আমাদের একদিনের দেশপ্রেম!
লিখেছেন লিখেছেন মুক্ত জীবন ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৩:০১:৫৯ দুপুর
বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস কিংবা ভাষা দিবস, কোনটাতেই আমরা পিছিয়ে নেই। সবার আগে ফুল দেওয়া আর পতাকা হাতে রাস্তায় বেরিয়ে দেশপ্রেম দেখাতে আমাদের জুড়ি নেই।
এইতো, গত ১৫ ডিসেম্বর দেখলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে ফুল দেওয়া নিয়ে মারামারি, অবশেষে একজন নিহত। কি অসম্ভব দেশপ্রেম! আগে ফুল দিতে না পারলে আমার দেশপ্রেম তো অন্য সবার চাইতে ভাল মতো দেখানো হলো না। সুতরাং এই দেশপ্রেমের জন্য প্রয়োজনে যে কাউকে খুন করতেও আমরা রাজি। কিন্তু ফুল দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবার সময়, ফুটপাত ধরে ধীরে চলতে থাকা ছেঁড়া কাপড় পরিহিত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে সজোঁরে ধাক্কা দিয়ে "কি অপদার্থ, অকর্মা লোকজন রাস্তায় ঠিকমতো চলতে পারেনা, এরা কেন যে রাস্তায় বের হয়!" এমন কথা বলতে দেরি হয় না!
ফুটপাতে অচল ছোট্ট এতিম শিশুটি ভিক্ষার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই সজোরে লাথি মারতেও আমাদের একটু দেরি হয় না। আর আমাদের মুখে বেরিয়ে আসে শালা শু.... বাচ্চা, দিনটাই মাটি করে দিল! কি অপূর্ব দেশপ্রেম! কি অসম্ভব ভালবাসা দেশের মানুষের জন্য।
আমার এক বন্ধুর সে কি প্রচন্ড দেশপ্রেম! চৌদ্দগুষ্টির কেউ মুক্তিযুদ্ধের ধারে কাছে না থাকলেও সে নাকি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি! মিছিলের সামনের কাতারে তার সরব উপস্থিতি আর কান ফাটানো মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান শুনে রীতিমতো মনে হয় নয়া মুক্তিযু্দ্ধে লিপ্ত। সে বেসরকারী কোম্পানীর চাকুরীজিবী। বেতন পায় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। সংসারে অভাব নেই, তবুও তার লক্ষ্য চট্টগ্রাম বন্দরে চাকুরী। বন্দরে বেতন কত? সর্বসাকুল্যে ১১ হাজার! ঘুষ দিতেও রাজি লাখ বিশেক।
বন্ধু তুমি এত কম বেতনে চট্টগ্রাম বন্দরে চাকুরী করে সংসার কিভাবে চালাবা আর তোমার বিশ লক্ষ টাকা কি বেতন পেয়ে উঠবে?
আরে কি যে কও! আমি কি বেতন পাওয়ার জন্য বন্দরে চাকুরী করবো নাকি? একবার চাকুরি হলে ঐখানে বিশ লক্ষ টাকা উঠবে ছয় মাসে। তার পর তো শুধু টাকা আর টাকা!!
বন্ধু তুমি তাইলে চাকুরী করবা দুই নম্বরি করার জন্য? তোমার উদ্দেশ্য কাজ নয়, চুরি?
আরে কি যে কও, চুরি কেন? ওইডা তো উপরি ইনকাম।
এতে তো দেশের ক্ষতি হচ্ছে তাই না?
আরে রাখো তো মিয়া তোমার দেশপ্রেম! আমার ভাই খাদ্য অধিদপ্তরে চাকুরী করার আগে মানুষের কাছে ধার-দেনা ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর চাকুরী পাওয়ার পর গত চার বছরে সে কয়েক কোটি টাকার মালিক হইছে।
তাইলে বন্ধু তুমি যে এত দেশপ্রেম দেখাও যে?
আরে দেশপ্রেম দেশপ্রেমের যায়গায়, আর টাকা টাকার যায়গায়। তুমি ওসব বুঝবা না!
এইতে সেদিন ১৫ ডিসেম্বর রাতে, মহল্লার মেইন রাস্তার মোড়ে প্যান্ডেল বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষন চালাচ্ছে। দেশাত্নবোধক গান বাঁজছে। সাথে নেতারা বসে বসে কেউ ১০ টাকা কেউবা তার চাইতেও দামি একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকাচ্ছে। বুড়ি একজন মহিলা এসে, হাত পেতে "বাজান দুইডা টাহা দেন" বলতেই, চামচা গোছের একজন বলে উঠল, "ওই বুড়ি এত রাইতে কি? যাওগা"। বুড়ি ফ্যাল ফ্যাল করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চলে গেল। এরপর চামচা'টা কে দুইশ টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিল নেতা, যা, হাবিবের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেটা লইয়ায়। একটু পর দেশাত্নবোধক গানের পরিবর্তে মাইকে শুনা যাচ্ছে, "...তুনে মারি এন্ট্রি...."
এই হলো আমাদের দেশপ্রেম। আমরা মুখে লোক দেখানো দেশপ্রেমের কথা বলি, দেশপ্রেম দেখাই। আর আমাদের অন্তরে যত দেশদ্রোহী চিন্তা, কর্মে যত দেশ বিরোধী কাজ। দেশকে ভাল বাসতে হলে, বড় রাজনীতিবিদ হতে হয় না, সরকারী চাকুরীজিবী হতে হয় না, দেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হয় না। শুধু সদিচ্ছা থাকলেই হয়।
একটু কম খেয়ে-পরে, কম বিলাসিতা করে, দেশের সম্পদ চুরি না করে, নিজের চেষ্টায় সৎ পথে আয় রোজগার করে, শুধু সৎ জীবন যাপন করলেই হতে পারে আমাদের বড় দেশপ্রেম। কাউকে কিছু দান করার মতো আমার অঢেল অর্থ-সম্পদ থাকতে না পারে, কিন্তু আমি যদি আমার আশেপাশের মানুষগুলোর সাথে একটু হাসিমুখে কথা বলি, কারো মনে কষ্ট না দিই তবে, স্মৃতিসৌধে আগে ফুল দিতে গিয়ে মানুষ খুন করার চাইতে সেটা হতে পারে বড় দেশপ্রেম।
দেশপ্রেমের জন্য রাস্তার মোড়ে টাকা খরচ করে মাইক ভাড়া করে ভাষণ শোনার প্রয়োজন হয় না। বরং ওই টাকায় কিছু খাবার কিনে আমরা অনেক অসহায় বুভুক্ষ মানুষকে এক বেলার খাবার কিনে দিতে পারি।
দেশকে ভালবাসতে হলে, মাথায় পতাকা বেঁধে, পতাকা হাতে মিছিল করে, কিংবা হাতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে দেখানোর দরকার হয় না। বরং সেই পতাকা আর ফুলের টাকায় একটি অসহায় এতিম শিশুকে কিছু খাবার দেওয়া যায় কিংবা একটি শীতবস্ত্র কিনে দেওয়া যায়।
ভাবুনতো, ওই এক ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ আর ২১ ফেব্রুয়ারীতে আমরা দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে, শত শত কোটি টাকার ফুল ক্রয় করে এক মূহুর্তের দেশপ্রেম দেখাই, আর ফিরে গিয়ে চুরি-চামারীতে মেতে উঠি। এই শত কোটি টাকা যদি এক ফান্ডে জমা করি, তবে প্রতিবছর এই টাকা দিয়ে আমরা কয়েক লক্ষ মানুষকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারি। বছরের পর বছর আমরা যদি এমন কোন কার্যক্রম চালাতে পারতাম তবে দেশে হাত পাতা মানুষের পরিমান খুব দ্রুত কমে আসতো। দেশের মানুষকেই যদি ভালবাসতে না পারলাম তবে কিসের আমার দেশপ্রেম? দেশপ্রেম কোন লোক দেখানো বিষয় নয়। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করে দেখানোই দেশপ্রেম। কারো জন্যা কিছু করার সাধ্য না থাকলেও দেশের টাকা চুরি না করাও এক দেশপ্রেম।
আর কিছু করতে না পারি, চলুন দেশের টাকা চুরি করা বন্ধ করেই দেখাই আমাদের দেশপ্রেম।
বিষয়: বিবিধ
১১২২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
sobai to deshpremik shaje, tai ami eibar rajakar shajar try korechilam. :p
মন্তব্য করতে লগইন করুন