একজন খোনকার ও এক প্রবাসী পরিবারের কিছু কথা...
লিখেছেন লিখেছেন দিল মোহাম্মদ মামুন ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ০১:৩২:৩৯ দুপুর
আমি ১৪ই জানুয়ারি ২০১০ ইং কম্পিউটার গ্রাফিক্স ডিজাইনারের ভিসা নিয়ে আবুধাবিতে আসি। ভিসা, পাসপোর্ট ও এয়ারলাইন্সের টিকেট বাবদ সর্বমোট ৩ লক্ষ টাকা খরচ হয় যার পুরোটাই ছিল ফসলি জমি বন্ধক ও স্বজনদের কাছ থেকে ধার করা টাকা। ঘরে ছিলেন অসুস্থ বাবা-মা, স্কুলে অধ্যায়নত ছোট ভাই-বোন। এডভারটাইজিং কোম্পানীতে যোগদানের পর থেকে প্রথম তিনমাস চুক্তি মোতাবেক বেতন পেয়ে যাই তারপর প্রথম এক বছর কখনো ৭০০ আবার কখনো ১০০০ দিরহাম করে পেয়েছিলাম, যদিও আমার সাথে চুক্তি হয়েছিল ৩০০০ দিরহাম! আমি নিয়োগ কর্তার সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ২০১১ সালের মে মাস থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত কোম্পানীর অফিসে যাইনি। এই সময়ের মধ্যে আমি আবুধাবিতে টিউশনি করে যা পেতাম, নিজের কোনরকম খরচের টাকাটা রেখে বাকি টাকা দেশে পাঠিয়ে দিতাম কারন আমার পরিবারের আর কোন ইনকাম সোর্স ছিলনা। আবুধাবি শহরে বসবাসের জন্য সাধারণত একজন শ্রমিকের প্রতিমাসে ৮০০-১০০০ দিরহাম প্রয়োজন। কিন্তু আমি আমার খরচের জন্য যে পরিমান টাকা রাখতাম তা দিয়ে পুরোমাস চলতে অনেক কষ্ট হয়ে যেত। বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবা ও অধ্যায়নরত ছোট ভাই-বোনের কথা চিন্তা করে এই কষ্টকে পাত্তাই দিতাম না। ঐ সময় আত্মিয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও প্রতিবেশিদের কাছ থেকে যে ধরনের আচরণ পেয়েছিলাম তা কখনো ভুলবার নয়। হাজারো কষ্ট বুকে চেপে রেখে মুখে একজন সুখি মানুষের অভিনয় করতাম আর গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাযে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিতাম। এইভাবেই আমি ২০১২ সালের ১৪ই জুলাই পর্যন্ত কাটিয়েছি।
২০১২ সালের ১৫ই জুলাই আমার বর্তমান কোম্পানীতে যোগদানের মধ্য দিয়েই আমার জীবনের মোড পরিবর্তন হয়। আলহামদুলিল্লাহ্, মহান আল্লাহর দরবারে আমি যা কিছু চেয়েছি এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আমি পেয়েছি।
২০১১ সালের প্রথমদিকে আমার খালাম্মা (আম্মুর ছোট বোন) আমাদের বাড়িতে আসলেন, আমাদের পারিবারিক অবস্থা দেখে উনি খুব বিচলিত হলেন কারন তখন পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তিনি আম্মুকে মিরস্বরাইয়ের সবচেয়ে নামকরা খোনকারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আম্মু খোনকারের কাছে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি নিজেই গেলেন, বিশেষ করে শুধু আমার অবস্থা জানার জন্য! খোনকারকে কান্নাজড়িত কন্ঠে আমার বিস্তারিত বললেন, পারিবারিক কিছু কথাও বললেন। খোনকার একটা কিতাব নিয়ে গভীরভাবে দেখলো, তারপর অনেক্ষন গভীর ধ্যানমগ্ন থেকে বড় আফসোসের সাথে বললো, "ছেলেটার মা-বাবা কতকষ্ট করতেছে অথচ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি পরিবার নিয়ে ছেলেটার বিন্দুমাত্র ও চিন্তা নাই! মাস শেষে ঠিকমতোই বেতন পাচ্ছে, বেতনের পুরা টাকাটাই মদ, জুয়া আর হোটেলে আড্ডাবাজীতে খরচ করতেছে!! এই ধরনের ছেলেদের জন্য বড় আফসোস! বড় আফসোস!!" আমার খালাম্মার কান্না আরোও বেড়ে গেল, কান্নাজড়িত কন্ঠে খালাম্মা অনেক অনুনয় বিনয় করে বললেন, হুজুর আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এই ছেলেটার জন্য কিছু একটা করুন। এবার হুজুর একটু নড়েচড়ে বসলেন, নরম সুরে বললেন ঘাবড়ানোর কোন কারন নাই, মানুষের খেদমতেই আমি নিবেদিত! আমি দুইটা তাবিজ দিব, যে কোনভাবে তাবিজ গুলো ছেলেটার কাছে পোঁছাতে হবে। একটা তাবিজ বামহাতে লাগাবে অন্যটা কোমরে লাগাবে, ইনশাআল্লাহ তাবিজ গুলো লাগানোর পর এক সপ্তাহের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে। তাবিজগুলো বানাতে ৫টা আইটেম লাগবে, ঘাবড়ানোর কোন কারন নাই আইটেম গুলোর ব্যবস্থা কষ্ট করে হলেও আমি নিজেই করবো! সর্বমোট হাদিয়া লাগবে দুইহাজার দুইটাকা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হুজুরের সাথে দেখা করবেন বলে খালাম্মা আম্মুর কাছে ফিরে আসলেন।
আম্মু খালাম্মার কাছ থেকে খোনকারের সব কথা মনোযোগ দিয়েই শুনলেন, খুব আশ্চর্য ও হলেন। খালাম্মাকে বললেন, আমার ছেলেকে কখনো সিগারেট হাতে নিতেও দেখিনি অথচ খোনকার বলতেছে মদ খায়! কখনো নামাজ ছাড়তে দেখিনি অথচ খোনকার বলতেছে হোটেলে যায়, বুজ হওয়ার পর থেকেই আমি তাকে দেখেছি নিজের কথা চিন্তা না করে ছোট ভাই-বোন ও মা-বাবার কথা চিন্তা করতে অথচ খোনকার বলতেছে পরিবার নিয়ে তার কোন চিন্তাই নাই!! আমার ছেলে প্রতি সপ্তাহে ২/৩ বার করে আমার সাথে কথা বলে, আমার ছেলের উপর আমার আস্থা আছে। তুই খোনকারের কথা শুনে আমাকে ভুল বুঝাইসনা, আমার কোন তাবিজের দরকার নাই, আমি পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে আমার ছেলের জন্য দোয়া করতেছি। গত ১৪.০১.২০১৬ তারিখে আমি আম্মুকে বলেছিলাম, আম্মু আজ আমার প্রবাস জীবনের ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে, তখন আম্মু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বললেন।
সন্মানীত পাঠকমণ্ডলী, এটা কোন বানোয়াট কাহিনী নয়, এটা আমার পরিবারে ঘটে যাওয়া কাহিনী। কথাগুলো শুনার পর আমি সাথে সাথেই আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম, আমার আম্মু যদি খোনকারের কথাগুলো বিশ্বাস করতেন তাহলে আমার পুরা পরিবার একটা জাহান্নামেই পরিনত হতো। জানিনা কত হাজার প্রবাসী ভাইদের পরিবারকে এই ভন্ড খোনকারেরা জাহান্নাম বানিয়েছে, এগুলো ভাবতেও আমার খুব খুব কষ্ট হয়।
কয়েকমাস আগে এক প্রবাসী আত্মহত্যা করার আগে চিরকুটে লিখেছিলেন "মাস দুয়েক আগে আমার ভিসা নিয়ে সমস্যা হয়েছিল, দুইমাস ধরে বাড়িতে কোন টাকা পাঠাতে পারিনি, বেতনের পুরা টাকাটাই ভিসাগত ঝামেলা মিটাতে খরচ হয়ে গিয়েছিল। পরিবারের সবাই ভেবেছিল আমি টাকাটা বৌ এর একাউন্টে পাঠাচ্ছি, তাই বাড়িতে ফোন করলেই সবাই আমার সাথে উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করলো, লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে দিত, শেষ পনেরো দিন মা ও আমার সাথে কথা বলেনি। আমার বৌ ভেবেছিল টাকাটা আমি বাজে পথে খরচ করতেছি তাই আমার সাথে ফোনে ঝগড়া করে বাপের বাড়িতে চলে গেল। আমার কষ্টটা আমি আমার গর্ভধারিনী মা এবং বৌ কাউকে বুঝাতে পারিনি। আমার লাশটা দেশে পাঠাবেন না, এখানেই দাপনের ব্যবস্থা করবেন।" কাতার প্রবাসী লোকটার বাড়ি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সন্মানীত পাঠকমণ্ডলী আপনারা জানেন কি, একজন প্রবাসী কতটুকু কষ্ট বুকে চেপে রেখে দিনাতিপাত করেন! শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যদের সুখে রাখার জন্য তিল তিল করে নিজের জীবনের মূল্যবান সময়টুকু নিঃশেষ করে দিচ্ছেন! প্লিজ প্রবাসীদেরকে টাকার মেশিন ভাববেন না, তাদের উপর বেশি দাবি বা আবদার করবেন না, আপনাদের দাবি পুরন করতে গিয়ে একজন প্রবাসী কতটুকু মানসিক টেনশনে থাকে তা অন্য প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বুজবেনা। প্রবাসীরা আপনাকে যা দেন তা খুশি মনেই নিন, তাদের কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করুন। ভন্ড মোল্লা-খোনকারদের কথা বিশ্বাস করে প্রবাসীদের উপর জুলুম করবেননা, তাহলে মহান আল্লাহও আপনাদের ক্ষমা করবেন না।
বিষয়: বিবিধ
২৭৪৮ বার পঠিত, ৩৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
প্রবাসিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় মনে হয় এই বিয়ে আর পরিবার আর বউ নিয়ে টানাটানি। কারোরই একটু ত্যাগ এর মানসিকতা নাই। সিঙ্গাপুরে এক ভাই এর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। দেশে এসে জানলাম তার পাঠান বিপুল অংকের টাকা তার পিতা-মাতাই নষ্ট করেছেন। এর মধ্যে তার বোন-জামাইদেরও নির্ভর করে দিয়েছেন তার পাঠান টাকার উপর!
এই জন্যই বললাম প্রবাসীর দুঃখ অপর প্রবাসী ছাড়া আর কেউ বুঝেনা।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া
আলহামদুলিল্লাহ্ ,
আপনাদের পরিবার নিরাপদ ,
আমার লাশটা দেশে পাঠাবেন না, এখানেই দাপনের ব্যবস্থা করবেন , কতটা আঘাত পেলে মানুষ এই ধরনের কথা লিখতে পারে
পরিবারের লোকদের সুখি করার জন্য যারা নিজের জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়, ঐ পরিবারের লোকেরাই যদি ভুল বুঝে এর চেয়ে নির্মম আর কি হতে পারে???
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার পোষ্ট এর জন্য ধন্যবাদ ।
আলহামদুলিল্লাহ! নাজুক পরিস্হিতিতে হলেও আমার পরিবার থেকে কখনও এমন শুনতে হয়নি! তাদের থেকে শান্তনা ও উৎসাহই পেয়ে আসছি!
'বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তোমার,তা পুরণ হয়েছে এটাই যথেষ্ট!আর বেশী চাই ন.আলহামদুলিল্লাহ' মুহতারাম আম্মা সব সময়ই বলেন এই কথাটা!
অনুপ্রেরণা আর প্রশান্তির উৎস মা! মহান করুণাময় রব সকল মাকে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন,আমিন!
আপনার লিখায় প্রবাসীদের একান্ত কষ্টের বিষয়গুলো অতি মর্মস্পর্শী ভাবে ফুটে উঠেছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে আপনজনদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা আসলেই অবিবেচনাপ্রসূত।
বাস্তবতার নিরিখে চমৎকার লিখনির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আসলে আমাদের পরিবারগুলো ভাঙ্গার মূলে রয়েছে কিছু কুচক্রি প্রতিবেশী ও কিছু ধোকাবাজ মানুষ নামে হায়েনা, যারা নিজেদের স্বার্থের টানে অন্যকে ধুলিষ্যাৎ করতে এতটুকুও চিন্তা করে না।
এসব খোনকার আর তা'বীজ ব্যাপারিদের ব্যবসা মোটামুটি শেষের পথে। এখনকার মানুষ আগের মত এত অধম নয়। তবে বিপদে পড়লে মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। ঈমানের দূর্বলতার কারণে শয়তানের পিছু পিছু চলতে শুরু করে।
আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য অনেক অনেক শুকরিয়া। ভালো থাকুন সমসময়। সুখী হোন নতুন জীবনে এটাই প্রত্যাশা।
জাযাকাল্লাহ খাইর
আমার আম্মু যদি ঐ ভন্ড খোনকারের কথা বিশ্বাস করতেন, জানিনা তখন আমার পরিবারের অবস্থা কেমন হতো। তবে আমি দেশে আসলে এই খোনকারের সাথে দেখা করবো। কারন তার জন্য কিছু বিশেষ তাবিজ আমি রেডি করতেছি।
আপনার সুন্দর সাবলীল বিশ্লেষণ মুলক মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনারা যদি নিয়মিত ব্লগে না আসেন, তাহলে মজা পাইনা
আপনার লিখায় প্রবাসীদের একান্ত কষ্টের বিষয়গুলো অতি মর্মস্পর্শী ভাবে ফুটে উঠেছে। প্রবাসীদের কাছ থেকে আপনজনদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা আসলেই অবিবেচনাপ্রসূত।
বাস্তবতার নিরিখে চমৎকার লিখনির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর। সহমত
>>>>>>>>>>-লু'লু
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন