এক ‘রোহিঙ্গা প্রিন্সেসের’ কাহিনী

লিখেছেন লিখেছেন রাজ্পুত্র ০১ জুন, ২০১৬, ১১:৪৫:০৪ সকাল

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে দেশটির ধারাবাহিক সরকারগুলো এতোটাই নিপীড়ন করেছে যে তাদের মধ্যে কোনো নেতৃত্বও বলতে গেলে তৈরি হয়নি। ফলে রোহিঙ্গারা মার খেলেও তাদের কোনো প্রতিবাদী কণ্ঠ দেখতে পাই না আমরা।

তবে আশার আলো দেখাচ্ছেন ওয়াই ওয়াই নু নামের এক সংগ্রামী তরুণী।

তিনি যখন তার নিপীড়িন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে কথা বলেন তখন তার মায়াবী মুখটি বদলে যায়, তার চোখ গাঢ় হয়ে আসে, তার দৃপ্তপৃষ্ঠ যেন উত্তেজনার বার্তা দেয়, তার কণ্ঠ বজ্রনিনাদী হয়ে ওঠে।

‘সরকার এখন অস্বীকার করে বসছে যে কোনোকালে আমাদের অস্তিত্ব ছিল,’ বলেন ওয়াই ওয়াই।

মিয়ানমারে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার বাস। কয়েক শতাব্দী ধরে তারা দেশটিতে বাস করলেও তাদেরকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে সরকার। বহু রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে দেশান্তরিত হয়েছেন কিংবা আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয় শিবিরে।

২৯ বছর বয়সী ওয়াই ওয়াই এখন নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। পেশায় আইনজীবী এই নারী বিশ্বাস করেন যে তিনি মিয়ারমারের নতুন সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হবেন যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার।

ওয়াই ওয়াই বলেন, এজন্য তিনি প্রয়োজনে সন্ন্যাসব্রতের জীবন বেছে নেবেন এই অর্থে যে তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন বিসর্জন দেবেন। তার লক্ষ্য বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ২ লাখ লোককে রাখাইনের পুলিশ পাহারার আশ্রয়শিবির থেকে মুক্ত করা।

জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প, অবিচার আর বৈষম্য এই তরুণীর জীবনেও ট্যাঙ্কের মত গড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিশ্বাস করতো যে একজন রোহিঙ্গা রাজনীতিকের কন্যার স্বাধীনতার অধিকার থাকতে পারে না।

এই অপরাধে তাকে ১৭ থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত রেঙ্গুনের একটি কারাগারে জীবন কাটাতে হয়েছে।

ওয়াই ওয়াইর বাবা দেশটির নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদ্য কিয়াও মিনকে ৪৭ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত। ওয়াই ওয়াই তখন আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দুই মাস পরে তার মা, তার বোন এবং ভাইকেও ১৭ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

‘জেলের খাবার, কারাগারের পরিবেশ সবই আমি মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু আমি আর লেখাপড়া করতে পারব না, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না,’ ডেইলি বিস্ট পত্রিকাকে বলছিলেন ওয়াই ওয়াই।

জেলে তার মত আরো রোহিঙ্গা তরুণী ছিল। তিনি তাদের সাথে কথা বলতেন। তাদের অনেকে হতাশায় ভেঙে পড়ে মাদকগ্রহণ ও পতিতাবৃত্তিতেও জড়িয়ে পড়ে। এসব দেখে ওয়াই ওয়াই সিদ্ধান্ত নেন তিনি নারী অধিকারকর্মী হবেন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়বেন।

আট বছর কারাবন্দি থাকার পর ওয়াই ওয়াই নু এবং তার উইমেন’ পিস নেটওয়ার্ক ‘ন্যায়বিচার’ এবং মানবাধিকার সম্পর্কে ৫০০ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয়, যাদের বেশিরভাগই নারী।

কয়েক মাস আগে ওয়াই ওয়াই এবং তার বাবা রোহিঙ্গাদের একটি উদ্বাস্তু শিবিরে যান। তারা দেখেন সেখানকার তরুণ তরুণীরা হতাশায় ভেঙে পড়েছেন।

তিনি তাদের আশার বাণী শোনান যে শিগগিরই তাদের জীবনে স্বাধীনতা আসবে।

এখন ওয়াই ওয়াই নুকে তার অনেক ফেসবুক ফ্রেন্ড ‘রোহিঙ্গা প্রিন্সেস’ বলে ডেকে থাকেন। তবে এ উপাধি তার পছন্দ নয়। তিনি মাঠের সৈনিক হিসেবেই কাজ করতে চান।

‘আমি প্রিন্সেস নই। আমি জানি না এখনই কীভাবে এসব সংখ্যালঘুকে মুক্ত করতে হবে। কিন্তু আমি একটি জিনিস জানি যে আমার স্বপ্ন আছে। আমি ভালো মানুষ হতে চাই এবং এসব লোকদের জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা চাই।’

আট বছরের কারাবন্দি জীবনে ওয়াই ওয়াইর অনুপ্রেরণা ছিলেন দুজন মানুষ। একজন মিয়ানমারের নোবেলজয়ী গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচি, যিনি সে সময় গৃহবন্দি ছিলেন এবং অন্যজন আমেরিকান রাজনীতিক এবং তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামা (বর্তমানে প্রেসিডেন্ট)।

‘আমার মনে হয়েছে ওবামা নির্বাচনে জয়ী হলে তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রকেই বদলে দেবেন না, তিনি পুরো বিশ্বকেই বদলে দেবেন।

গত বছর ওই তরুণীকে হোয়াইট হাউজের নৈশভোজে দাওয়াত দেন ওবামা। সে সময় তিনি মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান।

সেই নৈশভোজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ওয়াই ওয়াইর মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যায়।

‘আমি ছিলাম টেবিলে একমাত্র বিদেশি। বাকি আটজন ছিল আমেরিকান। মজার ব্যাপার হলো সেখানে যখন আমার নিজের পরিচয় দেয়ার সময় এলো তখন আমাকে কিছু বলতে হলো না। প্রেসিডেন্টই আমার সম্পর্কে সব কথা বলে দিলেন। কিন্তু আমি সম্ভবত প্রেসিডেন্টকে হতাশ করেছিলাম এই বলে যে মিয়ানমার সম্পর্কে তার নীতি কোনো সফলতার গল্প নয়। কারণ আমরা দেখছি মিয়ানমারজুড়েই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে বর্বরতা চলছে।’

তরুণ তরুণীদের মনে আশার সঞ্চার করতে তিনি সপ্তাহে সাতদিনই খুব ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেন।

তার প্রশিক্ষণ পাওয়া ১৮ বছরের এক তরুণী পায়ে সোন সু বলছিলেন, ‘ওয়াই ওয়াই নুর প্রশিক্ষণ ক্লাসে আসার পর থেকে আমার জীবনটা বদলে গেছে। তিনি আমার বোন, শিক্ষক এবং অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়েছেন।’

প্রেসিডেন্ট ওবামার দাওয়াত পেলেও এখনো তার আরেক রোল মডেলে সুচির পক্ষ থেকে দাওয়াত পাননি ওয়াই ওয়াই নু।

সুচি এখন মিয়ানমারের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে।

ওয়াই ওয়াই নুর আশা সুচি সহসাই রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করবেন।

তার আশা তিনি সুচির সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন এবং তখন সুচিকে বলবেন, ‘তিনি দেশকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা তখনই স্বার্থক হবে যখন এই প্রক্রিয়ায় সবাই অংশ নেয়ার সুযোগ পাবেন।’

‘আমি সুচিকে বলব যে রোহিঙ্গাদের সমান অধিকার থাকা উচিত। তিনি হয়তো এটা জানেন কিন্তু আমি আরেকবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।’

ডেইলি বিস্ট অবলম্বনে ফাতিমা ফেরদৌসী আশা

বিষয়: বিবিধ

১৫৩১ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

370595
০১ জুন ২০১৬ সকাল ১১:৫৬
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
০১ জুন ২০১৬ দুপুর ১২:১২
307499
রাজ্পুত্র লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
370614
০১ জুন ২০১৬ দুপুর ০২:৫৭
আবু জান্নাত লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইর, শেয়ার করার জন্য শুকরিয়া।
০১ জুন ২০১৬ রাত ০৯:৪৯
307537
রাজ্পুত্র লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।Good Luck
370630
০১ জুন ২০১৬ বিকাল ০৫:৫৪
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : মন্তব্যটি পোস্ট রিলেটেড নয়।
রমজান নিয়ে ব্লগীয় আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অংশ নিতে পারেন আপনিও। বিস্তারিত জানতে-
Click this link
০১ জুন ২০১৬ রাত ০৯:৫০
307539
রাজ্পুত্র লিখেছেন : আপনার লিংকটা বুঝতে পারলাম না।
370657
০১ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:২১
শেখের পোলা লিখেছেন : আল্লাহই ভাল জানেন। ধন্যবাদ।
০১ জুন ২০১৬ রাত ০৯:৫৪
307546
রাজ্পুত্র লিখেছেন : মহান আল্লাহ সর্বজ্ঞানী। নিশ্চয় তিনিই সবচাইতে ভাল জানেন সবকিছু।
ধন্যবাদ।
370664
০১ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৫৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
০১ জুন ২০১৬ রাত ০৯:৫২
307542
রাজ্পুত্র লিখেছেন : ধন্যবাদ।Good Luck
370703
০২ জুন ২০১৬ রাত ০২:০৩
আমীর আজম লিখেছেন : ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
০২ জুন ২০১৬ রাত ১০:১৩
307697
রাজ্পুত্র লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File