বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী হুমায়ুন আহমেদ
লিখেছেন লিখেছেন আরিফিন আল ইমরান ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০১:৩৬:৫২ রাত
বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বুদ্ধদেব, তারাশংকর, মাণিক, বিভূতিভূষণ হয়ে বাংলা উপন্যাসের বর্তমান যে সুবিশাল পরিসর তার মাঝে হুমায়ুন আহমেদ এক অনবদ্য নাম। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বাংলা উপন্যাসকে যার উজ্জ্বলতা ভাস্বর হয়ে থাকবে অনাদিকাল।
সাহিত্যে পদার্পণের খুব স্বল্প সময়ের ব্যাবধানে স্বাধীন বাংলাদেশের উপন্যাসে হয়ে উঠেছেন প্রধান সেনাপতি। এদেশের উপন্যাসে স্বকীয়তার এমন নজির আর নেই। অন্যরা যেমন পূর্বসূরীদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রভাবিত তিনি তেমন নন। সচেতনভাবে এমন এক সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন যার অন্ত্যমিল বা নৈকট্য বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়না। অন্য সব ঔপন্যাসিকদের থেকে এমন পৃথক করে নিজস্ব বলয় বিনির্মাণ - এককথায় অসাধারণ ।
অসামান্য তার গল্প বলার ভঙ্গি। সাবলীল তার চরিত্র নির্মাণের দক্ষতা। তার উপন্যাস রসমাধুর্যে এতোটাই নিটোল যে শুরু হলে পাঠককে অনায়াসে নিয়ে যায় শেষ অবধি। রসের পাশাপাশি কি এক অদ্ভুত রহস্য জড়িয়ে থাকে তার সমগ্র সাহিত্যে। যেন ইচ্ছা করেই পাঠকদের দাঁড় করিয়ে দিতে চান অমীমাংসিত সব প্রশ্নের সামনে।
মহাজাগতিক অনেক বিস্ময়কর রহস্য তিনি তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন যা হয়তো অনেককে আলোড়িত করে এসেছে আজীবন। শুধু দৃশ্যমাণ বস্তু জগতের রহস্য নয়; তিনি আমাদের মনস্তত্ত্বের ভেতরকার অনেক জটিল বিষয়াবলীকেও খুব সহজভাবে আলোকপাত করেছেন। বাংলাদেশী আপামর মানুষের মানসরাজ্য সম্পর্কে তার ধ্যাণ-ধারণা এতো সুস্পষ্ট ছিল বলেই হয়তো সম্ভব হয়েছে তা। এদেশের মানুষের জীবন-যাপন, অভাব-অনটন, প্রেম বিরহ, খেয়ালিপণা, ধর্মবোধসহ সব আবেগ অনুভূতি নিয়েই তার পর্যাপ্ত জানাশোনা ছিল যা বড় লেখক হিসেবে তার অবস্থানকে সন্দেহাতীত করেছে।
নিজস্ব স্টাইল দাঁড় করানোটা সব লেখকের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। হুমায়ুন আহমেদ তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ থেকেই তার পৃথক স্টাইল দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। একই কথা প্রযোজ্য তার সায়েন্স ফিকশন রচনাবলী ও ছোট গল্পের ক্ষেত্রে। এখানেও তার শক্তিশালী স্বকীয়তা আমাদের বিস্মিত করে।
একে একে উপহার দিয়েছেন-এই সব দিন রাত্রি, জনম জনম, অয়োময়, কৃষ্ণপক্ষ, অপেক্ষা, মেঘ বলেছে যাব যাব, ময়ূরাক্ষী, হিমু, গৌরিপুর জংশন, বৃষ্টি বিলাস, রুমালি, মৃন্ময়ী,দেবী, নিশীথিনী, মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য, বোতল ভূত, ফিহা সমীকরণ, আজ হিমুর বিয়ে, জোছনা ও জননীর গল্প, মধ্যাহ্ন প্রভৃতি সহ শতাধিক অনবদ্য সফল উপন্যাস।
হুমায়ুন আহমেদকে বলা হয়-‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিশ্বস্ত গল্পকার’। অথচ উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সমগ্র জীবনের অনুষঙ্গ বর্ণনাতেও তার দক্ষতার কমতি ছিল না কখনো। একদম শ্রেণীহীন মানুষের কথাও উঠে এসেছে তার কলমে। চায়ের দোকানি, ফুটপাতের টোকাই, রাস্তার ভিখারী ইত্যাদি চরিত্র তৈরীতে যত্নের ছাপ রেখেছেন। তার উপন্যাসের নায়ক বাংলা সাহিত্যের অন্য সব নায়কদের চেয়ে পৃথক বৈশিষ্ট্যধারী। সহজ-সরল, ভীতু আর পলায়নমুখী তার নায়কেরা। অন্যদিকে নায়িকারা যেন ক্লিওপেট্রার মত অনিন্দ্য সৌন্দর্যের অধিকারিণী। পরিস্থিতি সামাল দেবার দক্ষতার পাশাপাশি তাদের মাঝে সমন্বয় ঘটে খেয়ালি মনোভাবের।
হুমায়ুন আহমেদের বিস্ময়কর সৃষ্টি তার ‘হিমু’ আর ‘মিসির আলি’ নামক পৃথক দুইটি চরিত্র। এদের মধ্য দিয়েই তিনি অধিষ্ঠিত হন কিংবদন্তীর আসনে। তার জনপ্রিয়তা হার মানায় সমকালীন সকল সাহিত্যিকদের। হিমু আর মিসির আলি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়- বাংলা সাহিত্যের অন্য সব জনপ্রিয় চরিত্রকে।
তার অভাবনীয় জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারন-তার ভাষাগত সহজবোধ্যতা। জটিল ভাষা,শব্দ আর উৎপ্রেক্ষার স্থলে, তিনি ব্যবহার করেছেন সব মানুষের বোধগম্য সরল বিকল্প। অতিরিক্ত বিশ্লেষণ অথবা সুগভীর কোনো তাত্ত্বিকতা প্রয়োগ করেননি। পুরো লেখা এগিয়ে যায় মজার সংলাপে। আর সবকিছু নিয়েই একধরনের রসিকতা পাওয়া যায় তার পরতে পরতে। বিমূর্ত রসের আকর্ষণে মোহিত হয়ে, পাঠক নিমেষেই ভুলে যায় শ্রমসাধ্য বইপড়া। ছেলে,বুড়ো,মধ্যবয়সী সবাই তার লেখা পড়েছে গোগ্রাসে। তারপর একসময় বইপ্রকাশনী আর বইমেলার নির্ভরতার পরম জায়গা হয়েছেন তিনি। তাকে বাদ দিয়ে গত দুই দশকে কোনো বইমেলার সার্থকতা ছিল চিন্তারও বাইরে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়তো এসব বিবেচনা করেই তাকে- ‘শরৎচন্দ্রের চেয়েও জনপ্রিয় লেখক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সাহিত্যের বাইরে নির্মাণ করেছেন অসংখ্য টিভি নাটক এবং কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন বা দুই দুয়ারীর কথা দর্শকরা মনে রাখবেন বহুদিন। অন্যদিকে তীব্র হাস্যরসে পূর্ণ একপর্বের নাটকে দিয়েছেন অপার বিনোদন। এদেশে সত্যিকার অর্থে মেগা সিরিয়াল তিনিই প্রথম তৈরী করেন। ‘বহুব্রীহি’ অবশ্যই সেই দাবি করতে পারে। ধারাবাহিক নাটকে তার অনবদ্য সাফল্য চূড়ান্তে পৌঁছে যায়-‘কোথায় কেঊ নেই’ এর মধ্য দিয়ে। ২০০০ সালের পরে নিয়মিত নির্মাণ করে গেছেন একের পর এক নাটক আর চলচ্চিত্র। জনপ্রিয়তাও পেছে সেসব তার জাদুকরী প্রভাবে। সুস্থধারার বিনোদন চর্চায় এসব নাটক,সিনেমার অবদান অনেক।
হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য সমালোচকরা তাকে সিরিয়াস সাহিত্য না লেখার জন্য সরাসরি আক্রমণ করেছেন তীব্র ভাষায়। বালখিল্যতা আর অত্যধিক ভাঁড়ামোর অভিযোগও উঠেছে। তবে একথা সত্যি যে বাস্তবতা বিবর্জিত অতিমাত্রার নাটকীয়তা তার চরিত্রগুলিকে দুর্বল করেছে অনেক ক্ষেত্রে। একই ধরণের সস্তা রসিকতা খুঁজে পাওয়া যায় অনেক উপন্যাসে। যা তার রচনাবলীর দুর্বল দিক। আবার উপন্যাসের সাথে খুব বেশি মৌলিক কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়না তার ছোট গল্পের মাঝে। মনে হয় যেন গল্পগুলিও উপন্যাসেরই প্রভাবাধীন সরলার্থ।
জনপ্রিয়তা ধরে রাখবার জন্য উচ্চমার্গীয় রচনায় হাত দিতে পারেননি। ক্রমাগতভাবে পাঠকদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে লেখক যেন সমঝোতা করেছেন নিজের মেধার সাথে। প্রচুর লিখতে হয়েছে তাকে আজীবন যে কারণে মাণগত উৎকর্ষতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। অতিমাত্রায় সহজ আর রসাত্নক হতে গিয়ে ক্ষুন্ন করেছেন নিজের পরিমিতিবোধ। বারবার একইভাবে পুনরাবৃত্তি হয়েছে কাহিনী, চরিত্র, রস-রসিকতা আর নাটকীয়তা। তার নাটক, চলচ্চিত্রেও এই বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি সহজেই চোখে পড়ে যায়।
সহজাত গল্প তৈরীর দক্ষতাকে পুঁজি করে, অনেক সীমিত আকারের ঘটনাকে রূপায়িত করেছেন-গতিশীল উপন্যাসে। কিন্তু বারবার সফল হয়নি এই জাদু। প্রতিটি রচনার পেছনে ধারাবাহিক পরিশ্রম, অনুধ্যাণের সময় তার ছিলনা। অতিরিক্ত লেখার কারণে সাহিত্যের সুর, তাল, লয়ের সংগতি বজায় থাকেনি সবসময়। সম্ভবত বাণিজ্যিকতাই পরবর্তীতে তার শিল্পের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরো অনেক সমালোচনা আছে ব্যক্তি ও কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে। সেসব সুদীর্ঘ পরিসরে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তবে সব সমালোচনা সত্ত্বেও বাংলা উপন্যাসে তার অবদান অসামান্য। কথাশিল্পকে তিনি সবশ্রেণীর মানুষের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন।
প্রযুক্তির জয়জয়াকারের যুগে হুমায়ুনের কারনেই বইমুখী হয়েছে অগণিত মানুষ। বাংলাদেশের অসংখ্য কিশোর-তরুণ,যুবক-যুবতীর বইপড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে তার মায়াবী লেখার জন্য। বাংলাদেশের মানুষের নেতিবাচক এবং ভারাক্রান্ত জীবন দর্শণের মূলে আঘাত করে এনে দিয়েছেন আনন্দের আস্বাদ। সকল বাঙ্গালীর ভেতরে যে দুঃখবিলাসি চেতনার স্রোত, তাকে পাল্টে দিতে প্রয়োজন ছিল এই বিপুল আনন্দের। আমাদের সমাজব্যবস্থায় যুগ যুগান্তরের যেসকল দূষিত নিয়ম তাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপে জর্জরিত করবার অনিবার্যতা ছিল।
সর্বোপরি বাঙ্গালীকে সিরিয়াস জীবনবোধের বাইরে এনে বিস্ময়ে, আবেগে, কৌতুহলে, রসিকতায় পরিপূর্ণ করবার প্রয়োজন ছিল ভীষণ। একজন হুমায়ুন আহমেদ তা করে দেখিয়েছেন এবং প্রভাবের বলয়কে এত দূর পরিব্যপ্ত করেছেন যে, তা বাংলাদেশ পেরিয়ে বাংলাভাষী সকল মানুষের হৃদয়স্পর্শ করেছে ভীষণভাবে। কথাশিল্পীর পাশাপাশি নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার এবং ছবি আঁকিয়ে হিসেবে হুমায়ুন আহমেদ এক বিশাল আয়তনের ব্যক্তিত্ব।
জীবনভর পরিভ্রমণ করেছেন বিজ্ঞাণ আর সাহিত্যের বিশ্বব্যাপি পাঠশালায়। যার ছাপ পড়েছে স্বরচিত সমগ্র সাহিত্যের উপর। নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন অজস্র জ্ঞাণ আর তার বহুমুখী প্রয়োগে। তারপর ক্যানসারের সাথে যুদ্ধ করে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই চলে গেছেন পৃথিবীর নাট্যমঞ্চের বাইরে; যে মঞ্চে ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর এসেছিলেন আলো ছড়াতে। কিন্তু শরীরী মৃত্যু হলেও কালের বিচিত্র অভিঘাতে তার প্রভাব রয়ে যাবে এদেশের সংস্কৃতির অস্থি-মজ্জায়। কারণ রবীন্দ্রণাথ,শরৎচন্দ্র,নজরুল এবং সত্যজিৎ রায়ের পর হুমায়ুন আহমেদই বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রভাবশালি ব্যক্তিত্ব।
বিষয়: বিবিধ
১৭০৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন