ফিবোনাচির গল্প ২.১ : ফুল-ফল ও সবজীর জগতে গণিতের কারসাজি!!
লিখেছেন লিখেছেন অবাক মুসাফীর ১২ জুন, ২০১৫, ০৫:২৮:২০ বিকাল
ফুলের রাজ্যে ফিবোনাচির হাতছানি...!
আমাদের স্কুলে যে ম্যাডাম বায়োলজি নিতেন, তিনি কারণে-অকারণে আমাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন। এজন্য স্কুলে সবাই তাঁকে এক নামে চিনতো, চাঁদাবাজ! প্র্যাক্টিকাল খাতা দেরী করে স্বাক্ষর করানো আর স্কুলে অনুপস্থিতি-এ দুটো ছিলো ম্যাডামের চাঁদাবাজীর সবচেয়ে পছন্দের কারণ। কিন্তু তারপরেও স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী নির্বিশেষে সবাই ম্যাডামকে খুবই পছন্দ করতাম, কারণ তিনি সেই চাঁদাবাজীর টাকা দিয়ে অসাধারন একটা কাজ করেছিলেন আর সেটাই ছিলো তার ধ্যান-জ্ঞান।
আমাদের থেকে পাঁচ টাকা-দশ টাকা করে নিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন খুব ছোট্ট, ছিমছাম কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দর একটা ফুলের বাগান! আমরা সেই বাগানটিকে বলতাম, “চাঁদাবাজের কাশ্মির!" তো চলুন, আপনাদের ঘুরিয়ে আনি সেই বিখ্যাত বাগানটি থেকে।
ধরুন, এই মোট আট রকম ফুল ছিলো সেই বাগানে। কিন্তু কথা হলো, ফিবোনাচির গল্প বলবো বলে আপনাদের ডেকে নিয়ে এসে বাহারী সব ফুল কেন দেখাচ্ছি? চলুন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি ফুলেদের কাছেই। একেবারে প্রথম ফুলটি থেকে শুরু করুন, গুনে দেখুন তো প্রতিটি ফুলে কতটি করে পাঁপড়ি আছে...!
কি গোনা হল? ফিবোনাচির সাথে ফুলগুলোর পাঁপড়ি সংখ্যার মিল পেলেন কোনো? আপনাদের সুবিধার জন্য ধারাটি আবার উল্লেখ করছি, ভালো হয় প্রথমের কিছু সংখ্যা একটু মনে রাখার চেষ্টা করুন।
০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯, ১৪৪...
এবার হয়তো আর অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়। চোখ কঁচলে লাভ নেই, আপনি সত্যি সত্যিই দেখছেন! ফুলগুলোতে পাঁপড়ির সংখ্যা হু-বহু মিলে যাচ্ছে ফিবোনাচি ধারার সাথে! গণিত ছাড়া আর কিভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ফুলের রাজ্যের এই যোগসূত্র? পৃথিবীর প্রায় সব ফুলই এই ধারা মেনে চলে! আপনি চাইলে আপনার আসেপাশের যে কোনো ফুলের পাঁপড়ি গুনে দেখতে পারেন।
শুধু ফুলের পাপড়িতে নয়, আরো সূক্ষ্মভাবে ফুলের একেবারে ভেতরে ঢুকে আছে ফিবোনাচি। সূর্যমুখী ফুল তার সেরা প্রমাণ। সূর্যমুখী ফুলের গোলাকার চাকতিটি একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, সে জায়গাটিকে সুদৃশ্য করে রেখেছে কিছু স্পাইরাল। দেখুন তো সূর্যমুখীর এই স্পাইরালগুলো আমরা চিনতে পারি কিনা?
চিত্র: ফিবোনাচির একটি অসাধারন নিদর্শন, সূর্যমুখী।
আকৃতি এবং সংখ্যায় সূর্যমুখী সেই মহান ফিবোনাচি ধারারই প্রতিনিধিত্ব করে! আর এখানে কিন্তু মাত্র একটি নয়, চারটি ফিবোনাচি স্পাইরাল সিরিজ সূর্যমুখীকে অনন্য করে তুলেছে।
নিচের ছবির ফুলটি সূর্যমুখীর দু:সম্পর্কের ভাই বোধ হয়। বিদেশী এই ফুলটির বৈজ্ঞানিক নাম Bellis perennis.
চিত্র: আরো ফুল, আরো ফিবোনাচি!
সবজী ক্ষেতে ফিবোনাচি!
এবার দুই ভাইয়ের প্রেমের গল্প বলি। যেন তেন প্রেম নয়, ফিবোনাচির প্রতি প্রেম!
এই ভাইদের আমরা সবাই চিনি, ফুলকপি আর বাঁধাকপি। এই কপি ভাইয়েরা ফিবোনাচিকে একেবারে হৃদয় দিয়ে ধারন করে! কিভাবে?
একটা বাঁধাকপিকে লম্বভাবে কেটে দুভাগ করে ফেলুন। ভেতরে কয়েকটা স্পাইরাল
বিশিষ্ট সুদৃশ্য ডিজাইন দেখতে পাবেন। দেশি বাঁধাকপিগুলো হয়তো এমন রঙিন নয়, কিন্তু তাতেও এমন স্পাইরাল আছে।
চিত্র: বাঁধাকপির স্পাইরাল ও ফুলকপির ফুলে ফিবোনাচি।
ফুলকপিতে অবশ্য এমন কাঁটাকাটির ঝামেলা নেই। খুব সহজেই এর স্পাইরাল দেখা যায়... আমি নিশ্চিত যে আপনাদের আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই এই স্পাইরালগুলো কোথাকার কে?
ফলেরা কেন বাকি থাকবে?
ফলের মধ্যে যে দুটো ফলের কথা বলতেই হয় তারা হল আনারস আর পাইনের ফল (Pinecone)। এরা ফিবোনাচি ছাড়া চলতেই পারে না! আনারসের গায়ের ষড়ভুজাকৃতির খোঁপগুলোতে তিন ধরনের স্পাইরাল দেখা যায়। এ তিন ধরনের স্পাইরালেরই খোপ সংখ্যা অবশ্যই ফিবোনাচি সংখ্যক হবে! কি নিঁখুত গণিত!!
চিত্র: আনারসের মাঝে লুকিয়ে ফিবোনাচি!
পাইনকোনের স্পাইরালগুলো অবশ্য ভোরের সকালের মতই পরিষ্কার, এর স্পাইরালগুলোও আকৃতিতে এবং সংখ্যায় ফিবোনাচির সাথে মিলে যায়!
চিত্র: পাইনকোনের ঘূর্ণিতে ফিবোনাচি।
এতসব ফল-ফুল-সবজীর ভেতর থেকে আমরা যে ফিবোনাচিকে পেলাম, এগুলোই কিন্তু শেষ নয়। আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে আছে এমন আরো অসংখ্য উদাহরন যেখানে ফিবোনাচি আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে। শুধু চোখ মেলে দেখার মত দেখার অপেক্ষা।
ভালো থাকবেন||
ফিবোনাচি সম্পর্কে আরো জানতে-
ফিবোনাচির গল্প ১.১
ফিবোনাচির গল্প ১.২
ফিবোনাচির গল্প ২.২
বিষয় : প্রিয় ধারা
বিষয়: Contest_priyo
২২৩৫ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগছে আপনার ফিবোনাচি সিরিজটি। ধন্যবাদ।
পলিটেকনিকের সিলেবাসে ফিবোনাচি ছিলো, কিন্তু আমাদের সাধারন সিলেবাসে নাই!! ব্যাপারটা দুঃখজনক...
এক কথায় ওয়াও! প্রথম ফুলটি কাল্লা লিলি কি বাংলাদেশে জন্মায়? এখানে প্রচুর দেখেছি খুবি ভালো লাগে! চাঁদাবাজি ম্যাডামের প্রশংসা না করে উপায় নেই! চমৎকার কাজ করেছেন তিনি!
একটি অনুরোধ এ ধরনের সিরিজটি নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ার আবেদন করছি! আশাকরছি মাহরুম হবো না!
জাযাকাল্লাহ খাইর!
এগুলো মূলত লেখা একটা কিশোর বিজ্ঞান সাময়িকীর জন্য, পত্রিকাটা দ্বিমাসিক। আশা করি তিনটা সংখ্যায় যাবে লেখাগুলো, তাই আগামী ছয় মাস আমার ছুটি। সে জন্য হয়তো আমি শীত নিদ্রায় যেতে পারি! ফিবোনাচি নিয়ে আর একটা পোস্ট করবো ইনশা আল্লাহ, তারপর...
শীত নিদ্রার মাঝে লম্বা হাই তোলার সময় এখানেও একটু উঁকি মারবেন প্লিজ!
সেক্যুলার মন বলছে 'অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য' স্রষ্টার নিদর্শন এসব। জোর করে কাকতালীয় বলতে গেলেও নিজের বিবেকের মধ্যে উদ্ভুত দ্বিধা ও দ্বন্ধ কাজ শুরু করে - বাধ্য হয়ে কিছু না বলেই ছুটি দিতে হয় স্যেকুলার মন ও মনোবৃত্তিকে।
সোবহানাল্লাহ্ অসম্ভব আকর্ষনীয় বিষয় জানছি আপনার এ সিরিজ লিখা হতে।
কষ্ট করে শেয়ার করছেন বলে ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন