মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট ও আবুধাবি পুলিশের হেফাজতে আমার ছয় ঘন্টার অভিজ্ঞতা।
লিখেছেন লিখেছেন দিল মোহাম্মদ মামুন ০৮ আগস্ট, ২০১৫, ০৪:৫৮:১৬ বিকাল
অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি থাকাতে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ৩০ মিনিট পর দুপুরের খাবারের জন্য অফিস থেকে রুমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। অফিস আর রুমের দুরুত্ব ২ কিলোমিটার। পার্কিং এরিয়াতে ১৫০মিটার পথ অতিক্রম করার পর মেইন রোড়ে উঠার আগ মুহুর্ত্বে দেখলাম একটা চাইনিজ মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। আমি মোটরসাইকেল কে স্লো করে তাদেরকে রাস্তা পার হওয়ার সুযোগ দিলাম। কিন্তু তারা রাস্তা পার না হয়ে ২ কদম পিছনে গিয়েই দাঁড়িয়ে গেল, আমি ভাবলাম তারা আমাকে আগে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাই আমি আবার ড্রাইভিং শুরু করতেই হঠাৎ মেয়েটা রাস্তা পার হওয়ার জন্য দৌড় দিল। মনে মনে ভাবলাম আবুধাবি শহরে হাজার হাজার অত্যাধুনিক গাড়ি পড়ে রইলো, মরার জন্য তুই ঐগুলোর একটা ও চোখে দেখলিনা, আমার মত নিরীহ লোকের মটরসাইকেলটাই তুই দেখলি!!
জোরে ধাক্কা খেয়ে মেয়েটা রাস্তার উপর পড়ে গেল, আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। মোটরসাইকেল রাস্তার মাঝখানে পড়ে রইলো, মাথার হেলমেট টা খুলে পাশে রেখে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলাম। তার পোশাক এতটাই ছোট ও পাতলা ছিল যা উলঙ্গিনীই বলা যায়। তার চাইনিজ বয়ফ্রেন্ড তাকে উঠানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে তার পক্ষে উঠানো সম্ভব হচ্ছিল না। মেয়েটার মাথা, পায়ের উপরের অংশ ও হাতের কনুই থেকে অবিরত রক্ত ঝরতে লাগলো। আমি দৃষ্টিকে সংযত রেখে তাকে উঠানোর কাজে তার বয়ফ্রেন্ড কে সহযোগীতা করলাম। উত্তপ্ত (দুপুর ২টায় ৪৮ডিগ্রী সেলসিয়াস) রাস্তা থেকে পাশের বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিয়ে বসিয়ে টেক্সি খুজতেই সাথে সাথে পেয়ে গেলাম। ওদেরকে টেক্সিতে বসিয়ে যখন আমি মাঝরাস্তা থেকে আমার মোটরসাইকেল উঠাতে গেলাম, তখন ২/৩ জন লোক আমাকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল। কারন এখানে এক্সিডেন্ট হলে সাথে সাথে ঐ অবস্থায় পুলিশ কে ফোন করতে হয়। যেহেতু আমি পুলিশকে ফোন না করেই তাদেরকে টেক্সিতে উঠিয়ে দিয়েছি, এই জন্য পুলিশ আমাকে সার্চ করতে পারে শাস্তি বাড়িয়ে দিতে পারে, এই ধারনা থেকেই মুলত তারা আমাকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে পালিয়ে যেতে বাঁধা দিল, ড্রাইভিং করলে এক্সিডেন্ট হবে এটাই স্বাভাবিক, আমি জানি আবুধাবি পুলিশ ১০০% ইনসাফ করতে পারে, আমিতো কোন অপরাধ করিনি, তাহলে পালিয়ে যাবো কেন?
মোটরসাইকেল নিয়ে টেক্সির সাথে আমিও শেখ খলিফা মেডিকেলে চলে গেলাম। এই হাসপাতালের ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্টে ২৪ ঘন্টা পুলিশ থাকে জেনেও আমি টেক্সি থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে মেয়েটা কে ঐখানেই নিয়ে গেলাম। মনে মনে পড়তে লাগলাম "তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা-হাওলা ওয়ালা ক্যুয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ। ইয়্যা কানা--বুদু, ওয়াইয়্যা কানাছতা--য়ি--ন"। পুলিশ আমাদের দেখা মাত্রই এগিয়ে আসলো, নিজেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, সাথে আমিও গেলাম। মেয়েটিকে সিটে ভর্তি করানোর পর আমাকে ও মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড কে পুলিশ ঘটনা জিজ্ঞেস করলো,এক্সিডেন্ট যেইভাবে হয়েছে, ঐ রকমই বললাম। জিজ্ঞেস করলো আমি পুলিশকে ফোন করেছিলাম কিনা, আমি না-সূচক জবাব দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলাম। তখন পুলিশ অফিসারটা আমাকে বললেন, 'পুলিশকে ফোন করা তোমার উচিত ছিল, তাহলে পুলিশই তাকে এম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসতো, তবুও তোমাকে ধন্যবাদ।'
পুলিশ আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স, আমার আইডি কার্ড এবং গাড়ির লাইসেন্স নিয়ে নিল, তারপর ওয়েটিংরুমে বসতে বললো। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পর ও কেউ কিছু বলতেছেনা, কিন্তু পেট বার বার সিগনাল দিচ্ছে তার খাবারের প্রয়োজন, কারন লাঞ্চটাইম শেষ হয়ে গেছে। পুলিশের কাছে গিয়ে আমার পেটের দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরলাম। সাথে সাথেই পুলিশ আমার জন্য ১টা চিকেন ভার্গার ও একটা ফ্রেশ ককটেল জুসের অর্ডার করলো। খানা শেষে আবার ১৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর একজন নতুন পুলিশ অফিসার এসে পুলিশের গাড়িতে করে আমাকে সেই এক্সিডেন্ট স্পটে নিয়ে গেল। এক্সিডেন্টের সময় আমার পজিশন কোথায় ছিল, মেয়েটার পজিশন কোথায় ছিল বিস্তারিত জিজ্ঞেস করে স্পটের কয়েকটা ছবি তুললেন।
তারপর আমাকে গাড়িতে বসতে বললেন, ভাবলাম হয়তো আবার হাসপাতালে নিয়ে গিয়েই ছেড়ে দিবে। কিন্তু না, এবার আমাকে আবুধাবি সিটির বাহিরে অবস্থিত এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে নিয়ে গেলেন, একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। মনে মনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম, যদিও আমার ইন্ডিয়ান ম্যানেজার, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী ও ফিলিপাইনি কলিগেরা বার বার ফোন করে আমার খোঁজ-খবর নিচ্ছে। মনের মধ্যে নানান দুশ্চিন্তা উঁকিঝুঁকি করতে লাগলো, না জানি কি হয়!!
সিনিয়র ব্লগার নজরুল ইসলাম টিপু ভাইকে ফোন করে বিস্তারিত বললাম, উনি আমাকে খুব সাহস দিলেন, ভয় কিছুটা দুর হলো( উনি একমাস যাবত অসুস্থ, একা চলাফেরা করতে পারেন না, সবাই উনার জন্য দোয়া করবেন)। আর কোন ভাইকে না জানাতে উনাকে অনুরোধ করলাম, অযথা সবাইকে টেনশন দিয়ে লাভ কি!
ঘড়ির কাঁটায় ছয়টা পার হয়ে গেছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেছে, আমার পেট ও তার খাবারের দাবিতে অটল। বাদ্য হয়েই পুলিশ অফিসার কে পেটের দাবির কথা জানালাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আশে-পাশে আমার কোন বন্ধু আছে কিনা, তারপর উনি চলে গেলেন। সাথে সাথেই মনে পড়লো আমার ঢাকাইয়া বন্ধু হুমায়ুনের কথা। তাকে ফোন করলাম, আমার সব কথা শুনে সে খুব অস্থির হয়ে উঠলো,আসতেছি বলে ফোন রেখে দিল। দশমিনিট পর পুলিশ অফিসার একটা ব্যাগ এনে আমাকে দিলেন, বললেন খেয়ে নিতে। ব্যাগের মধ্যে একটা সেন্ডউইছ, ৪ টা চিপস এবং ২টা চকবার ছিল, মনের অজান্তে মুখ থেকে বের হয়ে গেলো, জাজাকুমুল্লাহ খাইরান, উনি মুছকি হেসে বললেন শুকরান। খাওয়ার পর আবার বসে রইলাম, কিছুক্ষন পর মাগরিবের আজানের মধুর সুর মসজিদ থেকে ভেসে আসলো। দুইজন পুলিশ অফিসার ছাড়া বাকি সবাই মসজিদে চলে গেল। পুলিশ অফিসারের ইমামতিতে পাশের একটা কক্ষে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলাম। নামাযের পর পরই বন্ধু হুমায়ুন থানাতে আসলেন, আমার জন্য এতবেশি পরিমান খাবার নিয়ে আসলেন যেন উনি হাসপাতালে রুগী দেখতে এসেছেন!! পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম আর কতক্ষন এখানে বসে থাকতে হবে? উনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, বসে থাকতে আমার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা! আমি না-সূচক জবাব দেওয়ার পর উনি শুধুই বসে থাকতে বললেন।
রাত ৮ টায় হঠাৎ একজন পুলিশের সাথে সেই চায়না মেয়েটি ও তার বয়ফ্রেন্ড কক্ষে প্রবেশ করলো। আমি এগিয়ে গিয়ে তার শারিরীক অবস্থার খোঁজ-খবর নিলাম, সে তার অবস্থা ভাল বললো যদিও তার হাত, পা ও মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো ছিল। তারপর পুলিশ অফিসার দুইজনকে একসাথে তাঁর সামনে বসতে বললেন। মেয়েটাকে তার শারিরীক অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ আছে কিনা, মামলা করবে কিনা জিজ্ঞেস করলেন। মেয়েটি বললো, তার কোন অভিযোগ নাই এবং কোন প্রকার মামলাও সে যেতে চায়না। তখন পুলিশ অফিসার তাকে জেব্রা ক্রসিং দেখে রাস্তা পার হওয়ায় পরামর্শ দিলেন এবং একটা পেপারে সাক্ষর নিয়ে নিলেন। আমার কাছ থেকে কোন পেপারে সাক্ষর নিলেন না, কোন জরিমানা ও করলেন না, আমাকে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির লাইসেন্স ও আইডি কার্ড ফেরত দিয়ে বললেন, তুমি যেতে পারো। পুলিশ অফিসার কে সালাম দিয়ে চলে এলাম।
আরব-আমিরাতের পুলিশের উপর মানুষ ১০০% আস্থা রাখতে পারে বলেই এক্সিডেন্ট ছাড়াও যে কোন সমস্যার সমাধানে মানুষ পুলিশকে ফোন করে। যারা ইসলামকে নিজের ব্যক্তিজীবনে মেনে চলেন, তারাই পারেন শতভাগ ইনসাফ করতে। ধন্যবাদ আবুধাবি পুলিশ, আপনারাই পেরেছেন মানুষের বন্ধু হতে, মানুষের আন্তরিক ভালবাসা আদায় করতে।
বিষয়: বিবিধ
২৬৪০ বার পঠিত, ৪১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আরব-আমিরাত পুলিশের মাঝে যে ন্যায়পরায়নতা দেখেছি, তার ১০% যদি আমাদের দেশের পুলিশের মাঝে থাকতো, তাহলে বাংলাদেশের চেহারা অন্য রকম হতো। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
আরব-আমিরাত পুলিশের মাঝে যে ন্যায়পরায়নতা দেখেছি, তার ১০% যদি আমাদের দেশের পুলিশের মাঝে থাকতো, তাহলে বাংলাদেশের চেহারা অন্য রকম হতো। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এই ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে!! কমপক্ষে ১০০০০ টাকা খাইত পুলিশ।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
টিপু ভাইকে সালাম দিবেন। তার জন্য দুয়া রইল যেন আল্লাহ্ তাকে দ্রুত সুস্থ্য করে দেন।
ঠিক আছে টিপু ভাইকে সালাম দিব। সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
যাই হোক ব্লগের কল্যানে জানলাম। লাঠিপেটা খাওয়ার জায়গায় সেন্ডুয়েজ, চিকেন, বার্গার কত খাবারই না খেলেন। ইস! ভবিস্যতে আমি না হয় ইচ্ছে করে এমন করবো ভাবছি।
বাহ! চমৎকার, কি খাবার, কি মেহমানদারী।
আসলে ভাই আল্লাহ ভীতি থাকলে তার থেকে দুনিয়ার কোন প্রাণীই কষ্ট পায় না, আবুধাবীতে আমার কয়েকজন পুুলিশ বন্ধু আছে, সত্যিই মানুষের মত মানুষ। যেন আপন কেউ।
সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
জাযাকাল্লাহ খাইর
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ।
সৎ মানুষদের আল্লাহ্ এইভাবে সাহায্য করেন।
আবার কখনো কখনো বড় ঘটনা ছোট্ট আকারে আসে আমাদের জীবনে....।
ধন্যবাদ।
আইনের শাসন থাকলে সুন্দর ভাবেই সমাধান হয় অনাকাংখিত অনেক সমস্যার!
আইন মানার ক্ষেত্রে ঐশী বিধানের অনুসরণ তো সোনায় সোহাগা!
আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করেছেন... আলহামদুলিল্লাহ!
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
বলতে হবে না ভাইয়া আমার এই লিখা পড়েন বুঝে যাবেন কি যে গুতানি খাওয়া আসছি দেশ থাইকা
মন্তব্য করতে লগইন করুন