য তথা বেঁচে থাকার জন্য জীবনীশক্তি অর্জন করা কিছুতেই সম্ভব হবেনা। যদিও এখানে খাওয়ার জন্য চারটি পন্থা অবলম্বন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু খাবার যদি সঠিক না হয় তাহলে উদ্দেশ্য অর্জনের আশা করাটা হবে চরম বোকামি। কারণ খাওয়ার জন্য উল্লেখিত চারটি পন্থার মধ্যে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাদুকরী কিছু নেই।
মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলেন, "হে ঈমানদারগন, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমনি তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর ও ফরজ করা হয়েছিল, সম্ভবত তোমরা তাকওয়াবান তথা পরহেজগার হবে।" এই আয়াত অনুসারে রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন বা পরহেজগারিতা অর্জন করা। উপরে বর্ণিত ভাত বা রুটি খাওয়ার উদাহরণটা একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে খুব সহজে আমরা আমাদের রোজাগুলো নিষ্ফল হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারি।
বর্তমানে বেশিরভাগ মুসলিম রোজার আরকান( আভ্যন্তরীণ জরুরী কাজ) এবং বাহ্যিক অনুষ্ঠানকেই আসল ইবাদত মনে করে চরম ভুল করে থাকে। কারণ এগুলো হচ্ছে খানা খাওয়ার উল্লেখিত চারটি পন্থার মতই! মুলত এই কারণেই বেশিরভাগ মুসলিম রোজা রাখা অবস্থায় মিথ্যা বলতে পারে, গীবত করতে পারে, কথায় কথায় ঝগড়া করতে পারে, গালিগালাজ করতে পারে, অশ্লীল সিনেমা দেখতে পারে, অন্যের হক নষ্ট করতে পারে, এমনকি আপন মায়ের সাথে জেনার সমতুল্য সুদী লেনদেনেও জড়িত থাকতে পারে!! এই সমস্ত রোজাদারেরা হচ্ছে ঠিক তাদের মতই, যারা বালি বা ছাই খেয়েই খাওয়ার কাজ পরিপূর্ণ হয়েছে মনে করে এবং উদ্দেশ্য হাসিলের আশাও করে!
বর্তমানে বেশিরভাগ মুসলিম রোযার মূল উদ্দেশ্য বুঝেনা বলেই তারা শুধুমাত্র সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খানা, পানকরা এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নামকেই রোজা বলে মনে করে। তারা রোজাকে এতবেশি সম্মা করে, প্রাণ নাশের আশংকা দেখা দিলেও রোজা ভঙ্গ করতে নারাজ। শুধুমাত্র রোজার আসল উদ্দেশ্য না বুঝার কারণেই সুদীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পরও শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথেই কিছু মুসলিম চাঁদ রাত উদযাপনে নেমে যায়! অথচ সহি হাদিছ দ্বারা প্রমাণিত ঐরাতটা ইবাদতের রাত, দোয়া কবুলের রাত। শুধুমাত্র রোজার উদ্দেশ্য না বুঝার কারণেই তারা নাচ-গান, ব্যভিচার, মদ-জুয়া এবং হিন্দুদের মত মেলা উৎসবে মেতে উঠে। বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারের মহিলারা ঈদ উপলক্ষে ইসলামবিরোধী অপসংস্কৃতিতে ভরপুর টিভি চ্যানেল গুলোর ১০ দিন ব্যাপী নোংরামি দেখতে গিয়ে ফরজ নামাজ টা পর্যন্ত ছেড়ে দেয়! এ যেন খাওয়ার সাথে সাথেই বমি করে পেলা!
যেমনি ভাত বা রুটি হতে ততক্ষণ পর্যন্ত শারীরিক শক্তি লাভ করা যাবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হবে এবং রক্তে পরিণত হয়ে শরীরের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হবে। ঠিক তেমনি রোজা দ্বারাও কোন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করা যেতে পারেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত রোজাদার রোযার আসল উদ্দেশ্য ভালোভাবে বুঝতে না পারবে এবং তার মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে তা অঙ্কিত না হবে, চিন্তা-কল্পনা, ইচ্ছা ও কর্ম সবকিছুর উপর তা একেবারে প্রভাবশীল হয়ে না যাবে।
যে ব্যক্তি রোজার উদ্দেশ্য জানতে ও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবেন, তিনি কমবেশি মোত্তাকি তথা পরহেজগার ঠিকই হবেন। কিন্তু যে রোজার উদ্দেশ্যই জানবেনা এবং তা হাছিলের চেষ্টাও করবেনা, তার কপালে ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড় কিছুই জুটবেনা।
আবু হুরায়রা(রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল(সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যাবলা এবং সেই মোতাবেক কাজ করা থেকে বিরত থাকেনা সে তার খানাপিনা ছেড়ে দিক, এতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।(বুখারী)
যারা রোজার মূল উদ্দেশ্য বুঝে সেই অনুযায়ী আমল করে, তাদের সম্পর্কে প্রিয় রাসূল(সঃ) সুসংবাদ দিয়েছেন।
আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল(সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের তাগিদে এবং সওয়াব লাভের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে রোজা রাখে তার পূর্বেকার গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।(বুখারী ও মুসলিম)
একজন রোজাদার বেশি পরিমাণে নেক কাজ করা উচিত এবং প্রত্যেকটি ভালোকাজে অংশগ্রহণ করা উচিত। রোজাদার ব্যক্তি নিজে পিপাসাযুক্ত ও ক্ষুধার্ত হবার কারণে তার চারপাশে অবস্থানরত গরীবদের ক্ষুধার যন্ত্রণা ভালোভাবেই বুঝতে পারে। এই বরকতময় রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসে আমরা আমাদের সামর্থ্যানুযায়ী আমাদের অভাবী আত্মীয়স্বজন ও আশেপাশে বসবাসরত গরীব দুঃখী, এতিম মিসকিনদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি, তাদের সাথে নিয়ে ইফতার করতে পারি।
হযরত জায়েদ বিন খালেদ জুহান্নী(রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার সমান সওয়াবের অধিকারী হবে, কিন্তু তাতে রোজাদারের সওয়াব কিছুমাত্র হ্রাস পাবেনা।
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ তুমি আমাদের সবাইকে রোজার মূল উদ্দেশ্য বুঝে সবগুলো রোজা যথাযথভাবে পালন করে এই পবিত্র ও বরকতময় মাস থেকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের পাশাপাশি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করিও। আমিন।
বিষয়: বিবিধ
২৪০৩ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপু আমিতো শুধু ততটুকুই চেস্টা করেছি, মহান আল্লাহ আমাকে যতটুকু সুযোগ দিয়েছেন। ধন্যবাদ আপনাকে
সুন্দর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক এই কামনা।
জাজাকাল্লাহ
কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহ।
অনে.....ক দিন পর আমার ব্লগ বাড়িতে আসার জন্য আপনাকে আন্তরিক মোবারকবাদ।
ছুম্মা আমিন। সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
মনে মনে অনেক প্রশ্ন এলেও করার সুযোগ ছিল না, কারণ আমিও যে তাদের একজন দর্শক।
ভালো লাগলো আপনার লিখাটি। শুকরিয়া।
আর এখন তো সব গুলো টিভি চ্যানেল যেন এক একটা বেহায়াপনার আডডাখানা! এখনো আপনি দেখবেন, সামনে ঈদ আসতেছে ঐটাকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে টিভি মেরামতের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এরা রোজাও রাখতেছে, আবার অশ্লীল সিনেমাও দেখতেছে, এদের রোজা রেখে কি লাভ আমি বুঝিনা।
ধন্যবাদ আপনাকে
তাকওয়া অর্জনের চেয়ে লক্ষ্য থাকে বেশি সওয়াবের দিকে, তাই এমন বলদ মার্কা ছেরাবেরা অবস্থা।
এক শ্রেণী ধরেই নেয়, রোজায় পাপ করা যাবেনা, তবে অন্য সময় করা যায়। তাই অনেক পাপ থেকে বিরত থেকেও বাকি এগারো মাসে তার অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি হয়না। দুঃখ জনক!
লেখাটি কিন্তু চমৎকার হয়েছে। বিবিকে পড়ে শোনালে খুশিতে আটখানা হবে।
জাযাকাল্লাহু খাইর
আমার চেয়েও তিনি আরোও বেশি ইসলামী চিন্তাবীদ। ধন্যবাদ আপনাকে, জাজাকাল্লাহ খাইর।
না রাখার চেয়ে রাখাটাই উত্তম যদিও এর উদ্দেশ্য অর্জন না হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় রোজা রাখতে রাখতে এর উদ্দেশ্য পূরণের কাছাকাছিও চলে যায় অনেক মানুষ।
রোজার পরিপূর্ণ হক আদায় করে আমাদের রোজা রাখার তওফীক দান করেন। আমীন।
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
(উপরের কমেন্টটা ডিলিট করে দিবেন। শেষ না হতেই অসতর্কতা বশত প্রেস হয়ে গেছে। জাযাকাল্লাহ!!
মূলত রোজার উদ্দেশ্য না বুঝার কারনেই আজ রোজা মুসলিম জীবনের কোন পরিবরতন আনতে পারতেছেনা, ধন্যবাদ আপনাকে। জাজাকাল্লাহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন