মিশরের একজন ইসলামী বীরের কথা: নিজে বীর হওয়ার জন্য সত্যিকারের বীরকে জানা দরকার
লিখেছেন লিখেছেন রাজ্পুত্র ১৭ আগস্ট, ২০১৫, ১০:৩১:৩০ রাত
বর্তমানে আমাদের যে অবস্থা তাতে সত্যিকারের বীরের সংখ্যা খুবই কম। এখন বেশীর ভাগ মানুষ চাটুকারিতায় অভ্যস্থ। যার ফলে বীর তৈরী হয় না্। মানুষ চাটুকারিতাকেই জীবণ মনে করে। দুনিয়াতে অবৈধ পথে টাকা রোজগার করে ধনী হওয়াকেই জীবনের স্বার্থকতা মনে করে। আসলেই কি এটা সত্যিকার জীবন? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনেকরি এটা সত্যিকারের জীবন নয়। সত্যিকারের জীবন সেটায় যেখানে ত্যাগ আছে। যেখানে মানুষের ভালবাসা আছে।
এরকম একজন মানুষের কথাই সবার সামনে বলতে চাই যিনি লিখেছেন ''ফী যিলালিল কুরআন (৬ খণ্ড)'' এর মত গ্রন্থ। সত্যিই তার সংগ্রামী ইসলামী জীবন আমাদের জন্য সঠিক শিক্ষা হতে পারে।
নাম ও বংশ পরিচয় :
নাম সাইয়েদ। কুতুব তাঁদের বংশীয় উপাধি। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিসরের উত্তরাঞ্চলে মূসা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী ইব্রাহীম কুতুব। মায়ের নাম ফাতিমা হুসাইন ওসমান। তিনি অত্যন্ত দ্বীনদার ও আল্লাহভীরু মহিলা ছিলেন। সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সনের ২০শে জানুয়ারী শুক্রবার পিত্রালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড় সন্তান। মেজো মুহাম্মদ কুতুব। তারপর তিন বোন, হামিদা কুতুব, আমিনা কুতুব, তৃতীয় বোনের নাম জানা যায়নি।
শিক্ষা জীবন:
মায়ের ইচ্ছোনুযায়ী তিনি শৈশবেই পবিত্র কুরআন কণ্ঠস্থ (হিফয) করেন। তারপর গ্রাম্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করে দেয়া হয়। তখনকার একটি আইন ছিল, কেউ যদি তার সন্তানকে মিসরে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ৈ পড়াতে ইচ্ছে করতেন তাহলে সর্বপ্রথম তাকে কুরআন হিফ্য করাতে হতো। যেহেতু পিতা-মাতার ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল তাদের বড় ছেলে সাইয়েদকে আল-আজহারে পড়াবেন, তাই তাকে হাফেযে কুরআন বানান। পরবর্তীতে পিতা মূসা গ্রাম ছেড়ে কায়রোর উপকণ্ঠে এসে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন এবং তাঁকে তাজহীযিয়াতু দারুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। এ মাদ্রাসায় শুধু তাদেরকেই ভর্তি করা হতো যারা এখান থেকে পাশ করে কায়রো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাইত। তিনি এ মাদ্রাসা থেকে ১৯২৯ সনে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে দারুল উলুম কায়রো (বর্তমান নাম কায়রো ইউনিভার্সিটিতে) ভর্তি হোন। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৩৩ সনে বি, এ, পাশ করেন এবং ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন। এ ডিগ্রীই তখন প্রমাণ করতো, এ ছেলে অত্যন্ত মেধাবী।
কর্মজীবন:
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নেবার পর সেখানেই তাঁকে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বেশ কিছুদিন সফলভাবে অধ্যাপনা করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। এ পদটি ছিল মিসরে অত্যন্ত সম্মানজনক পদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেই তাঁকে ১৯৪৯ সনে শিক্ষার ওপর গবেষণামূলক উচ্চতর ডিগ্রী সংগ্রহের জন্য আমেরিকা পাঠানো হয়। সেখানে দু’বছর লেখাপড়া ও গবেষণা শেষে ১৯৫১ সনে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আমেরিকা থাকাকালিন সময়েই বস্তুবাদী সমাজের দুরাবস্থা লক্ষ্য করেন এবং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, একমাত্র ইসলামই আক্ষরিক অর্থে মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।
এরপর তিনি দেশে ফিরে ইসলামের ওপর ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণা শুরু করেন। সেই গবেষণার ফসল ‘কুরআনে আঁকা কিয়ামতের চিত্র’ ও ‘আল কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য’।
ইসলামী আন্দোলনে যোগদান :
আমেরিকা থেকে ফিরেই তিনি ‘ইখওয়ানুল মুসলিমুন’ নামক ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কর্মসূচী যাচাই করে মনোপুত হওয়ায় ঐ দলের সদস্য হয়ে যান। ১৯৫২ সনের জুলাই মাসে তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তখন থেকে তিনি পরিপূর্ণ ইসলামী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৫৪ সনে সাইয়েদ কুতুবের সম্পাদনায় ইখওয়ানের একটি সাময়িকী প্রকাশ করা হয়। কিন্তু দু’মাস পরই কর্ণেল নাসেরের সরকার তা বন্ধ করে দেন।
গ্রেফতার ও শাস্তি:
শুরু হয় ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদেরকে গ্রেফতার ও নির্যাতন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিল। সাইয়েদ কুতুবকে বিভিন্ন জেলে রাখা হয় এবং তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁরই এক সহকর্মী জনাব ইউসুফ আল আযম লিখেছেন: ‘নির্যাতনের পাহাড় তাঁর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল্ তাঁকে আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া হতো, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হতো, মাথার ওপর কখনো অত্যন্ত গরম পানি আবার কখনো অত্যন্ত ঠান্ডা পানি ঢালা হতো। লাথি, ঘুষি, বেত্রাঘাত ইত্যাদির মাধ্যমেও নির্যাতন করা হতো, কিন্তু তিনি ছিলেন ঈমান ও ইয়াকীনে অবিচল- নির্ভিক।– (শহীদ সাইয়েদ কুতুব’ পৃষ্ঠা-৩০)
১৯৫৫ সনের ১৩ই জুলাই বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে পনের বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তাঁকে নির্যাতন করে এতো অসুস্থ ও দুর্বল করা হয়, যার ফলে তিনি আদালতে পর্যন্ত হাজির হতে পারেননি। এক বছর সশ্রম দণ্ড ভোগের পর নাসের সরকার তাকে প্রস্তাব করেন, তিনি যদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। মর্দে মুমিন এ প্রস্তাবের যে উত্তর দিয়েছিলেন তা যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।
তিনি বলেছিলেন:
আমি এ প্রস্তাবে এ কারণেই বিস্ময় বোধ করছি যে, একজন জালিম কি করে একজন মজলুমকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলতে পারে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে তবু আমি এরূপ উচ্চারণ করতে রাজী নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমনভাবে পৌঁছুতে চাই যে, তিনি আমার ওপর এবং আমি তাঁর ওপর সন্তুষ্ট।
জেল থেকে মুক্তি লাভ:
১৯৬৪ সনের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর সফরে যান এবং তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করেন। ফলে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় দীর্ঘ ১০ বছরে বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর “ফি যিলালিল কুরআন’ রচনা করেন।
দ্বিতীয়বার গ্রেফতার ও শাহাদাত:
এক বছর যেতে না যেতেই তাঁকে ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অপবাদ দিয়ে আবার গ্রেফতার করা হয়। সাথে চার ভাই-বোনসহ বিশ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় ৭শ’ মহিলাও ছিল।
অতঃপর নামমাত্র বিচার অনুষ্ঠান করে তাঁকে এবং তাঁর দুই সাথীকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হয় এবং ১৯৬৬ সনের ২৯শে আগস্ট সোমবার তা কার্যকর করা হয়। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যুগে যুগে এসব মহান ব্যক্তিরা অনেক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন