পূর্ববর্তী ধর্মমতে রামাদান
লিখেছেন লিখেছেন দিল মোহাম্মদ মামুন ০২ জুন, ২০১৬, ০৭:০৭:৪৯ সন্ধ্যা
আসসালামু আলাইকুম, সবাইকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমি সহ আমাদের সকল মুসলিম ভাই-বোনদেরকে পবিত্র রমজান মাসের রোজাগুলো যথাযথভাবে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার সাথে পালনের মাধ্যমে এই পবিত্র মাসের রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত হাসিল করার তৌফিক দান করেন।
সন্মানীত পাঠকমন্ডলী, মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলেন-"হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো" এই আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের ওপরও রোজার বিধান ছিল। মূলত রোজা পালনে পদ্ধতিগত ভিন্নতা থাকলেও মৌলিক রোজার বিধান পূর্ববর্তী সব জামানার সব নবীর শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। পূর্ববর্তী বলতে হজরত আদম (আ) থেকে আরম্ভ করে হজরত ঈসা (আ) পর্যন্ত সময়কালকে বোঝায়। তবে সময়ের ব্যবধানে রোজা পালনে পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর রোজার বিধান থাকলেও রোজার সংখ্যা কোন নবীর উম্মতের জন্য কতটি ছিল, তার সঠিক হিসেব অনেকগুলো ইসলামিক সাহিত্যে খুজেও পাইনি।তবে পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের ওপর রোজার বিধান কেমন ছিল এই বিষয়ে যতটুকু পেয়েছি তা আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
হজরত আদম (আ) নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের পর যখন আল্লাহ তাঁকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেন, তখন তিনি দীর্ঘ ৪০ দিন পর্যন্ত কোনো পানাহার করেননি এবং ৩০০ বছর পর্যন্ত লজ্জায় মাথা ওপরের দিকে তোলেননি- বিভিন্ন তাফসিরকারকের বিবরণ থেকে এমনটি জানা যায়। তবে হজরত আদম (আ) যে ৪০ দিন পানাহার বন্ধ করেছিলেন, সে দিনগুলো রোজার উদ্দেশ্যে ছিল কিনা সে বিষয়টি জানা যায়নি। তবে হজরত আদম (আ)-এর রোজা সম্পর্কে হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ), হজরত জিরর ইবনে হুবাইশের বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন, 'নিষিদ্ধ গাছের ফল খাবার পর হজরত আদম (আ)-এর রং কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করলে হজরত আদম (আ) আল্লাহর আদেশে চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে অর্থাৎ আইয়ামে বিজের রোজা রাখলে তাঁর শরীরের রং আবার পূর্ববৎ উজ্জ্বল হয়ে যায়।' আলোচ্য হাদিসটির কোনো বর্ণনা সূত্র খুঁজে পাওয়া না গেলেও রাসুলুল্লাহ (সা) নিজে আইয়ামে বিজের রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদের এ দিনগুলোয় রোজা রাখতে উৎসাহ দিতেন। এ বিষয়টি হজরত আবু জার, আবু হুরায়রাসহ বেশ কয়েকজন সাহাবি থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি, 'হজরত নূহ (আ) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন বাদ দিয়ে সারা বছর রোজা রাখতেন।' (ইবনে মাজাহ)। তাফসিরে ইবনে কাসিরের বর্ণনায় জানা যায়, হজরত নূহ (আ)-এর সময়কাল থেকে প্রতি মাসে তিনটি করে রোজার প্রচলন ছিল। তবে সেগুলো ফরজ ছিল কি না তা জানা যায়নি।
হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সময়েও বছরে এক মাস রোজা ফরজ ছিল বলে কেউ কেউ দাবি করে থাকেন। তবে এ দাবির পক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
হজরত মুসা (আ)-এর রোজা সম্পর্কে বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা জানতে পারি, হজরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা) মদিনা আগমনের পর দেখতে পেলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখছে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দিনটির মাহাত্ম্য কি যে তোমরা রোজা রাখছো? তারা বলল, 'এটি একটি মহৎ দিন। এ দিনে আল্লাহ মুসা (আ)-কে ও তাঁর কওমকে মুক্তি দিয়েছিলেন আর ফেরাউন ও তার দলবলকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই মুসা (আ) আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ এ দিনে রোজা রেখেছিলেন। আমরা তাই মুসার অনুকরণে এ দিনে রোজা পালন করি।' তখন রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, 'আমরাই তোমাদের চেয়ে হজরত মুসাকে অনুকরণ করার বেশি হকদার।' এরপর তিনি নিজে এই দিনে রোজা রাখেন এবং সাহাবিদেরও রোজা রাখার আদেশ দেন (বুখারি ও মুসলিম)।
হজরত দাউদ (আ)-এর রোজা 'সওমে দাউদ' নামে বিশেষভাবে খ্যাত। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, 'নফল রোজার মধ্যে সওমে দাউদের চেয়ে উত্তম আর হতে পারে না। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন আর এক দিন রোজা রাখা থেকে বিরত থাকতেন। এভাবে তিনি বছরের অর্ধেক সময় রোজা রাখতেন।' (বুখারি, মুসলিম, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, তিরমিজি)।
হজরত ঈসা (আ)-এর সময়ে রোজার বিষয়টি পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত ঈসা (আ)-এর জন্মের ঘটনা বর্ণনায় পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, অতঃপর তিনি (মারইয়াম) গর্ভবতী হলেন এবং তা নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেলেন। প্রসব বেদনা তাঁকে এক খেজুর বৃক্ষমূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তিনি বললেন, 'হায়, আমি যদি এর আগে মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে একেবারে মুছে যেতাম!' অতঃপর ফেরেশতা তাঁকে নিম্নদিক থেকে আওয়াজ দিয়ে বললেন, 'তুমি দুঃখ করো না। তোমার রব তোমার জন্য নিচের দিকে একটা নহর জারি করেছেন। আর তুমি খেজুর গাছের কাণ্ডকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার জন্য সুপক্ব খেজুর পতিত হবে। অতঃপর তুমি খাও, পান করো এবং চক্ষু শীতল করো। আর যদি তুমি মানুষের মধ্য থেকে কাউকে দেখতে পাও, তাহলে বলে দিও, আমি দয়াময় আল্লাহর উদ্দেশে রোজা মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলব না।' (সুরা মারইয়াম : ২২-২৬ আয়াত)।
পরিশেষে বলতে পারি, পূর্ববর্তী সব নবীর যুগেই রোজার বিধান ছিল, পূর্ববর্তী জামানায় রোজার বিধান থাকলেও পদ্ধতিগত কিছুটা ভিন্নতা ছিল। পূর্ববর্তীকালে রোজার বিধান ছিল খুবই কষ্টকর। যেমন- হজরত মারইয়ামের ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, তখন রোজা রাখার জন্য খাদ্য, পানীয় ও যৌনতা থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ দিন কথা বলা থেকেও বিরত থাকতে হতো।
রমজান মাসের ৩০ দিন রোজা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য মহান আল্লাহর একটা বড় উপহার। পূর্ববর্তী জামানায় রোজার বিধান থাকলেও মহিমান্বিত মাহে রমজান কোনো উম্মতেরই ভাগ্যে জোটেনি, এই দিক থেকে আমরা পরম সৌভাগ্যবান। উল্লেখ্য, এই রমজানেই বড় বড় সব আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছিল। হযরত ইবরাহীম (আ) এর সহীফাসমূহ রমজান মাসের ১ম রাত্রিতে নাযিল হয়েছিল, তাওরাত কিতাব রমজানের ৬ তারিখ দিবাগত রাত্রে নাযিল হয়েছিল, ইনজিল কিতাব এই রমজানের ১৩ তারিখে নাযিল হয়েছিল এবং মানবজাতীর জীবন বিধান শ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব পবিত্র কোরান মাজিদ রমজানের ২৪ তারিখ নাযিল হয়েছিল।
তাই আসুন, মহান আসমানী কিতাব সমূহ নাযিলের মাসে আমরা রোজা রাখার পাশাপাশি আমাদের প্রিয় নবীর শ্রেষ্ঠ মোজেজা ও সমগ্র মানবজাতির মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল কোরানকে বেশি বেশি তিলাওয়াত ও অধ্যায়ন করি এবং কোরান দিয়ে আমাদের জীবন গঠন করি। ওয়া-মা তৌফিকী ইল্লা বিল্লাহ।
বিষয়: বিবিধ
২২২৯ বার পঠিত, ৪৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাযাকাল্লাহ, রাব্বুল আলামীন সবাইকে মাহে রমাদানের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা এবং সঠিকভাবে সিয়াম পালনের তৌফিক দিন। আমিন।
মামুন ভাই, পোস্টটি ডাবল পোস্ট হয়েছে, এডিট করে দিন।
অতিরিক্ত টা ডিলেট করে দিয়েছি
পোষ্ট এবং আপনার সুন্দর লিখাটির বিষয়ে পরে বলছি। তার পূর্বে আপনার একটু দ্বিধা দূর করতে চাই। তা হল আপনি যা করেছেন সেটাই ঠিক। সবাই স্বীয় নির্ধারিত লিখা কিংবা তার বাহিরেও লিখা পোষ্ট করতে পারবেন। আর এই লিখাগুলোকে পরবর্তীতে একটি পোষ্টে একত্রিত করবেন গাজী ভাই। লিঙ্কের মাধ্যমে। যা গাজী ভাই ওনার লিখায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন। বিশেষ কিছু জানার থাকলে বলতে পারেন। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো উত্তর দিতে। ইনশাআল্লাহ।
জাযাকাল্লাহ।
বানু আপা বানু আপা
অনেক সুন্দর লিখাটির জন্য অনিঃশেষ ধন্যবাদ ও মাহে রামাদ্বানের শুভেচ্ছা। ভাবীকে অনুরূপ।
তবে একটি বিষয়: হযরত নূহ আঃ এর যুগে তো দুই ঈদ ছিল না। দুই ঈদ তো শুধু মুসলমানদেরজন্য।
সে যুগে হয়তো অন্য কোন ঈদ ছিল। আপনার পাওয়া বিষয়টি নিয়ে তেমন একটি আলোচনা প্রচলিত নেই বিধায় এ বিষয়ে দলিল প্রমাণ পেশ করা দূরহ। তবুও আপনার চেষ্টা দেখে অনেক অনেক শুকরিয়া জানাই। জাযাকাল্লাহ খাইর
পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর রোযা ফরজ ছিল- ইতিহাস ঘেঁটে এর দলিল পাওয়া দুষ্কর বলেই হয়তো আল্লাহতায়ালা দলিল পেশ করে সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়েছেন!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
গুছিয়ে সুন্দর একটি লিখা উপহার দেয়ার জন্য শুকরিয়া, জাযাকাল্লাহ খাইর।
একটা আনকমন জিনিস চাপিয়ে দিলাম শোকাহত যুবকের উপর।
আপনার অনেক কিছু জানা হলো, আর তা থেকে জাতীও উপকৃত হলো।
আমি অনেক কিছুই জানতে পেরেছি এখান থেকে।
আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম জাযা দিন।
আসলে যখন কোন দায়িত্ব এসে যায় তখন সেটা নিয়ে টেনশন করাই লাগে। আলহামদুলিল্লাহ্ আমিও অনেক কিছু জানলাম। সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
امين يارب
অনেক দিন পর ব্লগে ঢুকে লিখাটা দেখে, অজানা কিছু বিষয় জানলাম।
জাঝাক আল্লাহ খাইরান।
কথায় আছে, আতরওয়ালা র পাশে বসে থাকলে ও লাভ,
ধন্যবাদ আপনাকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন