সেই ইশকুল, এই কলেজ
লিখেছেন লিখেছেন অবাক মুসাফীর ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৭:৪৪:০১ সন্ধ্যা
ইশকুলের বারান্দা পার করলাম নয় মাস হল, তবুও প্রতিদিন সকালে আটটা বাজতে না বাজতেই কোনো দিন আব্বা হুঙ্কার ছাড়ে, কখনো আম্মা ঠ্যালাঠেলি করে, কখনো দাদী এসে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে গুতায়, 'ওই, ওঠ ইশকুলে যাবি না?? ইশকুলের সময় হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ওঠ।' কোনো দিন ছোট্ট বোনটা মশারীর ভেতর মাথা বাড়িয়ে বলে, 'দাদা দাদা, আমি আইছি, তুমি ওঠো' |
তারা এখনো পুরোনো অভ্যাস ভুলতে পারে নাই, অবশ্য তাদেরই বা কি দোষ! আমি নিজেই তো মাঝে মধ্যে ভুলে যাই। গোয়ালে ঢুকছি সেই কবে! বের হইতে হইতে ছাত্রজীবনের অর্ধেকের বেশি পার হয়ে যাবে।
সালটা ২০০৬ | '০৫ এর শেষের দিকে অনেক স্বপ্ন (আর একটু পরিশ্রম) নিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসলাম ... কেলাস থ্রীর ভর্তি পরীক্ষা বস, বুঝতে হবে নামী দামী ইশকুল। আল্লাহর রহমতে টিকেও গেলাম। ব্যাস শুরু হল আমার "আটটা টু সাড়ে বারোর রুটিন"।
ছোট্ট ছোট্ট পায়ে মস্ত একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কখনো আম্মুর হাত ধরে কখনো একা একা চলে আসতাম কলেজে থুক্কু ইশকুলে। বিশাল ক্যাম্পাস, বলা উচিত সুবিশাল ক্যাম্পাস। ইশকুলের বাউন্ডারীর চার পাশদিয়ে ই-শেপড ইশকুল বিল্ডিং। ক্লাস শুরু হওয়ার অনেক আগেই ইশকুলে চলে আসতাম। এমনও অনেক দিন গেছে আমি একেবারে সব্বার আগেই ইশকুলে উপস্থিত, এমনকি ক্লাসের তালাও খোলা হত না তখন।
বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশ দেখতাম। চারপাশেই বিশাল বিল্ডিং, মাঝখানে ছোট্ট একটুকরো আকাশ। খুব ভালো লাগতো দেখতে ... মাঝে মাঝে দুই একটা কাক বা চিল উড়ে যেত। প্রথম দিন থেকেই ওই একটুকরো আকাশকে খুব নিজের মনে হত, অধিকার বসাতে চেষ্টা করতাম। ওই টুকরো আকাশকে আজও দেখি ... বিরামহীন ... কোনো ক্লান্তি আসে না। ক্লাসের ভেতর জোড়ায় জোড়ায় চড়ুই পাখি আসতো, মাঝে মাঝে বাজ-শালিক, আমি বাইরে দাড়িয়ে ওদের খেলা দেখতাম। তালা খুলে ভেতরে যাওয়ার পর আর একটা পাখিও ক্লাসে ঢুকতো না, বড়জোর ক্লাসের গ্রিলে দাড়িয়ে ওদের খেলা নষ্ট করার জন্য কড়া ভাষায় দুই-চারটা কথা বলে চলে যেত ... ...
আজ নয় মাস পর পরীক্ষায় বসলাম। কিন্তু নষ্টালজিক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম যে আমার সীট যে রুমে পড়েছে সেখানে আমরা ক্লাস করতাম থ্রীতে থাকতে। এমনিতে কলেজে আসলে এই মুখো হই না, পিচ্চি পাচ্চারা সারা দিন দৌড়াদৌড়ি, চেচামেচি করে। কিন্তু আজকে এসে মাথাই নষ্ট হয়ে গেলো। একটা বেঞ্চে আট বছর আগের কার বাংলা শব্দার্থের নকল পেয়ে গেলাম। আরে! এ যে আমারই কাজ, সেই দিন ধরা খেয়ে পরের দিন গার্ডিয়ানসহ ইশকুলে যেতে হয়েছিলো!
মনে পড়ে গেলো প্রথম যেদিন ভারত পাকিস্তানের বর্ডার (পাশা-পাশি দুইটা দেয়াল) টপকে ইশকুল পালিয়েছিলাম সেই ঘটনা ... স্যার ম্যাডামদের সই নকল করে ছুটির ব্যাবস্থা করা, মাঝে মধ্যে দারোয়ান কাকাদের চা-পান-বিড়ির জন্য ঘুষ দিয়ে ক্লাস পালানো ... বেশি বেশি টিফিন খাওয়া ... স্যারদের আর বন্ধুরের সুন্দর সুন্দর নাম দেয়া, পাওয়া ... মিমিকরী করা ... ব্ল্যাক বোর্ডে চকের খসখসানিযুক্ত ক্লাস (এখন আমরা ডিজিটাল হয়ে গেছি) ... আরো এত্তো এত্তো গল্প ... ...
এই গোয়ালে ঢুকেছিলাম সেই '0৬ সালে, সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলে বের হয়ে যাবো ১৬'য়। সাড়ে দশ বছর! এইটা আমার প্রাইমারী ইশকুল, এইটাই হাই ইশকুল, এইটাই এখন আমার কলেজ। আরো দেড়টা বছর কষ্ট করে কাটিয়ে দিতে পারলে মুক্তি পাবো গোয়াল থেকে। কিন্তু সমস্যা হল, 'খুলনা পাবলিক কলেজ' নামের গোয়ালখানাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি। সেই থ্রী থেকে এই পর্যন্ত অনেক নতুন স্যার এসেছেন, অনেকে চলে গেছেন, অনেক বন্ধু পেয়েছি যাদের সাথে এখনো ক্লাস করি, অনেকে ক্লাসমেটের খাতা থেকে নাম কাটিয়েছে হয় তো, কিন্তু বন্ধু হিসেবে রয়েই গেছে ... আজীবন থাকবে।
এখনো বেশ ভালোই আছি, 'আট-সাড়ে বারোর রুটিনে' |
এখনো প্রতিদিনই সুযোগ পাচ্ছি ওই খন্ড আকাশটাকে দেখার। কিছুদিন পর হয়তো সেই সুযোগ আর পাবো না ... ওই আকাশটা তখন কি মনে করবে আমায়? নাকি নতুন কোনো দর্শক পেয়েই খুশি থাকবে? ... চড়ুই গুলো কি বকা দেয়ার জন্য অন্য কাউকে খুঁজে নবে? নাকি ভিড়ের মাঝে না পেয়ে মন মরা হয়ে বসে থাকবে সেই মরিচা পড়া গ্রিলে? ...
আমার জায়গাটা কি হারাতে চলেছি আমি? ... এসব চিন্তা করলে ভয় হয় ... বড্ড ভয় হয় ... ।
বিষয়: বিবিধ
১২৭২ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক অনেক ভালো লাগা রেখে গেলাম আপনার লিখাটিতে। আপনি আ্মার স্মৃতিবিজড়িত একটি যায়গাকে ব্লগে তুলে এনেছেন, আপনার ভিতর থেকেও কেমন 'কাছের মানুষের' ঘ্রাণে উদ্বেলিত হচ্ছি।
অনেক ভালো লাগল আপনার এই উষ্ণ আতিথেয়তা।
শুভ সকাল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু ইউনিভারসিটিকেও স্কুল বলে!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন