চাই অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই
লিখেছেন লিখেছেন আরিফিন আল ইমরান ২৯ অক্টোবর, ২০১৫, ১০:৪০:৪৫ রাত
অনেক সমস্যার নেপথ্যে লুকিয়ে আছে, একটি বিশাল সমস্যা। সেই সমস্যাটির নাম অজ্ঞানতা । আর এই অজ্ঞানতার পেছনে মূল কারনটি হল- জ্ঞান চর্চার অভাব। জ্ঞান চর্চা ও পড়াশোনা এতাটা শক্তিশালী বিষয়, যে তার অনুপস্থিতি একটি জাতির অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দিতে পারে। পড়াশোনার কার্যকারীতা বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন এডামসের বক্তব্য ছিল, ''You will ever remember that all the End of study is to make you a good Man and a useful Citizen.—This will ever be the Sum total of the Advice of your affectionate Father.'' ইতিহাসের সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপট এখানে হাজির করবনা। শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি, প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে উত্তরাধুনিক সময় পর্যন্ত- কোনো পর্যায়েই আমরা জাতিগতভাবে জ্ঞানমুখীতার প্রমাণ দিতে পারিনি। আামাদের ইতিহাসের বয়ানগুলো- বিদেশী মণিষীদের কলমে রচিত। কোন শাসকের আমল কেমনতর ছিল তা জানতে, আজো আমাদের তাদের লিখিত তথ্য-উপাত্তের উপরে নির্ভর করতে হয়। কখনও হিউয়েন সাং, কখনও ইবনে বতুতা আবার কখনও আল বেরুনীর ভারত সফরের বিবরণের উপর ভর করে, আমরা ইতিহাস পরিভ্রমণে বের হই। আমাদের প্রজ্ঞার এই করুন দশা থেকে চিন্তাশীলরা সহজেই বুঝতে পারবেন, আমাদের পরনির্ভরশীলতার মূল কারনটি। মিনহাজউদ্দিনের তবাকাত ই নাসিরি ছাড়া, বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের নির্ভরযোগ্য প্রামান্য ইতিহাস আমাদের নেই। উইলিয়াম হান্টার, লেনপুলরা তাই ইচ্ছেমত বিকৃতি সাধন করে, আমাদের কৃতিত্ব লুট করতে পারেন। এই স্পর্ধার সুযোগ আমরাই তাদের দিয়েছি। যে পথ দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকাররা আমাদের ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো বিকৃত করবার অধিকার পেয়ে যান, ঠিক সেই পথেই হলওয়েলরা অন্ধকূপ কেলেংকারীর হোতা হিসেবে নওয়াব সিরাজকে দোষী সাব্যস্ত করার লাইসেন্স লাভ করেন। এভাবে ইতিহাস বিকৃতির অধিকার কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কারো নেই। ইতিহাস বর্ণনার নীতি কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে লুইস এল. আমুর তার Education of a Wandering Man বইয়ে লিখেছেন,“Much of the study of history is a matter of comparison, of relating what was happening in one area to what was happening elsewhere, and what had happened in the past. To view a period in isolation is to miss whatever message it has to offer.” যদি অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে শাহওয়ালীউল্লাহ দেহলভী ও তাঁর ছাত্ররা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রজ্ঞাময় আন্দোলন গড়ে না তুলতেন, তবে এসব দুর্দশা আরো ঘনীভূত হবার সুযোগ পেত। যে আন্দোলন তরবারি ও কলম উভয় মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করেছিল। সেই আন্দোলনের প্রভাবই শাহ আব্দুল আজীজ, হাজী শরীয়তউল্লাহ, দুদু মিয়া, তিতুমীর ও সাইয়েদ আহমেদ ব্রেলভীদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করেছেন। নয়তো আজীবন জ্ঞানবিমুখ বাংলার সমাজব্যবস্থা- বিদেশী বেনিয়াদের অঙ্গুলী হেলনে বারবার নিজস্ব সংস্কৃতি, জীবনাচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধ উপেক্ষা করে, একেক প্রকার রূপ পরিগ্রহ করত। আমি বলছিনা উপরোক্ত মুসলিম মণিষীরা আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানের চিরন্তন সমস্যাকে পুরোপুরি দূর করতে পেরেছেন, তবে তাদের প্রচেষ্টার মূল্য হিসেবে আমাদের তাহজীব-তামাদ্দুন একেবারে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আর এখন সেই আন্দোলনকে নতুনভাবে এগিয়ে নেওয়ার ও আরো সক্রিয় করবার ঐতিহাসিক দায়িত্বটি- আমাদের কাছেই ন্যাস্ত হয়েছে। কিন্তু এই যে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমাদের হাতে অর্পিত হয়েছে, তা পালনের জন্য যে যোগ্য ও মেধাবী জনসমষ্টি প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। সত্যি এটাই যে, আমরা প্রচন্ডরকম জ্ঞানবিমুখ। ইতিহাসের দায়িত্ব উপলব্ধি করতে হলেও যে পান্ডিত্যের অধিকারী হতে হয়, সেই পান্ডিত্য আমাদের নেই। ফলে আমরা সামাজিক অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের জনসমষ্টি অত্যধিক অপরাধপ্রবণ। আমরা ক্ষয়প্রাপ্ত মূল্যবোধের বিচ্ছিন্ন শিকড় খেয়ে বাঁচি। আমরা কানামাছি খেলার মত চোখ বেঁধে পাশ্চাত্যের পেছনে ছুটি। আমরা নিজস্বতাকে কোরবানি করে ভিনদেশী আচার-অভ্যাস ও জীবনপ্রণালীকে নিজের বলে ভাবি। সামান্য পড়া-লেখার বিনিময়ে যুক্তিহীনভাবে নিজের ধর্ম ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে বসি। অথচ ধর্ম ও মূল্যবোধের শিক্ষা বিষয়ে স্বয়ং টমাস আলভা এডিসনের উক্তি ছিল, ''Moral teaching is the thing we need most in this world, and many of these men could be great moral teachers if they would but give their whole time to it, and to scientific search for the rock-bottom truth, instead of wasting it upon expounding theories of theology which are not in the first place firmly based. What we need is search for fundamentals, not reiteration of traditions born in days when men knew even less than we do now.''
আমরা রাজনীতিতে কোনো মূল্যবোধ মানিনা, অর্থনীতিতেও না। আর সংস্কৃতিতেতো একেবারেই না। এসব ত্রুটির পেছনে যে অজ্ঞানতা ও অসচেতনতা দায়ী, তা আমরা নিজেদের অধঃপতনে দিনকে দিন আরো ত্বরান্বিত করে চলছি। এ অবস্থায় কেবল সচেতন, অধ্যয়নমুখী ও কর্তব্যনিষ্ঠ একদল মানুষ : যারা আমাদের সামগ্রিক পচনরোধে ঐতিহাসিক দায়িত্বের সারমর্ম জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরতে পারবেন, তারাই হবেন সার্থক। আমরা যে প্রজন্ম লালন করছি, তাদের দু’কানে আছে হেডফোন। তারা ফেসবুক, ভাইবার, ইন্টারনেটের অপ ব্যবহারে অভ্যস্ত। তারা অবাধ মেলামেশায় আসক্ত। তারা পাশ্চাত্যের করাল থাবার সবচেয়ে দুর্বল শিকার। তাদের কাছে ধর্ম কোনো সামগ্রিক চিন্তা বা জীবনব্যবস্থা নয়, বরং তা কেবলই কতগুলো কষ্টকর ইবাদাতের সমষ্টি যা অভিভাবকরা কদাচিৎ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন মাত্র। ইহকালীন ক্যারিয়ার গঠন ছাড়া তাদের কাছে জীবনের উচ্চতর কোনো তাৎপর্য নেই। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াটা এই প্রজন্ম তেতো ঔষুধের মত গেলে বটে, কিন্তু শিক্ষা ও জ্ঞানের দাবি তাতে কিয়দংশও পূরণ হয়না। এখন মিউজিক ভিডিও, কম্পিউটার গেমস, পর্নোগ্রাফি, মুভি ও টিভি সিরিয়ালে আসক্ত এই যে বিপুল জনগোষ্ঠী- তাদের কী করে আপনি জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করবেন, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি জ্ঞানের রাজ্যে অনুপ্রবেশের মানসিকতা তৈরী করা যায় তবে, চিন্তার রাজ্যে বিপুল পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব হবে। আর চিন্তার রাজ্যে পরিবর্তনের সূত্র ধরেই আসবে, প্রত্যাশিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন। মানবতাকে তখন সর্বোত্তম আদর্শ ও মূল্যবোধে পরিচালিত করার মত অনুকূল পরিবেশও তৈরী হয়ে যাবে। কিন্তু একাজ অনেক কঠিন। তবে অবশ্যই অসম্ভব নয়। আমরা যেভাবেই হোক অধ্যয়নের অভ্যাস গঠনেই আপাতত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। পড়াশোনার উদ্বোধনের মাধ্যমে অন্তত প্রথম বড় কাজটিকে এগিয়ে নিতে পারি। এক্ষেত্রে সিলেবাস না ধরিয়ে বরং কী করে মানুষের জানার আগ্রহ ও পড়বার অভ্যাস তৈরী করা যায়, সেটাই মুখ্য বলে ভাবা উচিত। শেষ করব ম্যারিলিন স্যাভান্টের উক্তি দিয়ে, “To acquire knowledge, one must study; but to acquire wisdom, one must observe.”
বিষয়: বিবিধ
১৩০০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য এ লড়াই অবিরাম করে যেতে হবে।
একটা সময় ছিলো যখন আমরা বিনোদনের জন্য হলেও গল্পের বই পড়তাম কিন্তু এখনকার বাচ্চারা ভিডিও গেইমে নিমজ্জিত থেকে বিনোদনের দাবি পূরণ করে!
অজ্ঞানতা একটা ব্যাপক বিষয়- এর পরিধি ও বিশাল। সবার পক্ষে সব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয় কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলো জানা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য সবাইকে শ্রম দিতে হবে।
অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য এ লড়াই অবিরাম করে যেতে হবে।
লিখাটি ভালো লেগেছে । শুকরিয়া ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন