★★★ রাহীমা ★★★ ____ মানসূর আহমাদ
লিখেছেন লিখেছেন জেলপেন ০২ মার্চ, ২০১৫, ১২:৫১:৩৮ রাত
মা মরা মেয়েটির দিকে কেউ মনযোগ দিতো না। সারাদিন উঠোনের ধুলোয় পড়ে থাকতো সে। ধুলো নিয়ে খেলা করতো। উঠোনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হাঁটাহাঁটি করতো। তখন মেয়েটির বয়স মাত্র আড়াই বছর! সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকতো। আর সে এক মনে ধুলোয় খেলা করতো। তার নাম রাহীমা।
রাহীমার বয়স যখন মাত্র দুই, তখনই তার মা ভয়াবহ ব্লাড ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। বর্তমানে আমাদের সমাজে এমন অনেক সুস্থ মানুষও ঘোরাফেরা করেন, যারা একসময় ব্লাড ক্যান্সারের রোগী ছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা প্রচেষ্টা এবং উন্নত চিকিৎসার কল্যাণে তারা সেরে ওঠেছেন। কিন্তু রাহীমার মা মাজেদা বেগমের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হয় নি।
রাহীমার বাবা আব্দুল গফুর একজন গরীব কৃষক। তার পক্ষে স্ত্রীর চিকিৎসা করানো সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি। চিকিৎসার অভাবে মারা যান মাজেদা বেগম। মৃত্যুশয্যায় তিনি স্বামীর হাত ধরে বলেছিলেন, 'আপনে আমার রাহীমার দিকে খিয়াল রাখবা। কোনো সময় যেনো কষ্ট না পায়।'
গরীব কৃষক আব্দুল গফুরের পক্ষে সম্ভব হয় নি স্ত্রীর শেষ অনুরোধ রাখাও। তিনি তার কাজে ব্যস্ত থাকেন। হালচাষ করেন। বড় মেয়েটা রান্নাবান্না করে। ছোট ভাই বোনদের দেখাশোনা করে। রান্নাবান্না, ঘরের কাজকর্ম ইত্যাদির ব্যস্ততায় তার পক্ষেও ওদের প্রতি তেমন নজর রাখা সম্ভব হয় না।
রাহীমারা দুই বোন এক ভাই। তার তিন বছরের বড় ভাইটির নাম জামাল। বড় বোনের নাম রাহনুমা।
রাহীমার বয়স যখন ছয়, তখন খালাতো ভাই মঈনের সাথে বিয়ে হয়ে যায় রাহনুমার। ছেলে মেয়ের লালন পালনের সুবিধার্থে বিয়ে করেন আব্দুল গফুর। কিন্তু নতুন মা'র সংসারে সুখী ছিলো না ভাই বোন। মেজো মামা আব্দুল মুক্তাদির সাহেব জামালকে নিয়ে গেলেন তাঁর শহরের বাসায়। সেখানে ভাগ্নেকে একটি হাফিজী মাদরাসায় ভর্তি করে দেন।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সৎমায়ের সংসার আলো করে সন্তান এলো। আর রাহীমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে লাগলো। আব্দুল গফুরও মেয়েকে আর আগের মতো আদর করেন না। তার নতুন সংসার হয়েছে। ব্যস্ততা বেড়েছে। মা মরা মেয়েকে আদর করার সময় কই তার!
ছোট বোনের কষ্ট বুঝে রাহনুমা। সে তার স্বামীকে বলে শশুর বাড়ি নিয়ে আসে বোনকে। এখানেই হেসে খেলে পার হয়ে যায় রাহীমার তিনটি বছর। এরইমধ্যে সে মকতবে গিয়ে কুরআন মজীদ পড়া শিখে ফেলেছে। তার ব্যবহারেও সবাই সন্তুষ্ট। তবুও পরের বাড়ি বলে কথা। সবাই তাকে পুরোপুরি মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারে না।
তার নানার বাড়িও এই গ্রামেই। সে কিছুদিন বোনের বাড়িতে থাকে। আর কিছুদিন থাকে নানার বাড়িতে। মাঝেমধ্যে বাড়িতেও যায়।
রাহীমার সেজো খালার বিয়ে হয়েছিলো অন্য এক জেলায়। দূর হওয়ার কারণে তিনিও বাপের বাড়ির পাশেই জায়গা কিনে ঘর তুললেন। সংসার পাতলেন এখানেই। তার তিন মেয়ে দুই ছেলে। ছোট মেয়ে তানজিনা রাহীমার বয়সী। নানার বাড়িতে আসলে রাহীমা তার সাথেই খেলাধূলা করে। একসাথে ঘুরে বেড়ায় দুজন।
রাহীমার নানীর ভাইপো ফায়িয গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করে। এই মামাটাকে রাহীমার ভালো লাগে। রাহীমা তখন বারো বছরের কিশোরী। সে ও তানজিনা একসাথে বিভিন্ন গ্রাম্য খেলা খেলে। একদিন তারা গোল্লাছুট খেলায় রত ছিলো। ফায়িয এলো গুলতি নিয়ে। গুলি দিয়ে একটি কাক শিকার করলো। রাহীমা ও তানজিনা এতে কী খুশি! তারা খেলাধূলা বাদ দিয়ে কাক নিয়েই খেলতে লগলো। একসময় কাকটি মরে গেলো। মরে যাওয়ার পর কাকের এক ডানায় ধরলো রাহীমা। অন্য ডানায় তানজিনা। সে কী ফুর্তি ওদের! 'হেঁইয়ো' করে মারলো টান। কাকের বুকসহ ছিড়ে গেলো ডানা। কলজে বেরিয়ে পড়লো। তারা উভয়ে খুশিতে নাচতে লাগলো। উপরে কা কা করছে শতশত কাক। ফায়িয চলে গেলো। তার মনে অনুশোচনা জেগেছে। কেনো সে একটি নিরীহ কাককে মারতে গেলো!
কেউ কল্পনাও করতে পারে নি- মায়ের মতো তেরো বছরের ছোট্ট মেয়েটিরও ব্লাড ক্যান্সার হবে! ভয়াবহ এ রোগে কিছুদিন ভোগেই সহ্য করতে পারে নি কচি মেয়েটি। বর্ষায় অসুস্থ শরীর নিয়েই নিজের বাবার বাড়ি গিয়েছিলো রাহীমা। দুই সপ্তাহের মাথায় এলো সেই দুর্বিষহ কালো রাত। ছোট্ট এই প্রদীপটি পৃথিবী থেকে চিরতরে নিভে গেলো সেই রাতে!
বিষয়: সাহিত্য
১১৮৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কষ্টময় আবহ ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল!
ভালও লাগল উপস্হাপনা! অনেক ধন্যবাদ জানাই!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন