প্রতিবিম্ব (ছোটগল্প)
লিখেছেন লিখেছেন অবাক মুসাফীর ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:০১:৩২ রাত
বারান্দা দিয়ে যেতেই দরজার পাশে থমকে দাড়ালাম। ভেতর থেকে রাইসার বেশ চিল্লা-পাল্লা শোনা যাচ্ছে। ঘরের দরজা অর্ধেকটা ভাজানো, ভেতরে আলো জ্বলছে। ঘরে রাইসা ছাড়া আর তো কেউ থাকার কথা না, ওর আম্মুতো নিচের রান্না ঘরে। তাহলে সে চিল্লাচ্ছে কার সাথে? একটু এগিয়ে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম।
আমার একমাত্র মেয়ে রাইসা, বয়স সবে ছয় হল। ঘরের ভেতর ওর পুতুল আর খেলনাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে রেখে খেলছে আর খেলাচ্ছলে কথা বলছে পুতুলগুলোর সাথে। বেশ মজা পেলাম। দরজা থেকে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু একটা জিনিস আমার চোখে আঁটকে গেলো।
আমার কাঠের রুলারটা ওর খেলনার মধ্যে কেন? ওটা তো সব সময় আমার টেবিলে থাকে। রাইসাকে জিজ্ঞাসা করার জন্য ভেতরে ঢুকবো, তখন ও বেশ জোরে জোরে চেঁচিয়ে বললো, "খ-ব-র-দা-র, পরে কক্খনো এই কাজ করবে না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।"
ওরে বাব্বা! আমার মেয়েটা বেশ রেগে গেছে, তাই এক্ষুণি আর ঢুকলাম না, একটু পরেই যাই ... কিছুক্ষণ দাড়িয়ে বরং মেয়ের খেলা দেখি ...
একটু বাদে রাইসা বললো,"এক্ষুণি পড়া করে উঠবি, নয়তো তোর ঠ্যাং ভেঙে ফেলবো। এত্তো সহজ জিনিস মাথায় ঢোকে না কেন তোর? মাথায় কি গোবর না কঁচু নাকি ... ... ?" একটু আস্তে আস্তে বললো, 'আর কি যেন ... ?! কি যেন? ... হুমম, মনে পড়েছে, ছাই'। আবার জোরে জোরে বলতে থাকলো,"তোর মাথায় কি গোবর না কঁচু নাকি ছাই, হুউউউ?"
এবার মুখ ফিরালো টেডি বিয়ারটার দিকে। বসে থাকা টেডি বিয়ারটাকে কোলে নিতে নিতে বললো,"এই কি বললি তুই? এখন খাবি না, তাইনা? ... আবার মুখে মুখে তর্ক! এতটুকুন একটা মেয়ে আবার তর্কও শিখেছে! এতো তর্ক তুই শিখেছিস কার কাছ থেকে? তোর মা শিখিয়েছে নিশ্চয়ই! ... দাড়া আজ তোকে আমি বুঝিয়ে ছাড়বো আমার সাথে তর্ক করার ফল ... তোর শাস্তি এখনই একশো বার কান ধরে উঠ-বস করবি ... কি! করবি না? কত্ত বড় সাহস মেয়ের! এক্ষুণি মজা দেখাচ্ছি, তোর হাত বের কর ... বের কর বলছি ... এবার মুঠ কর ... আমার রুলারটা কই?
... ঠাস! ঠাস! ঠাস! ... ব্যাথা পাচ্ছিস! খুব ব্যাথা? ... হা হা হা, ব্যাথা তো পাবিই। শাস্তি দিলে কেউ কখনও আরাম পায় না। টানা দশ বাড়ি তোর পাওনা হয়েছে, এখনও ছ'টা বাকি ... কেঁদে কোনো লাভ নেই। ... কি? আর করবি না? তো করলি কেন? অন্যায় করলে শাস্তি তোকে পেতেই হবে ... ব্যাথা যে কয় দিন থাকবে, তত দিন তোর মনে থাকবে, তুই কোনো অন্যায় করেছিলি। চুপচাপ খেয়ে নে এখন, নইলে কিন্তু কপালে আরো জুটবে ... ।"
"... পাঁজি মেয়ে কোথাকার! এখনো পড়াটা শেষ করিস নি? আমি কি তোর জন্য সারা দিন বসে থাকবো? আমার অন্য কাজগুলো কে করবে শুনি? আমি তোকে নিয়ে আর পারছি না। তোকে তোর মার সাথে এই বার নানু বাড়ি পাঠানোর ব্যাবস্থা করোবো ... তুই ওখানেই থাকবি, আর ফিরে আসতে হবে না ... ওখানেই পঁচে গলে মরবি, সারা জীবন অশিক্ষিত থেকে যাবি, গায়ে-গতরে একটু বড় হলেই ধরে বিয়ে দিয়ে দেবে ... ওটাই তোর জন্য ভালো। তোর দ্বারা আর যাই হোক, লেখাপড়া হবে না ... ।"
" ... মেয়ে আবার বলে কিনা আমি যাব না! বেশি কথা বললে আমি কিন্তু তোমাকে বাথরুমে বন্দি করে রাখবো ... আবার আমার মুখের উপর কথা! তোদের সবার বাড়াবাড়ি আমি আজকেই ছুটিয়ে দেবো, সবকয়টার শাস্তি, শাস্তি আর ... শাস্তি!"
অজানা এক আতঙ্ক ভর করলো আমার উপর ... একের পর এক প্রশ্ন এসে আমায় আঘাত করছিলো ... আমার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হল ... আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না ... ঘরের ভেতর না ঢুকে সোজা নিচে চলে গেলাম।
রাইসার আম্মু সোফায় বসে টিভি দেখছে। আমাকে দেখে কেমন করে যেন তাকালো, বললো, "কি হলো? ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে বুঝি? তোমার চেহারা এমন ফ্যাকাশে কেন? ভূত দেখছো নাকি? বলে ওর চিরায়ত স্বভাব, ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। অন্য সময় খুব ভালো লাগলেও এখন কেমন যেন অসহ্য মনে হল, মনে হল বিদ্রুপের হাসি। সোফায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, "ভূত না ... তার চেয়েও ভয়ঙ্কর! ... আমি নিজেকে দেখে এলাম ... ।"
বিষয়: সাহিত্য
১১৮৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন