হাদিসের আলোকে মরহুম মতিউর রহমান নিজামী পুত্রের জুতা পায়ে জানাজার সালাত আদায় করা বৈধ।
লিখেছেন লিখেছেন দিল মোহাম্মদ মামুন ১২ মে, ২০১৬, ০৭:১৮:৩০ সন্ধ্যা
ফেসবুকে কিছু লোক ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন এর জুতা পরে পিতার জানাজার নামাজ পড়ানো নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন শুধুমাত্র একজন ব্যারিস্টারই নন, তিনি মাদ্রাসা পড়ূয়া একজন মাওলানা। তাই যারা তার এ কাজের নিন্দা করে ফেবুতে পোস্ট লিখেছেন তাদের এবং সবার উদ্দ্যেশে এই লিখা।
রাসুল (সাঃ) জুতা পরে সালাত আদায় করেছেনঃ
দলীল-১
আবু মাসলামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আনাস ইবন মালিক (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী (সাঃ) কি তাঁর জুতা পরে সালাত আদায় করতেন? তিনি বললেন, হাঁ’’ (বুখারী ৩৮৬, ৫৮৫০; মুসলিম ৫৫৫; তিরমিযি ৪০০; নাসায়ী ৭৭৫; মুসনাদ আহমাদ ৪০১)
দলীল-২
আমর ইবন শুয়াইব (রাঃ) হতে পর্যায়ক্রমে তাঁর পিতা ও দাদার সুত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে কখনো খালি পায়ে আবার কখনো জুতা পরে সালাত আদায় করতে দেখেছি’’ (আবু দাউদ ৬৫৩; ইবন মাযাহ ১০৩৮; মুসনাদ আহমাদ ৩৯৯)
দলীল-৩
ইবন আবু আওস তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ ‘’আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-কে তাঁর জুতাজোড়া পরিহিত অবস্থায় সালাত আদায় করতে দেখেছি’’ (ইবন মাযাহ ১০৩৭; মুসনাদ আহমাদ ৪০৭)
দলীল-৪
আবুদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসুল (সাঃ)-কে জুতা পরিহিত অবস্থায় এবং মোজা পরিহিত অবস্থায় সালাত আদায় করতে দেখেছি’’ (ইবন মাযাহ ১০৩৯)
দলীল-৫
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বসে ও দাঁড়িয়ে, জুতা পায়ে ও খালি পায়ে নামাজ পড়েছেন’’ (মুসনাদ আহমাদ ৪০২ )
দলীল-৬
আবু ‘আলা ইবন সিখইয়ির থেকে বর্ণিত। তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ ‘’আমি রাসুল (সাঃ)-কে জুতাজোড়া পরে নামাজ পড়তে দেখেছি’’(মুসনাদ আহমাদ ৪০৩)
দলীল-৭
আবু আওবয়ার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি জুতা পরে লোকদেরকে নামাজ পড়তে নিষেধ করছেন? তিনি বললেনঃ না, আমি রাসুল (সাঃ)-কে এ স্থানে জুতা পরে নামাজ পড়তে এবং জুতা পরে স্থান ত্যাগ করতে দেখেছি’’ (মুসনাদ আহমাদ ৪০৪ )
দলীল-৮
মুজাম্মা ইবন ইয়াকুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি কুবার এক গোলাম থেকে বর্ণনা করেন। সে একজন বৃদ্ধ লোকের সাক্ষাৎ পেল। তিনি বলেন রাসুল (সাঃ) আমাদের কাছে কুবায় আসলেন, তখন এক বাড়ির আঙ্গিনায় বসলেন। তাঁর চারপাশে কিছু লোকেরা একত্রিত হল। তখন রাসুল (সাঃ) পানি পান করতে চাইলেন, পান করার সময় আমি তাঁর ডান পাশে বসা ছিলাম। লোকদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট। তখন তিনি আমাকে পানি পান করতে দিলেন, আমি পান করলাম। আমার স্মরণ আছে, তিনি আমাদের নিয়ে সে দিন জুতা পরে নামাজ পড়েছিলেন, তা খুলেন নি’’ (মুসনাদ আহমাদ ৪০৫)
দলীল-৯
অন্য আরেকটি বর্ণনায় আছে। তিনি মুহাম্মাদ ইবন ইসমাইল ইবন মুজাম্মা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আবী হাবিবাকে বলা হল, আপনি রাসুল (সাঃ) থেকে কি শিখেছেন? রাসুল (সাঃ) যখন (কুবায়) আসেন তখন তিনি ছিলেন ছোট বালক। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) একদিন আমাদের মসজিদে (অর্থাৎ কুবা মসজিদে) আসেন। তখন আমরা সেখানে গমন করি এবং তাঁর পাশে বসি। লোকেরাও তাঁর পাশে বসেন। অতঃপর তিনি নামাজ পড়তে দাঁড়ান। তখন আমি তাকে জুতা পরিহিত অবস্থায় নামাজ পড়তে দেখি’’ (মুসনাদ আহমাদ ৪০৫)
দলীল-১০
আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুল (সাঃ)-কে মোজা ও জুতা পরে নামাজ পড়তে দেখেছি’’ (মুসনাদ আহমাদ ৪০৬)
জুতায় নাপাকি লেগে না থাকলে জুতা পরে সলাত আদায় বৈধঃ
আবু সাইদ আল-খুদরী (রাঃ) সুত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে সলাত আদায়কালে তাঁর জুতাজোড়া খুলে তাঁর বাম পাশে রেখে দিলেন। এ দৃশ্য দেখে লোকেরাও তাঁদের জুতা খুলে রাখল। রাসুল (সাঃ) সালাত শেষে বললেনঃ ‘’জিবরীল (আঃ) আমার কাছে এসে আমাকে জানালেন, আপনার জুতাজোড়ায় অপবিত্র বস্তু লেগে আছে।
তিনি আরও বললেন, তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সে যেন জমিনে তা ঘসে নিয়ে পরিধান করে সালাত আদায় করে’’ (আবু দাউদ ৬৫০; মুসনাদ আহমাদ ৪৬, ৪০০; দারিমী ১৩৭৮; ইবন খুজাইমাহ (২/৪৩১)
জুতায় অপবিত্রতা লেগে থাকলে তা দূর করার পদ্বতিঃ
জুতায় লেগে থাকা নাপাকি মাটিতে ঘসে নিয়ে পরিচ্ছন্ন করা যাবে, পানি ব্যবহার করা শর্ত নয়।
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’তোমাদের কারো জুতার তলায় আবর্জনা লেগে গেলে, মাটিই তার আবর্জনা বা অপবিত্রতা দূর করার জন্য যথেষ্ট’’ (আবু দাউদ ৩৮৫; হাকিম ১/১৬৬), বায়হাকি, সুনানুল কুবরা ২/৪৩০)
আবু সাইদ আল-খুদরী (রাঃ) সুত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সে যেন জমিনে তা ঘসে নিয়ে পরিধান করে সালাত আদায় করে’’
(আবু দাউদ ৬৫০; মুসনাদ আহমাদ ৪৬, ৪০০; বুলুগুল মারাম ২১৮; দারিমী ১৩৭৮; ইবন খুজাইমাহ (২/৪৩১)
উল্লেখ্য হানাফি মাজহাব মতেও কোন বস্তুর নাপাকি দূর করার জন্য পানির ব্যাবহার বাধ্যতামূলক নয়, বরং অন্যান্য বস্তুর দ্বারাও তা হতে পারে। আল ফিকহুল ইসলামী ও আদিল্লাতুহু ১/৯২-১০৭
জুতা পরে সালাত আদায় করা ও ইয়াহুদিদের বিরোধিতা করাঃ
রাসুল (সাঃ) কখনো জুতা পরে সালাত আদায়ের উপর তাগিদ দিয়েছেন। ইয়াহুদী- খ্রিষ্টানদের রীতি হল, পবিত্র স্থানে জুতা বা স্যান্ডেল খুলে খালি পায়ে গমন করা। জুতা পায়ে পবিত্র স্থানে বা ইবাদতের স্থানে প্রবেশ করাকে তারা সেই স্থানের পবিত্রতা নষ্ট করা বলে গণ্য করে। রাসুল (সাঃ) তাদের এই রীতির বিরোধিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ই’য়ালা ইবন শাদ্দাদ ইবন আওস (রাঃ) থেকে তাঁর পিতার সুত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ ‘’তোমরা ইয়াহুদীদের বিরোধিতা করো। তারা জুতা এবং মোজা পরে সালাত আদায় করে না’’( আবু দাউদ ৬৫২ )
সাধারন পাঠকের মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে,-
আমরা তো জুতা বা স্যান্ডেল খুলেই সালাত আদায় করি! এতে কি ইয়াহুদী-নাসারাদের অনুকরন হচ্ছে?
উত্তরঃ আমাদের জুতা খোলা ও তাদের জুতা খোলার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমরা জুতা খুলি পরিছন্নতার জন্য আর তারা জুতা খুলে পবিত্রতার জন্য। জুতা পরিচ্ছন্ন থাকলে একজন মুসলিম জুতা পরে সালাত আদায় করতে পারেন ও মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন। কিন্তু ইয়াহুদী-নাসারা জুতা খোলাকে ইবাদতের অংশ ও ইবাদত গৃহের জন্য অসম্মানজনক বলে মনে করে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে পাদুকা পায়ে মসজিদে প্রবেশ করলে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট হয় না, তবে পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হতে পারে। আর ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে জুতা-স্যান্ডেল যতই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হোক, তা পায়ে ইবাদতগাহ, চার্চ বা কোনো ধর্মীয়ভাবে পবিত্র স্থানে প্রবেশ করলে সে স্থানের ধর্মীয় পবিত্রতা নষ্ট হবে।
আমাদের প্রচলিত সমাজে অনেকের মধ্যেই ইয়াহুদী-নাসারাদের মতো অনুভুতি বিদ্যমান। সম্ভবত ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় রীতির অনুকরনেই মানুষেরা তথাকথিত ‘শহীদ মিনার’, ‘স্মৃতিস্থম্ভ’ ইত্যাদিতে জুতা খুলে প্রবেশের রীতি প্রচলন করেছে''
(রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর পোশাক ও পোশাকের ইসলামী বিধান, পৃষ্ঠা নঃ ১৬৮-১৬৯)
উপরে বর্ণিত আলোচনা থেকে নিম্নলিখিত বিধানগুলো পাওয়া যায়ঃ
১- জুতা খুলে রেখে সালাত আদায় করা বৈধ।
২- মোজা পরে সালাত আদায় করা বৈধ।
৩- জুতা ও মোজা উভয়টা পরে সালাত আদায় করা বৈধ।
৪- খালি পায়ে সালাত আদায় করা বৈধ।
৫- জুতা পরে সালাত আদায়ের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে তাতে যেন কোন নাপাকি লেগে না থাকে।
বিষয়: বিবিধ
৩৮৮৬ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আজকে জুমার নামায শেষে আপনাকে অনেক খুজেছিলাম, দুর্ভাগ্য আপনার নাম্বারটা মোবাইল ফরম্যাট করাতে হারিয়ে পেলছি।
আর নজীব মো'মেন একজন আলিম।
কি জানি ভাই
মেয়েদের তো জানাজার নামাজের অনুমতি নাই,
তাই মাথা ও ঘামানো হয় নি,
তবে জুতা পায়ে দিয়ে নামাজ পড়া যায় এটা
আগে ই জানতাম,।
জাঝাক আল্লাহ খাইরান,
ধন্যবাদ আপনাকে।
তাহলে মক্কা মদিনাতে হজের সময় আমরা যে জুতা খুলে মাসজিদে ঢুকে জুতা তাকে রেখে নামাজ পড়েছি সেটা না করলেও পারতাম ? মক্কা-মদিনাবাসীরা কি এটা আমাদের ধরিয়ে দিতে পারতোনা যে জুতা পড়েও নামাজ পড়া যায় ? রাসূল(সাঃ) তো উনাদের শহরেরই লোক ছিলেন !
রাসূল (সঃ) কখনো কখনো জুতাপায়ে নামায পড়েছেন কিন্তু বেশিভাগ সময় জুতা খুলেই নামায পড়েছেন। কারণ রাসূল(স) যদি সবসময় জুতা পায়ে নামায পড়তেন তাহলে সেটা উম্মতের জন্য ওয়াজিব হয়ে যেত। এখানে হাদিসগুলো একত্রিত করে প্রকাশের মাধ্যমে মুলত আমি এটাই বুঝাতে চেয়েছি যে, জুতা লাগিয়ে নামাজ পড়া নাজায়েজ নয়। ধন্যবাদ আপনাকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন