এক দৈত্যরাজ এবং আমার জীবনের প্রথম চাকুরী ও তিক্ত অভিজ্ঞতা!!!(৪র্থ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন দিল মোহাম্মদ মামুন ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৮:৪১:৩০ রাত
গ্রাম থেকে নতুন এসেছি ও দৈত্যরাজের টিউটর হবার সুবাদে রুমের সবাই আমার প্রতি বেশ আগ্রহ দেখালো, আমিও নতুন পরিবেশের সবাইকে আন্তরক ভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করলাম। অনেক রাত পর্যন্ত সবাই মিলে অনেক কথা বললাম, আমার মনটাও যেন কিছুটা হালকা হলো! সবাই মিরস্বরাই থানার লোক হওয়া সত্বেও কেউ কাউকে ছিনতামনা, তবে বেশ ভালই লাগলো। সকালে আমি এবং বেকার ২ জন ছাড়া বাকি ৫ জন ডিউটিতে চলে গেল। ওরা আমাকে নাস্তা করানোর জন্য অনেক চেষ্টা করলেও আমি তাদের সাথে রেস্টুরেন্টে না গিয়ে নানান রকম অজুহাত দেখালাম, কারণ আমার পকেট শূন্য তাই ওদের খরচ বাড়াতে চাইনি! ওরা চলে যাবার পর আমি নাস্তা করার জন্য দৈত্যরাজের বাসায় গেলাম। দেখলাম আমার জন্য একটা রুটি ও ফ্লাক্সে এক কাপ চা রাখা আছে!! অথচ সকালবেলা আমি সব্জির সাথে ৪/৫ টা রুটি খেতে অভ্যস্ত, সাথে চা তো থাকবেই!!
নাস্তা শেষ করে আমার পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রকে নাখালপাড়া হোসেন আলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে মেসে আসলাম। আমার বেকার ২ রুমমেট কে রুমের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের ঢাকায় আগমন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তার বিস্তারিত জিজ্ঞেস করে তাদের পরিবারের ও তাদের করুন কাহিনী জানতে পারলাম, শেষে তারা বললো দৈত্যরাজ আগামি ১০ দিনের মধ্যেই তাদের চাকুরীর ব্যবস্থা করবে বলে শেষ আশ্বাস দিয়েছে! তখন আমি চিন্তা করলাম, আজ সন্ধায় যদি সবাই মিলে দৈত্যরাজকে অপমান করে তাহলে এই অজুহাতে হয়তো এই ২ হতভাগার কপালে আর চাকুরী জুটবেনা! তখন আমি এই ২ জনকে সহ দুপুরবেলায় সবাইকে বললাম, যেহেতু সে ১০ দিনের মধ্যেই এদের চাকুরীর ব্যবস্থা করবে বলে চূড়ান্ত ওয়াদা করেছে, তাই আর ১০ দিন সময় দেওয়া হোক। দেখলাম ৯ম দিনে দৈত্যরাজ মশাই একটা ড্রাইং ফ্যাক্টরিতে ১৫০০ টাকা মাসিক বেতনে এদের ২জনকে হেলপারের চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছে!! তবুও তারা খুশি, কারণ দীর্ঘদিন বেকার থাকাতে মানসিক কষ্টে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে!!!
মেসে আমি ছাড়া আর কেউ বেকার রইলোনা, সারাদিন একা একা বসে থাকতে আর ভাল লাগেনা, পকেটে কোথাও যাওয়ার মত ও খরচ করার মত টাকাও নাই, কারণ দৈত্যরাজ আমাকে পকেট খরচের জন্য যে টাকা দিত, তার পুরাটাই দিয়ে আমার মোবাইল চলতো!!! একা একা রুমে আর কত বসে থাকা যায়? তাই ভাবলাম, পকেটে টাকা না থাকলেও পায়ে হেটে ঘুরতে তো আর টাকা লাগেনা!! সংসদ ভবন এলাকা, মাওলানা ভাসানি নভোথিয়েটার, জিয়া উদ্যান, মহাখালী, গুলশান একেকদিন একেক জায়গায় ঘুরতে বের হতাম। সন্ধ্যাবেলা টিউশন আর দিনের বেলায় ঘুরা ফেরা এভাবে আমার দিন কাটতে লাগলো। কিন্তু পরিমান মত খাবার না পাওয়া ও মানসিক টেনশনের কারনে আমার অবস্থাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পের ফটিকের মতই হতে লাগলো, তবে ফটিকের চেয়ে আমার ভাগ্যটা মনে হয় একটু ভাল!!!
এইভাবে ২মাস পার করে দিলাম, দৈত্যরাজ সবসময় আমাকে বলতো আগামি সাপ্তাহে তোর চাকুরী কনফার্ম হয়ে যাবে, এর মধ্যে অনেক সাপ্তাহ চলে গেল তারপরও চাকুরীর কোন খবর নাই। একদিন শুনলাম দৈত্যরাজকে তার অফিসের সামনেই ২ জন লোক খুব পিটাইছে, কারণ দৈত্যরাজ তাদেরকে বয়লার অপারেটরের লাইসেন্স বানিয়ে দিবে বলে ২ জনের কাছ থেকে মোট ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ৩ মাস যাবত তাদের ফোন ও রিসিভ করেনি!!! দৈত্যরাজ একজন বয়লার অপারেটর, তার মাসিক বেতন ৮০০০ টাকা, কিন্তু তার ফ্লাট ভাড়া প্রতিমাসে ১০০০০ টাকা! তার ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা, রাজকীয় চলাফেরা ও ফ্যামিলি খরচ সব কিছু হিসাব করার দায়িত্ব আমি সন্মানীত পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম, কারণ আমি আদা বেপারী জাহাজের খবর নিতে চাইনা, আমার একটা চাকুরী হলেই চলে!!!
দিনের বেলায় ও রাতের বেলায় খুব নিচে দিয়ে বিমান উড়ে যেতে দেখতাম, কিন্তু এয়ারপোর্টে গিয়ে সরাসরি দেখার সুযোগ কোন দিন হয় নি! দৈত্যরাজের কাছ থেকে সাপ্তাহিক খরচের টাকাটা পেয়েই মোবাইলের পেট ভরাতাম, যদিও নিজের পেট খালি থাকতো!!! কিন্তু এবার স্থির করলাম, মোবাইলের পেটে টাকা না দিয়ে ঐটা দিয়ে এয়ারপোর্ট দেখতে যাবো। যেহেতু মোবাইলের পেট খালি, তাই মোবাইলটা সাথে নেওয়ার ও প্রয়োজন মনে করলাম না। এয়ারপোর্ট এর পিছনের দিকে অনেক দূর পর্যন্ত হেটে, যেখান দিয়ে খুব নিকট থেকে বিমান দেখা যায় ওইখানেই গেলাম। বিমানকে খুব কাছ থেকে দেখার জন্য সেখানে শত শত মানুষ ভিড় করতেছে, তার উপর দিনটা ছিল শুক্রবার, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা শুক্রবারে পড়তে বসেনা, তাই আমি পুরাই ফ্রি! দেখতে দেখতে সন্ধা হয়ে গেল, বুজতে পারলাম নতুন মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে! বিভিন্ন সাজসজ্জায় সজ্জিত মেয়েদের কামনাময়ী আচরনের সাথে কখনো পরিচিত ছিলাম না, তাই খুব অবাক হলাম!!! ওদের লজ্জা-সরম না থাকলেও আমার পক্ষে তাদের দিকে তাকানো ও সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ডানে-বামে না তাকিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ঐ জায়গা থেকে সরে আসার চেষ্টা করতে লাগলাম।
কিন্তু তাতেও রেহাই পেলাম না, কিছুদূর যেতেই চার ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দাডালো। এক ভদ্রলোক খুব ভদ্রতার সাথে বললো, ভাইয়া আপনার কাছে কি কি আছে বের করেন! বুজতে পারলাম তারা কত নাম্বার ভদ্রলোক! তাদের কে বললাম আমার কাছে বের করার মত কিছুই নাই, আরো কিছু বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাদের দলনেতা আমাকে চুপ থাকতে বলে অন্য জনকে ইশারা করলো আমাকে চার্জ করার জন্য। পুরা শরীল তল্লাশি করে ১৫ টাকা পেল, এতে দলনেতা আরোও গরম হয়ে গেল! অন্য জন একটা চাকু বের করেই বললো, কোথায় টাকা লুকিয়ে রেখেসিস বল, না হয় তোর পেটের মধ্যেই এটা ডুকিয়ে দিব। তখন আমি অনেক অনুনয় করে বললাম, ভাই এটা আমার গাড়ি ভাডা, প্লিজ আমাকে টাকাটা দিয়ে দেন!
দয়ালু দলনেতা আমার হাতে ৫টাকা দিয়ে বললো, এখান থেকে নাবিস্কোমোডের বাস ভাডা ৫ টাকা, যত্তসব, কেন যে আসে ঢাকা শহরে!! সাথে সাথে তার পাশে দাঁড়ানো দুই চামচা এসে আমার পাছায় লাথি মেরে বললো, তুই আজ আমাদের বিসমিল্লাতেই গলদ করে দিলি, ভাগ এখান থেকে শালা কোথ্যেকে যে আসে!! একটু দুরে দাঁড়ানো ২টা মেয়ে আমার লাথি খাওয়ার দৃশ্য দেখে খিল খিল করে হেসে উঠলো!!
জীবনে কোনদিন কেউ আমার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস ও করেনি কিন্তু আজ আমাকে একান্ত অসহায় অবস্থায় দুইটা মেয়ের সামনে এভাবে অপমানিত হতে হলো! ক্ষোভে লজ্জায় চোখের পানি যেন সাগরের ঢেউয়ের মতই আসতে লাগলো!!! মনে মনে বললাম, শালা যদি তোদেরকে মিরস্বরাইয়ের কোথাও পাইতাম তাহলে চরম প্রতিশোধ নিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম!!! তবুও আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া মোবাইল টা আমার সাথে ছিল না! এয়ারপোর্ট দেখার স্বাদ আমার জনমের মত মিটে গেল।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আজ বাসায় গিয়ে দৈত্যরাজকে তিন দিনের সময় দিব, এর মধ্যে যদি কোন চাকুরীর ব্যবস্থা না করে, এবং কোন রকম বাড়াবাড়ি করে তাহলে চতুর্থদিনে আমার জন্মস্থান চট্টগ্রামের পথে রওয়ানা হব, দৈত্যরাজ যখন এলাকায় যাবে তখন তার সাথে ভাল করে হিসাব-নিকাশ করে নিব, এই রকম ২/৪ টা দৈত্যরাজের মোকাবিলা করার জন্য আমার ফ্রেন্ড সার্কেলই যথেষ্ট। এই নিষ্ঠুর ঢাকা শহরে এইভাবে আর থাকবোনা।........ চলবে....
আগের পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন....
http://www.bdmonitor.net/blog/blogdetail/detail/10481/4341216/58669#.VJBEa6SoXqA
বিষয়: বিবিধ
২১০২ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বাট প্রতারিত হয়ে দিনে দিনে মানুষ বিশ্বস্ততা হারাচ্ছে।
দৈত্যরাজ নামক ধাপ্পাবাজ মানুষের পাল্লায় পরে আপনার বেহাল দশা।
কত কষ্ট করেছেন আল্লাহ আপনার ভাল করবে ।ইনশা আল্লাহ ।
লোকদের কে প্রতারিত করে এদের কালো হাত
সমাজ হতে দুর করতে হবে।
কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের ভাল লাগাই আমার লেখার সার্থকতা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন