একটি রূপকথার গল্প এবং এ কে খন্দকারের বক্তব্যের মুল্যায়ণ

লিখেছেন লিখেছেন রাজ্পুত্র ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৩:৫৩:৫০ দুপুর



স্বাধীনতাযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার সম্প্রতিকালে “১৯৭১-ভিতরে বাইরে” নামে একটি বই লিখেছেন। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতা ঘোষণার উপর বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বাক্যুদ্ধ চলছে। জাতীয় সংসদে বইটি নিষিদ্ধ এবং তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণার দাবী উঠেছে। সংসদের বাইরেও পক্ষে-বিপক্ষে বাক্যুদ্ধ চলছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতিকে কেউ কেউ এখন শত্রুপক্ষের এজেন্ট ও রাজাকার বলছে। নবীন প্রজন্ম দিশাহারা। বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ের বিষয়টি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখলে এ বিতর্কের পক্ষ-বিপক্ষের অনেক অজ্ঞতা দূর হবে।

বাংলাদেশাঞ্চলের অভ্যুদয়:

সাম্প্রদাযিক নীতিতে ১৯০৫ সালে ব্যর্থ হয়ে আঞ্চলিক নীতিতে বৃহত্তর বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী আবার ১৯১২ সালে বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশ এবং বঙ্গপ্রদেশে বিভক্ত করা হয়। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের “ইউনিয়নরাষ্ট্র” প্রস্তাবের বিপরীতে ১৯২৯ সালে মুসলিম লীগ প্রদেশ পুনর্গঠনসহ ভারতকে “যুক্তরাষ্ট্র” গঠনের প্রস্তাব দেয়। নুতন প্রদেশসহ ১৯৩৫ সালের “ভারত সরকার আইন”-এ মুসলিম লীগের দাবী প্রাধান্য থাকায় প্রথমে বর্জন করলেও ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস অংশ নেয়। গণতন্ত্রমুখী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চালুর পরে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ক্রমবর্ধমান হয়। স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের সাথে সাথে তা বেড়ে উঠে এবং সংঘর্ষিক ও দাঙ্গায় রূপ নেয়। ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন এবং ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মুলসমান জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ক্রমবর্ধমান হওয়ায় মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেসনে পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুাষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে পৃথক যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। লাহোর প্রস্তাব আন্দোলন ও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের গণম্যান্ডেটের ভিত্তিতে বৃটিশ-ভারত বিভক্ত হয়। প্রথমে হিন্দু মহাসভা এবং পরে কংগ্রেসের দাবীতে ১৯৪৭-এ বঙ্গপ্রদেশ বিভক্ত এবং পশ্চিমাংশ ভারতে ও পূর্বাংশ পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। নির্বাচনোত্তর মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেসনে (১৯৪৬) সোহরওয়ার্দীর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান ইউনিয়নরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠে। দিল্লী প্রস্তাবের ভিত্তিতে সোহরওয়ার্দীর ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।

তরুণ বয়সে মৌলানা ভাসানী বিপ্লবী (সন্ত্রাসবাদী) স্বরাজ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সন্ত্রাসমুখী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে ১৯০৫ সালে বৃহত্তর বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশকে বিভক্ত করা হয়। সরকারের রোষানল থেকে রক্ষার জন্যে তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। মৌলানা ভাসানী দেওবন্দ মাদ্রাসায় ও মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন (আমার দাদা) প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ পড়াকালে ১৯০৭ সালে সাঁড়াঘাটে পরিচয় এবং উভয়ই পাবনার হওয়ায় বন্ধুত্ব। দিল্লী যাতায়াতে মৌলানা ভাসানী কোলকাতায় ইসমাইল হোসেনের হোষ্টেলে আথিথেয়তা নিতেন। ইসমাইল হোসেন ১৯০৬ সালেই এফএ পড়াকালে মুসলিম লীগের ছাত্রসদস্য।

মাদ্রাসায় পড়া ও টুপিপরা যুবনেতা মৌলানা ভাসানী অনুশীলন, যুগান্তর, স্বরাজ, কংগ্রেস, ইত্যাদি দল করলেও মুসলিম লীগে যুক্ত হননি। বগুড়ায় বিয়ে করার পরে ইসমাইল হোসেনের (বগুড়ায় কর্মরত) যুক্তি-ব্যাখ্যা-তাগিদে অবশেষে তিনি ১৯৩০ সালে মুসলিম লীগে যোগদেন। পরবর্তীতে ১৯৩৭ ও ১৯৪৬ সালে সংসদ সদস্য এবং আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি হন। লাহোর প্রস্তাব উত্তর মোহাম্মদ ইসরাইল হোসেন (আমার আব্বা) মৌলানা ভাসানীকে এবং পাবনার মুসলিম লীগের সহকর্মী ছাত্র-যুব নেতাদের (মোকসেদ মন্ডল, মনসুর আলী, আমজাদ হোসেন, মোতাহার হোসেন তালুকদার, প্রমুখ) বোঝাতে সক্ষম হন যে, লাহোর প্রস্তাব ধরে রাখলেই ভবিষ্যতে পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবে। ১৯৩৩ সালে চৌধুরী রহমত আলীর এমন ভবিষ্যতব্য ছিল।

পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন খেতাবপ্রাপ্ত যুবনেতা মোকসেদ (গেঁদা) মন্ডল (ইসরাইল হোসেনের মামা) ও যুবনেতা মনসুর আলী যথাক্রমে তখন ইশ্বরদী ও কাজিপুর থানার মুসলিম লীগের সেচ্ছাসেবক গার্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার। আমজাদ হোসেন, মোতাহার তালুকদার, প্রমুখ (পরবর্তীতে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ সদস্য) তাঁর স্কুল-কলেজের সহপাঠী। মেধাবী ইসরাইল হোসেন প্রথমে প্রেসিডেন্সী ও পরে এডওয়ার্ড কলেজে পড়েছেন। তিনি স্বল্পকালীন পাবনা থানার মুসলিম লীগের ছাত্রনেতা ও গার্ড রেজিমেন্টের উপ-কমান্ডার ছিলেন। ইসলামিয়া কলেছে একইবর্ষে সহপাঠী ও ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও তখন তাঁর ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী হন। এজন্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ উত্তর সোহরওয়ার্দীকে ছেড়ে মৌলানা ভাসানী সাথে আসেন। ১৯৪৪-এর পরে ইসরাইল হোসেন ব্যক্তিগত কারণে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান।

১৯১২ সালে বেঙ্গল-প্রেসিডেন্সী প্রদেশ বিভক্তি, ১৯২৯ সালে মুসলিম লীগের ভারত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব, ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইন এবং লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭-এ বাংলাদেশাঞ্চলের ঊদ্ভুদয় হয়। ১৯৪৭-এ ঐতিহাসিক বিজয়গুলো হলোঃ ১) বৃটিশ ঔপনিবেসিক শাসনের অবসান, ২) সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি অবসান; ৩) ক্রমবর্দ্ধমান সংঘর্ষিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান; ৪) সামন্তব্যবস্থার অবসান ও প্রজাজীবনের মুক্তি; ৫) গণতান্ত্রিক ভূমিসংস্কার ও গণতান্ত্রিক জীবনধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; এবং ৬) স্বকীয় জাতিসত্ত্বাসহ স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ের ভিত্তি।

বাংলাদেশাঞ্চলের জনগণ বৃটিশামলে সাত প্রজন্মকাল ঔপনিবেসিক, সাম্প্রদায়িক ও সামন্তিক রাষ্ট্রনীতিতে শাসিত-শোষিত-নিষ্পেষিত প্রজাজীবন এবং প্রধানতঃ নিন্ম ও নিন্মমধ্যবিত্ত জীবনধারায় আবদ্ধ ছিল। দুই-তৃতীয়াংশ বাঙালী মৃসলমান জনতার জমিদারীত্বে ৭.০% এবং সরকারী কর্মে, ব্যবসায় ও নগরসভ্যতায় ১০.০% অংশীদারীত্বও ছিল না। ১৯৪৭-এর পরে বাংলাদেশাঞ্চলের জনগনের প্রজামুক্তিসহ উত্থান শুরু হয়। তাই বাংলাদেশাঞ্চলের মানুষ ১৯৪৭কে মুক্তি হিসেবেই দেখেছে। ১৯৪৭ উত্তর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুও স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই পাকিস্তানই করতে হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম’।

শেখ হাসিনার মতো বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর সন্তান ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু তৃতীয়শ্রেণীর কর্মচারীর সন্তান ও প্রজা হিসেবেই বড় হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সকলগুণে গুণান্বিত ব্যক্তিও ছিলেন না। বিএতে তৃতীয়শ্রেণী থাকলে বিশ্ববিদদ্যালয়ের শিক্ষক, বিসিএস কর্মকর্তা, বিচারক বা সেনা কর্মকর্তা হওয়া যায় না। কর্মজীবি হলে বঙ্গবন্ধুর জীবন শুরু হতো তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচানী হিসেবে। নিজের ও জাতির সেবার বহু পথের মধ্যে রাজনীতিই ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্যে উত্তম। এ কে খন্দকারের একাডেমিক মেধা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে উপরে ছিল এবং পারিবারিক পরিচয়ও নিচে ছিল না। নিজের ও জাতির সেবায় তিনি বিমানবাহিনীর প্রথমশ্রেণীর কর্মকর্তার পদে যোগদেন।

বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ঃ

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৯ সালে জনবন্ধু ভাসানীর আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। মাঠে-মঞ্চে খামোশ বলে হুঙ্কার দিলেও হক-সোহরওয়ার্দীর কাছে জনবন্ধু ভাসানী দুর্বল ছিলেন। রাজনীতির অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু তখন শতব্যক্তির একজনও নন। তাই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় আওয়ামী লীগের লাহোর প্রস্তাব ছিল ১৯ নম্বর ক্রমিকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে জনবন্ধু ভাসানী প্রাদেশিক সরকারে ক্ষমতাসীন দলীয়জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা। ঘেড়াও-হরতাল-মিছিল ছাড়া সংসদ/সরকার রাজনীতির ধারা উনার প্রকৃতি বিরোধী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে ২১ দফা ও গণম্যান্ডেটের পরিপন্থীতে দিল্লী প্রস্তাব ও পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যাসাম্য প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সম্মত হওয়ায় হক-সোহরওয়ার্দীর উপর তিনি ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে ১৯৫৬ সালের সংবিধান চালুর পরে লাহোর প্রস্তাব বাদ দিয়ে সোহরওয়ার্দীর সাথে বঙ্গবন্ধুও ক্ষমতার রাজনীতিতে যোগ দেন।

স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনের জন্যে সমমনা বিপ্লবীদের (সন্ত্রাসবাদী/মার্ক্সবাদী) নিয়ে জনবন্ধু ভাসানী ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। একাধিকবার সরকার গঠন-পতন ঘটিয়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারী ও সংবিধান বাতিল করিয়ে জনবন্ধু ভাসানী হক-সোহরওয়ার্দীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিলেন। অতঃপর স্বায়ত্বশাসন আন্দোলন শুরু করেন। দিল্লী প্রস্তাব ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠন এবং পূর্ব-পশ্চিমের সংখ্যাসাম্য প্রতিনিধিত্বের অব্যহত রাখায় প্রেসিডেন্ট আউয়ুব খানও রাজনৈতিক সমাধানে ব্যর্থ হন। তবে তাঁর সুশাসন ও উন্নয়নের কাছে ১৯৬৪ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমের পেশাদার রাজনৈতিক নেতারা সবাই ধরাশায়ী। ইতোমধ্যে হক সাহেব ও সোহরওয়ার্দীর মৃত্যু হয়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে ১৯৬৫ সালে জনবন্ধু ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু কিছুটা নিরাশ হয়ে উঠেন। এ অবস্থায় ইসরাইল হোসেন প্রথমে জনবন্ধু ভাসানীকে এবং অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের আন্দোলনে আবার সম্মত করান। ১৯৪৭ উত্তর ভারতের অভিজ্ঞতায় বোঝাতে সক্ষম হন যে, ইউনিয়ররাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক-তৃতীয়াংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় তিন-চতুর্থাংশ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন। ইউনিয়ররাষ্ট্র ব্যবস্থায় যেখানে রাজধানী, সে প্রদেশ সার্বভৌম। ৪টি প্রদেশ ও সেনাবাহিনীর জন্যে পশ্চিমাঞ্চল থেকে রাজধানী সড়ানো সম্ভব না। যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া হাজার মাইল ব্যবধানে দুই অঞ্চল নিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের সুযোগ নেই। এতে পৃথক রাষ্ট্র গঠনে একধাপ অগ্রগতি হবে। আর তেমন গণজাগরণ হলে পশ্চিমারা সম্মত না হলেই পৃথক রাষ্ট্র।

জনবন্ধু ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর ঐক্যমত্যে ইসরাইল হোসেন কর্তৃক মুসলিম লীগের ১৪ দফা ও লাহোর প্রস্তাবের সমন্বয়ে ৬ দফার ১ম দফার ১ম লাইন ---” লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হইবে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা” প্রণীত। ইসরাইল হোসেনের যুক্তি ছিল যে, এরই ভিত্তিতে পাকিস্তান হওয়ায় এ দফা ভিত্তিক আন্দোলনে কোন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হওয়ার সুযোগ থাকবে না। অন্যদফাগুলো অন্যদের সাথে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধু চুড়ান্ত করেন। জ্যেষ্ঠতর দলীয় নেতারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে হওয়ায় এজন্যে বঙ্গবন্ধু দলীয় অনুমোদন ছাড়া ৬ দফা উপস্থাপন করেন। প্রথম থেকেই জনবন্ধু ভাসানী ৬ দফাকে সমর্থন দেন। আমার এ কথা ছাত্র-যুব-আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস করা কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের পূনর্জাগরণের ১৯৮৮ সালের ৭ দফার নেপথ্যের ব্যক্তিটিও আমি ছিলাম, তা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা সন্মানীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়।

জাতির দামাল ছেলে বঙ্গবন্ধু একাডেমিক মেধায় তৃতীয়শ্রেণীর হলেও ভাষায় সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। এজন্যে ভাসানীর ঘেড়াও-হরতালের বদলে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ বেছে নেন। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হওয়ার সুযোগ না থাকায় ভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে মামলা ও কারাবন্ধি করে ৬ দফা আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করা হয়। কারাবন্ধি থাকায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রাখতে পারেন নি। প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছেন, ভাসানী-জিয়া, নজরুল-তাজউদ্দিন, ওসমানী-খন্দকার, সিরাজ-মনি, রব-সিদ্দিকী, প্রমুখরা। ৬ দফা আন্দোলনে বহু ছাত্র-যুবসহ স্থানীয়-জাতীয় নেতারাও যুক্ত ছিলেন। আন্দোলনের সফল নের্তৃত্ব দিলেও জিন্না যেমন লাহোর প্রস্তাবের রূপকার ও পাকিস্তানের স্বপ্নদষ্টা ছিলেন না। তেমনি আন্দোলনের সফল নের্তৃত্ব দিলেও বঙ্গবন্ধু ৬ দফা মূলরূপকার ও বাংলাদেশের স্বপ্নদষ্টা ছিলেন না।

তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল বিশ্বের সেরা জাতীয়তাবাদী, স্বাধীনতা আন্দোলনের পাথেয় এবং স্বাধীনতাযুদ্ধকালে প্রতিদিনের অনুপ্রেরণা। অস্থায়ী মুজিবনগর নামটিও হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা প্রতীক। ৬ দফা আন্দোলনের সফল নের্তৃত্ব ও ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্যে জনগণ বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় “জাতির প্রধাননেতা” বা “জাতির পিতা” হিসাবে সন্মান করে। ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রথম পর্ব যা পরম বিজয়ের। তবে ১৯৭১ উত্তর বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দ্বিতীয় পর্ব যা পরম পরাজয়ের।

৬ দফা রাষ্ট্রদর্শন বঙ্গবন্ধুর চেতনাপ্রসূত নয়। এজন্যে ৬ দফা, গণম্যান্ডেট ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পরিপন্থীতে ১৯৭২-এ সংবিধানের মুখবন্ধে বঙ্গবন্ধু লিখলেন, সমাজতন্ত্রবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জন্যে জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধু শপথ নিয়েছিলেন, ‘৬ দফা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হলো। এই ৬ দফার সঙ্গে কেউ যদি বেঈমানী করে, তাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। আমি যদি করি, আমাকেও (তোফায়েল আহম্মেদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪)এ। স্বাধীনতাযুদ্ধের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে শুরুতেই সাংবিধানিক মিথ্যাচার করা হয়েছে এবং ১৯৭৫-এ ৪র্থ সংশোধনী, সমাজতন্ত্রবাদ, একদল ও স্বৈরতন্ত্র।

১৯৭১ উত্তর রাষ্ট্র-পরিচালনার ব্যর্থতার দায় বঙ্গবন্ধুর কোনভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। ১৯৭২-৭৫ কালে সরকারী-বেসরকারী বাহিনীর হাতে সাড়ে তিন বছরে সরকারী-বেসরকারী দরের প্রায় ত্রিশহাজার অর্থ্যাৎ বছরে সাড়ে আট হাজার জন বিচার-বহিঃভুত হত্যা হয়। প্রেসিডেন্ট আউয়ুব খানের শাসনামলে বছরে গড়ে পঁচাশি জন অর্থ্যাৎ শতভাগের একভাগও বিচার-বহিঃভুত হত্যা হয়নি। তারপরেও প্রেসিডেন্ট আউয়ুব খানকে স্বৈরাচার আখ্যা করেই বঙ্গবন্ধুর নের্তৃত্বে আমরা গনতান্ত্রিক আন্দোলন করেছি। সেই গনতান্ত্রিক আন্দোলনের মহানেতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতোত্তর হত্যার রাজনীতিসহ একের পর এক জনগণের অধিকার হরণ করেন।

রাষ্ট্রকাঠামো ও আইনের অধীনে হওয়ায় সামরিক ও বেসামরিক সংস্থাসমূহ কম-বেশী জাতীয়তাবাদী। ১৯৩৭ সালে আগে যাদের জন্ম, তাদের মন-মানসিকতা বৃটিশ-ভারত রাষ্ট্রকাঠামো ও লাহোর প্রস্তাব আন্দোলনে গড়ে উঠে। ১৯৩৭ সালের পরে যাদের জন্ম, তাদের মন-মানসিকতা পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামো ও ৬ দফা আন্দোলনে গড়ে উঠে। ৭ই মার্চের ভাষণের পরে সামরিক-বেসামরিক সংস্থাসমূহের মধ্যেও স্বাধীনতার চেতনা জেগে উঠে এবং ক্রান্তিকালে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়ে তাঁরা জাতীয় দায়িত্ব পালন করে।

স্বাধীনতাযুদ্ধের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে সাংবিধানিক মিথ্যাচার, হত্যার রাজনীতি, স্বেচ্চাচারিতা, হটকারিতা ও রাষ্ট্র-পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার জন্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি জাতির শ্রদ্ধা-ভালবাসা হ্রাস পেতে থাকে। রব-ইনু, মতিয়া-সেলিম, প্রমুখদের সমকালের মন্তব্যগুলো তারই প্রতিধ্বনি। ৪র্থ সংশোধনী, অনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, সমাজতন্ত্রবাদ, একদল, স্বৈরতন্ত্র, মৌলিক অধিকার হরণ, হত্যার রাজনীতি, ইত্যাদির জন্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি নির্দলীয় ও অন্যদলীয় জনগণের শ্রদ্ধা-ভালবাসা শুণ্যে নেমে যায়। জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধে যোগদেন, তাদের মধ্যে ঋণত্বক হয়ে পড়ে। এর ফলসূতিতে অনাকাংখিত ও বর্বর ১৫ই আগষ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর লাসের দাফন নিয়ে কর্ণেল তাহেরের এবং মুজিব সরকারের অপসারণে স্পীকার মালেক উকিলের মন্তব্যেও তার প্রতিফলন আছে।

সম্মৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ঃ

৪র্থ সংশোধনী ও অনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে ১৫ই আগষ্ঠ অপ্রত্যাসিত ছিল না। তবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বর্বরতায় ১৫ই আগষ্ঠ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যে আর সীমিত ছিল না। স্বাধীনতোত্তর অবনতিশীল পরিস্থিতিসহ ১৫ই আগষ্ঠ, ৩রা নভেম্বর ও ৭ই নভেম্বর আমার কাছে কেবল ক্ষমতার পালাবদল বলে মনে হয়নি। ইসরাইল হোসেনকে ১৯৭৩ সালে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এককপি সংবিধান দিয়েছিলেন। উভয়ের মধ্যে সংবিধান ও কিছু প্রসঙ্গে কথপোকথনে কিছুসুত্র আমার স্মরণে ছিল। রাষ্ট্রব্যবস্থার বিশ্বসমীক্ষা থেকে বুঝলাম, স্বৈরমুখী রাষ্ট্র-অবকাঠামো. স্বৈরমুখী প্রতিরক্ষা কাঠামো. ১৯৭২ সালের স্বৈরমুখী সংবিধানিক সরকারব্যবস্থা এবং সংসদে ৯৭% অংশীদারীত্বের জন্যে স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশ উত্তরাত্তর স্বৈরমুখী হতে থাকে। রাষ্ট্র-অবকাঠমো, প্রতিরক্ষা কাঠামো ও সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্রমুখী পুনর্গঠন ছাড়া স্বৈরমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে মুক্তির পথ ছিল না।

আমি সরকার নই। কম-বেশী স্বার্থরক্ষা না হলে সরকার আমার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে না। তাই ১৯৮২ থেকে সরকারের প্রয়োজনে বা সংকটকালে গণতান্ত্রিক পূনর্গঠনের উদ্যোগগুলো নিই। বাংলাদেশ ৯টি বিভাগে বিভক্ত হলে রাষ্ট্র-অবকাঠমো এবং ৯টি আঞ্চলিক ক্যান্টমেন্ট ভিত্তিক হলে প্রতিরক্ষা কাঠামো সুষম-গণতন্ত্রমুখী হবে। অন্যদিকে দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা চালু হলে স্বৈরমুখী সংবিধানিক সরকারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হবে (আহসান-উল-করিম, প্রগাতশীল গণতন্ত্র, ১৯৯১)এ। ১৯৮২ থেকে উপজেলা-জেলা-বিভাগ পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা বিভাগ গঠিত তথা বাংলাদেশ ৯টি বিভাগে বিভক্ত হলে বাজারকাঠামো সুষম প্রতিযোগীমুখী হওয়ায় সুষম আয়বন্টনসহ ৫ বছরেই জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধির হার ৯% এর উর্দ্ধে উন্নীত হবে। অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধম্যে তা ১২%-এর উর্দ্ধে উন্নীত করা সম্ভব হবে।

সেনাবাহিনীর বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী অংশ ১৯৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ১৯৮০ পর্যন্ত শেখ হাসিনা দেশে ফিরতে পারেননি। ১৯৮৮-এ শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে গুলি করে। ১৯৯৬-এ শেখ হাসিনা নির্বিঘেœ ভোটে ক্ষমতাসীন হন। সেনাবাহিনী এখন শেখ হাসিনাকে সেলুট দেয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভোটে ক্ষমতাসীন হতে এখন আর বাধা নেই। এটা যেমন তোফায়েল আহম্মেদ, মোহাম্মদ নাসিম বা শেখ সেলিমের অবদান নয়। তেমনি ২০০১ উত্তর দুঃশাসন পরিস্থিতিতে রপ্তানী, রিমিটেন্স ও সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধিসহ জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫% এর উর্দ্ধে উন্নীত ও দারিদ্রতা ক্রমঃমোচন শেখ হাসিনার দৈব্য অবদান নয়।

১৯৮৮ পর্যন্ত ৪/৫টি আঞ্চলিক ক্যন্টিমেন্ট ভিত্তিক থাকায় প্রতিরক্ষা কাঠামো স্বৈরমুখী ছিল। ৮টি আঞ্চলিক ক্যন্টিমেন্ট ভিত্তিক গণতন্ত্রমুখী প্রতিরক্ষা কাঠামো হওয়ায় গণক্ষোভ ছাড়া সহজে ক্ষমতা দখল সম্ভব নয়। যথাসময়ে আপীল বিভাগ দু’পদক্ষেপে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়ায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারও সম্ভব হয়। জিডিপি গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫% এর উর্দ্ধে উন্নীত ও দারিদ্রতা ক্রমঃমোচন হওয়ায় অর্থনেতিক পরিন্থিতি বাংলাদেশ ১৯৮২-এর পূর্বাস্থায় নেই। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন আর কাউকে পরওয়া করেন না। কিন্তু বাংলাদেশ ৯টি বিভাগে বিভক্ত ও দুইকক্ষ সংসদব্যবস্থা চালু ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা অসম্পূর্ণ এবং দূনীতি ও সন্ত্রাস ক্রমঃবর্দ্ধমান। রাজনৈতিক বিপর্যয়ও আশংকামুক্ত নয়। জ্ঞাত থেকেও সরকার হয়ে পদক্ষেপগুলো না নিয়ে নিজেকে বার বার গণতন্ত্র ও জননিরপত্তায় বিশ্বাসী বলা এবং গুম-হত্যার রাজনীতি অব্যহত রাখা জনপ্রতারণার সামিল। এর পরিণাম গণদ্রোহ ও গণ-অভুত্থান।

এ কে খন্দকারের মন্তব্যগুলোর মূল্যায়ণঃ

স্বাধীনতা ও সম্মৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে ইতিকথা ও রূপকথার গল্পগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো, কবিতার বদলে ঐতিহাসিক বাস্তবতার ভিত্তিতে এ কে খন্দকারের মন্তব্যগুলো মূল্যায়ণ করা। তিনি ৬ দফা আন্দেলনের চেতনাধারী। ১৯৭০-এর গণম্যান্ডেট ও ৭ই মার্চের ভাষণের পরে জীবন বাজী রেখে পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করেন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে সাংবিধানিক মিথ্যাচার, হত্যার রাজনীতি, স্বেচ্চাচারিতা, ৪র্থ সংশোধনী, ইত্যাদির জন্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁরও শ্রদ্ধা-ভালবাসা হ্রাস পায়। এজন্যে ৪৩ বছর পরেও ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর কতিপয় বিষয় নিয়ে প্রশ্নগুলো তোলা এবং নিজের অভিজ্ঞতায় উত্তরগুলো দেওয়া।

এ কে খন্দকারের যে মন্তব্যগুলো নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তাঁর প্রধানগুলো হলো-এক, ২৬শে মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সত্যতা; দুই, ৭ই মার্চের ভাষণ “জয়বাংলা, জয় পাকিস্তান” বলে শেষ করা; তিন, স্বাধীনতা ঘোষণার স্বপক্ষে প্রযোজনীয় প্রস্তুতি না থাকা; এবং চার, ৭ই মার্চে ঘোষণা করা হলে সহজ ও কম রক্তে স্বাধীনতা অর্জন হতো। অন্যে কথা ও কর্ম আমরা নিজের মন ও প্রজ্ঞা দিয়ে মূল্যায়ন করি। সেজন্যে এ কে খন্দকারের মন্তব্যগুলো ইতিহাসের বাস্তবতায় মুল্যায়ণ করা সবচেয়ে সমীচীন ও গ্রহণযোগ্য হবে।

২৮শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত জাতির মানসিক প্রস্তুতি ছিল তিন-চতুর্থাংশ স্বাধীনতা ভিত্তিক ফেডারেল পাকিস্তান। ১লা মার্চে জাতীয় সংসদ অধিবেসন স্থগিতের পরে ছাত্র-যুব নেতারা বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে আবেদন করেন। উনি তাদের বলেছেন, ‘পাকিস্তানও হয়েছে জাতির আকাংখা, আন্দোলন, বহুত্যাগ ও সমর্থনে। হঠাৎ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া হলে মধ্যবয়সী ও প্রবীনেরা সমর্থন নাও করতে পারে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে। আগে সর্বস্তরে স্বাধীনতার মন জাগাতে হবে। আন্তর্জাতিক সমর্থনের প্রেক্ষাপট তৈরী করতে হবে।’ ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেটাই করেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ৬ দফা আন্দোলনে ফেডারেল পাকিস্তান অথবা স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, তা জনবন্ধু ভাসানী, বঙ্গবন্ধু ও ইসরাইল হোসেন জানতেন। যেটা ‘৬ দফা না মানলে ১ দফা’ কথামালা হিসেবে প্রচারিত ছিল।

সিরাজুল আলম খানের নের্তৃত্বাধীন নিউক্লিয়ার্সের ২রা মার্চে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ছাত্র-যুব নেতাদের পতাকা উত্তোলন (পাবনায় বিকাল ৪-০০ টায়) এবং ৭ই মার্চের ভাষণের পরে বাকী এক-চতুর্থাংশ স্বাধীনতার মানষিক প্রস্তুতি ক্রমশঃ সম্পন্ন হয়। পূর্বে বিছিন্নভাবে হলেও এজন্যে ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে বর্বর আঘাত এলে সেনা-বিডিআর-পুলিশ-আনসার-জনতা সবাই যার যার অবস্থান থেকে স্ব-উদ্যোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৬ দফা হলো প্রথমে ফেডারেল পাকিস্তান, অতঃপর বা নাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ হওয়ার আন্দোলন। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রবাদী দল, কোন সন্ত্রাসবাদী দল ছিল না। গণজাগরণ ছাড়া গণতান্ত্রিক ও প্রচলিত প্রথায় এর চেয়ে বেশী প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। ৭ই মার্চের ভাষণের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে, সেনাসহ জনগণ ভাগাভাগি হয়ে পড়তো। আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া কঠিন হতো। স্বাধীনতাযুদ্ধ নয় মাস কেন, নয় বছরেও শেষ হতো না। আর দশগুন বেশী মানুষ মারা যেতো।

“জয় পাকিস্তান” বলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ করা এ কে খন্দকারের মন্তব্যে নিয়ে বিতর্ক বেশী। এমন কথা অনেকে আগেও লিখেছেন। আমি পরের দিন রেডিওতে শুনেছি। বিষয়টি এখন খেয়াল করতে পারি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বুয়েটে অধ্যায়নরত ও ছাত্রলীগভুক্ত আমার দু’ভাই (ডঃ মোহাম্মদ রেজওয়ানুল করিম ও ডঃ মোহাম্মদ আনোয়ারুল করিম) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাও কখনো এ নিয়ে আলোচনা করেননি। ৩রা জানুয়ারীতে ৬ দফার শপথ অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধু “জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান” বলেছেন। ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ঘোষণা নয়, পরবর্তী আন্দোলনের পাথেয়। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার তারিখ ২৬শে মার্চ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কৌশলগত কারণে বঙ্গবন্ধু যদি “জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান” বলে শেষ করা হলে তা প্রজ্ঞাসম্মত। এতে নের্তৃত্ব ও নেতার বিজয়ের ইতিহাস কলঙ্কিত হয় না। এ নিয়ে ইপপ্রধান সেনাপতির মন্তব্যে বিপরীতে বিরূপ মন্তব্য করা ববং স্বাধীনতাযুদ্ধেকে কলঙ্কিত করা হয়।

গণতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতা অর্জনের পদ্ধতি ও ২৫শে মার্চে বঙ্গবন্ধুর নিজগৃহে অবস্থানের বিষয়টি অনেকেই অনুধাবন করতে পারেন না। এজন্যে স্বাধীনতা ঘোষণা বা পথ নিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদসহ অনেকেরই সংশয় ছিল বা আছে। জ্ঞাত থাকায় জনবন্ধু ভাসানীর সংশয় ও প্রশ্ন ছিল না। স্বাধীনবাংলার প্রধানমন্ত্রীর সংশয়ের জন্যে এ কে খন্দকারের সংশয় জাগে। স্বাধীনত্তোর ৬ দফা, গণম্যান্ডেট ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পরিপন্থীতে সংবিধানের মুখবন্ধে মিথ্যাচারের জন্যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে তাঁর সংশয় বাড়ে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির খসড়া করেন এবং শীর্ষ নেতাদের অনুমোদনে ১০ই এপ্রিল ঘোষিত। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের অভিমত এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।

গণতান্ত্রিক পথে সাতকোটি জনতার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূলধারার সাথে বহু মত ও ধারা যুক্ত থাকে। নিজ নিজ মত ও পথ সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর মত ও পথ নিয়ে বহু প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক। অনেক বিতর্কের অবসানের জন্যে ১৫শ সংশোধনীতে ৬ দফা, ৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ সংবিধানে যুক্তকরার জন্যে (আহসান-উল-করিম, সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো, ২০১০)এ। ৬ দফা বাদ দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর নামে ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণার ওয়ারলেস বার্তাটি সংযুক্ত করা হয়। জাতীয়বন্ধু জিয়ার প্রভাবশীল স্বাধীনতার ঘোষণাটি বাদ দিয়ে কেবল বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি সংযুক্ত করাও এ কে খন্দকারের ক্ষোভের একটি কারণ হতে পারে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থাকলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামে কোন বার্তা আর সংযুক্ত করার প্রয়োজন নেই এবং ৬ দফা ছাড়া বঙ্গবন্ধু খন্ডিত। ভগবান ব্যক্তিক ও অবরোহমুখী, কিন্তু নেতা সমষ্টিক ও আরোহীমুখী। যত বড় নেতা, তত বেশী সমষ্টিক। ভগবান হয়ে বঙ্গবন্ধু একাই বাংলাদেশ বানিয়েছেন, এটা অবার্চীন-পাগল-ছাগলদের চেতনা।

বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণার ওয়ারলেস বার্তার কথায় ২৬শে মার্চের ভোরবেলা থেকেই আমরা পাবনা শহরবাসীরা ভোরবেলা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেনাকর্মকর্তা হিসেবে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা ঐতিহাসিক ও প্রভাবশীল। এর মূলেও ৬ দফা, গণম্যান্ডেট ও ৭ই মার্চের ভাষণ। ৭ই মার্চের ভাষণের পরে নিজমুখে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে জাতির প্রধাননেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভুমিকা কলঙ্কিত বা হ্রাস হয় না। তিনিই বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে রাজনৈতিক প্রধাননেতা। তাঁর নামেই স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছে। তাঁকে নেতা রেখেই স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতি ও কারাবন্ধিত্ব দেয় জাতীয় ঐক্য। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যান্য নেতাদের অবদানও নক্ষত্রের মতো। বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে জাতির বঙ্গবন্ধুর প্রধাননেতা---তা যেমন অস্বীকার করার সুয়োগ নেই, তেমনি বাংলাদেশের উদ্ভুদয়ে তাঁকে ভগবান ভাবা বা বানোনোর সুযোগও নেই। বাংলাদেশের উদ্ভুদয় হয়েছে জাতির সম্মিলিত আকাংকায় ও প্রচেষ্টায়।

=================================

*মোহাম্মদ আহ্সানুল করিমঃ রাষ্ট্র-বিশেষজ্ঞ, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক বিসিএস কর্মকর্তা। ১৯৮২ থেকে “সম্মৃদ্ধিশীল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ” গঠনে ভিত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্রমুখী পুনর্গঠনের উদ্যোগী এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা (১৯৮৫), প্রগতিশীল গণতন্ত্র (১৯৯১), ও সংবিধান সংশোধনের দিকগুলো (২০১০) নিবন্ধ/বইযের লেখক।Click this link

বিষয়: বিবিধ

১২০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File