শিশুগাছ আর শিশুদের গল্প
লিখেছেন লিখেছেন অবাক মুসাফীর ২৫ মে, ২০১৫, ০৬:০৩:৩৩ সন্ধ্যা
কিছুটা দূর থেকে খুব মিষ্টি একটা শব্দ ভেসে আসছে। টুং-টাং টুং-টাং। শব্দটা আমার পরিচিত, কিন্তু কিসের শব্দ তা ধরতে পারছি না। জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম, দুদিকেই। কিচ্ছু নেই, শুধু জিহ্বা বের করে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকা একটা কুকুর আর রৌদ্রতপ্ত বাতাসে উড়তে থাকা ধুলো-বালি ছাড়া।
দুপুরের এই অলস সময়টা আমার বড্ড খারাপ যায়। বিকেল গড়িয়ে গেছে কিছুক্ষণ, সূর্যও একটু ফিকে হতে শুরু করেছে, কিন্তু অসহ্য গরম কিছুমাত্র কমে নি। বারান্দাতে বসার যো নেই, একেবারে আগুন-গরম; আর উঠোনে তো নয়-ই। আর একটু পর, সন্ধ্যে নামলে তবেই স্বস্তি। ঝিরি ঝিরি বাতাস বইতে শুরু করবে, সেই বাতাসের তালে গাছেরা গাইবে কোরাস! উফফ, পুরো চব্বিশ ঘন্টাই সন্ধ্যের মত হত!
শব্দটা নির্দিষ্ট হারে বাড়তে বাড়তে এগিয়ে আসছে। আমি আবার জানলা দিয়ে উঁকি দিলাম। ভ্যানগাড়ি জাতীয় কিছু একটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে পায়ে হাঁটা সরু পথ বেয়ে। এই গাড়ির নেপথ্যে যে ব্যক্তি, সে এবং তার গাড়ি বিশাল একটা চাররঙা ছাতার নিচে ঢাকা পড়েছে। গাড়িটার গতি এতোই কম আর তার সাথে গরম, তাকিয়ে থাকলে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
রাস্তার দুপাশে অসংখ্য বিশাল বিশাল শিশুগাছ ছিলো একসময়। এখনো কয়েকটা দাড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। নামে শিশু হলে কি হবে? এ তল্লাটে কেউ এদের শিশু বা চারা অবস্থায় দেখেনি। যেন জন্মই হয়েছে মহীরূহ হয়ে, বুড়ো হয়ে। ধীর গতির ভ্যানগাড়িটা এসে থামলো এমনই এক বুড়ো-শিশুগাছের ছায়ায়। আমাদের বাড়ি থেকে মোটে ফুট পঞ্চাশেক দূরে গাছটা, অনেকটা জায়গা জুড়ে জালের মত ছায়া ছড়িয়ে বনেদী-বনেদী ভাব নিয়ে আছে। ভ্যানগাড়ির মানুষটার হাবভাব এমনিতেই অদ্ভুৎ, বনেদী এই গাছের ছায়ায় তা আরো বেশি অদ্ভুৎ ঠেকছে। মাথায় চোঙাকৃতি বিশাল টুপি আর পরনে অজস্র তালি-পট্টিসহ রং-বেরঙের অদ্ভুৎ জামা-পায়জামা। আগেকার দিনের সার্কাসের বেঁটে জোকার বা গলায় গামছা বেঁধে বুকের ওপর ঝুড়ি ঝুলিয়ে ঝাল-মুড়ি বেঁচে বেড়ানো হকারেরা যে ধরণের জামা-পা‘জামা-টুপি পরতো, ঠিক সে রকম। এমন পোষাকী মানুষ যে কত কাল দেখি না, তার ইয়ত্তা নেই। ভ্যানগাড়ির উপর দুটো বেশ বড় বড় বাক্স। বাক্সগুলো বোধহয় সাদাটে কিছুর তৈরী, হলদে টেপ দিয়ে চারপাশ ভালোভাবে মোড়া। প্রচণ্ড গরমে ক্লিষ্ট গলদঘর্ম মানুষটার হাতে সোনালী রঙের কি যেন। হঠাৎ বার কয়েক হাত নাড়লেন। মিষ্টি শব্দটা আবার ভেসে এলো... টুং-টাং টুং-টাং।
***
মানুষটা এখনও লক্ষ্য করেনি পাশের দোতলা বাড়ির একটা জানলায় বসে একজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে ব্যবচ্ছেদ করে যাচ্ছে। একহাতে সোনালী ঘন্টাটা বাজিয়ে চলেছে আনমনে, আর অন্য হাত আর চোখ দিয়ে কি যেন খুঁজে চলেছে বাক্সগুলোর আসে পাশে। পেয়েছে, একটা নোংরা গামছা। একহাতে গামছা আর অন্য হাতে ঘন্টাটা নিয়ে একটু সরে গিয়ে বসে পড় গাছটার মোটা একটা শেকড়ের উপর।
হাতের ঘন্টাটা শব্দ করে চলেছে হরদম, টুং-টাং টুং-টাং। আর অন্য হাত ঘামে জবজবা শরীরময় হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই, ইনি ফেরীওয়ালা গোত্রের। কি কি আছে ওর বাক্সগুলোয়? আর পাশের ওই টুকরি ঝুড়িতেই বা কি? কিছুই আন্দাজ করতে পারলাম না। টুং-টাং টুং-টাং চলছেই।
এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখছে, খোদ্দের খুঁজছে। যার পরণে এমন রঙচঙা জামা, তার খোদ্দের হবে বাচ্চারাই। তবে বাক্সগুলোয় আছে কি? চকলেট? নাকি মিষ্টি?
***
মানুষটা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে যাচ্ছে। যদি কেউ আসে, যদি কেউ আসে! টুং-টাং টুং-টাং আওয়াজ ছড়াচ্ছে বহুদূর। নিশ্চয়ই পাড়ার খিটখিটে বুড়োদের ভাতঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে ভালোভাবে। তারা এখনও কেন চিল্লাপাল্লা করে পাড়া মাথায় তুলছে না, সেটা চিন্তার বিষয় বটে। বাচ্চারাও এতক্ষণে বায়না ধরেছে, মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে টানাটানি শুরু করেছে। পাশের মোল্লাবাড়ি থেকে দুটো বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এলো ভ্যানগাড়ির কাছে। ওদের নাম ভুলে গেছি, শুধু জানি ও বাড়ির বিধবা-বুবুর ছেলে ওরা। খালি গা, মুখে বিজয়ীর হাসি। ওদের মায়ের কাছ থেকে যে ক‘টা পয়সা ইনিয়ে-বিনিয়ে উদ্ধার করেছে, তার চাপা উল্লাস। বাচ্চারা কত ছোট্ট জিনিসেই কত্ত খুশি হয়!
বাচ্চাদুটোকে দেখে হাসি ফুঁটলো বুড়োর মুখেও। পয়সা দিতেই দুটো কটকটে রঙীন আইসক্রীম ধরিয়ে দিলো ওদের হাতে। একটা কমলা, অন্যটা সবুজ। আমার মত বুদ্ধু আর কানা বোধ হয় আর দু‘টো নেই। বিশাল ছাতাটা, যেটা জং ধরা লোহার সিক ভ্যানের সাথে বেঁধে রাখা, তাতে গোটা গোটা করে লেখা, ‘সোলেমান মালাই'। বাচ্চাদুটো খুব আয়েশ করে খাচ্ছে। একেবারে রাঙা হয়ে উঠেছে ওদের ঠোঁট; একজনের সবুজ, অন্যের কমলা।
আরো কয়েকটা বাচ্চা চলে এসেছে পাশের বাড়িগুলো থেকে। সবার কাছে অবশ্য পয়সা নেই। অন্যেরটা ভাগাভাগি করে খাচ্ছে, কি নির্দ্বিধায়! একজন তো টানতে টানতে মাকে নিয়েই হাজির। একটা মালাই তার চাই-ই চাই। মা যখন আঁচল খুলে দেখালো তার কাছে পয়সা নেই, সে কি কান্না! শহুরে বাবার মালাই এনে দেবার কইফিয়াতও টিকলো না। শেষে বুড়ো মালাইওয়ালা, সম্ভবত সোলেমান মিঞা, বাচ্চাটার হাতে একটা মালাই ধরিয়ে দিলে তবেই শান্তি। মাগনা দিলো বোধহয়। বুড়োর ব্যাবসা খুব ভালো যাচ্ছে, বলতেই হবে। বুড়ো এখনও খদ্দের ডেকে চলেছে, টুং-টাং টুং-টাং।
***
সদর দরজায় সমানে কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। পিচ্চিদের এমন কাণ্ড-কারখানা দেখতে দেখতে হারিয়ে গিয়েছিলাম শৈশবে, ওদের মত করে ঠোঁট রাঙিয়ে মালাই খেতে ইচ্ছে করছে খুব। কতক্ষণ ধরে মানুষটা দরজা ধাক্কাচ্ছে কে জানে! ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। রোজকার মতই হাতে দুটো ফুল হাতে, গোলাপ। আজকের দুটো পুরোপুরি-ই ফুঁটে গেছে, বিশাল দুটো গাঢ় লাল বৃত্ত, ভাঁজে ভাঁজে অতলে হারিয়ে গেছে। অন্য হাতে দুটো মালাই; একটা কমলা, আরেকটা সবুজ। মানুষটা এতো কিছু বোঝে কি করে?
সোলেমান মালাইয়ের শব্দটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, টুং-টাং টুং-টাং...।
*****
বিষয়: সাহিত্য
১৩১৮ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার মানুষটাতো বেশ!!! গোলাপ আর মালাই!!!!
বেশ ভালো লেগেছে আপনার এই লেখাটা।
অসাধারন মায়ায় জড়ানো গল্পটি পড়ে হারিয়ে গেলাম শৈশব-কৈশোর এর সেই নানান রং এর দিন গুলোতে!
রাস্তা আর দু ধারে জন্মনো গাছগুলো এগুলো আমাদের সবার চিরচেনা হাজারো স্মৃতি বহন করে থাকে ! আমাদের কয়জনের সময় হয় সেগুলো নিয়ে ভাবার ? হারিয়ে যাওয়ার সেই উচ্ছল আনন্দঘন দিনগুলোতে?
চমৎকার স্মৃতিচারন মূলক পোস্টের জন্য শুকরিয়া!
কিছুটা তাড়াহুড়ো এবং অসুস্থতার মাঝে পড়েছি এবং কমেন্ট করেছি এটা শতভাগ সত্য!
এখন দুইটা প্রশ্নের জবাব দিলে কৃতার্থ হই!:
১) পাশের দোতলার জানালা থেকে কে ব্যবচ্ছেদ
করছিলো?
২) সদর দরজায় কড়া নাড়িয়ে মালাই আর গোলাপ নিয়ে কে এসেছিলো?
শুকরিয়া এবং শুভকামনা জানবেন!
২. কথকের স্বামী।
দ্বিতীয়বার এসে, সম্পূর্ণ পড়ে কমেন্ট করার জন্য ডাবল শুকরিয়া।
আল্লাহ খুব দ্রুত আপনার সুস্থতা দান করুক, দো'আ।
চমৎকার নান্দনিকতায় ফেলে আসা শৈশবে নিয়ে গেলেম এক নিমিশেই!
চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনেক অনেক দিন আগে ছেড়ে আসা গ্রামীন সেই মেঠোপথ আর ফেরীওয়ালা!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ!!
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
টুং-টাং টুং-টাং
টুং-টাং টুং-টাং
মন্তব্য করতে লগইন করুন