সবচেয়ে বিশুদ্ধ সানাদ ও ছহীহ হাদীছ সমূহের স্তর বিন্যাস
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১১:১৯:১৩ সকাল
একেক মুহাদ্দিসের নিকট একেক সানাদ সবচেয়ে বিশুদ্ধ সানাদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইমাম আহমাদের নিকট সবচেয়ে বিশুদ্ধ সানাদ: ইমাম জুহরী, সালিম থেকে তিনি আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে তিনি রাসূল (ছাঃ) থেকে। এই সূত্রটি ইমাম আহমাদের নিকট সবচেয়ে বিশুদ্ধ।
আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ): অত্যাধিক সুন্নাতের অনুসরণ কারী, হাদীছের হাফেজ ছাহাবী। ১৪ বছর বয়সে তিনি উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন কিন্তু বয়স স্বল্পতার কারণে তাকে গ্রহণ করা হয়নি। সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব বলেন, ‘আমি যদি কারো জান্নাতের জন্য সাক্ষ্য দিতাম তাহলে ইবনু ওমরের জান্নাতের জন্য সাক্ষ্য দিতাম। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫/২০৮)
সালিম: মদীনার সাতজন বিখ্যাত ফকিহের মধ্যে তিনি একজন। উসমান (রাঃ)-এর খিলাফাত আমলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খত্তাব (রাঃ)-এর পৌত্র। তিনি তার পিতা আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)-থেকে অত্যাধিক হাদীছ রিওয়ায়েত করেছেন। বলা চলে তিনি তার পিতার হাদীছের সংরক্ষক ছিলেন।
ইমাম যুহরী: মুহাম্মাদ বিন মুসলিম আয যুহরী। ১২৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেক উঁচু মাপের একজন তাবেয়ী আলেম ছিলেন। খলিফা ওমর বিন আব্দুল আযীয তাকেই হাদীছ সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটাই প্রমাণ করে তিনি কত উঁচু মাপের মুহাদ্দিছ ছিলেন। তিনি ইবনু উমার (রাঃ)-কে দেখেছেন। অনেকের মতে তিনি তিনটি হাদীছ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন। এছাড়া আনাস রাঃ থেকেও তিনি হাদীছ বর্ণনা করে থাকেন। অবশ্য তার অনেক মুরসাল হাদীছও রয়েছে যেমন উবাদা বিন সামিত থেকে তার বর্ণিত হাদীছ মুরসাল বলে গণ্য হয়। তার অনেক ছাত্র রয়েছে তন্মধ্যে ৫ম খলিফায়ে রাশেদা ইমাম ওমর বিন আব্দুল আযীযও একজন।
ইমাম বুখারীর নিকট সবচেয়ে বিশুদ্ধ সানাদ: ইমাম মালেক (রাহঃ) নাফে‘ থেকে তিনি আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা: থেকে। এই সূত্রটি ইমাম বুখারীর নিকট সবচেয়ে বিশুদ্ধ।
আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) : তাঁর সম্পর্কে আমরা জেনেছি।
নাফে‘: আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ এর আজাদ কৃত গোলাম এবং তার হাদীছের সংরক্ষক। তার নিকট আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা: এর বর্ণিত হাদীছের লিখিত ছহীফা ছিল। ইমাম মালেক তার খাস ছাত্রদের একজন। এছাড়া আইয়ূব সাখতিয়ানীও তার থেকে বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ওমর বিন আব্দুল আযীয রহ: মিশর বাসীকে সুন্নাহ শিখানোর জন্য তাকে মিশরে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ১১৭ হিজরীতে মারা গেছেন।
ইমাম মালেক: বিখ্যাত চার ইমামের একজন। শায়খুল ইসলাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিছ, ইমামু দারিল হিজরাহ। রাসূলের খাদেম আনাস বিন মালিক (রাঃ) যেইবছর মারা যান ইমাম মালিক (রহঃ) সেই বছরেই জন্ম গ্রহণ করেন। তথা ৯৩ হিজরী। দুনিয়ার বুকে প্রথম লিখিত পূর্ণাঙ্গ হাদীছের বই মুয়াত্তা তারই লিখিত। তার সময় দুনিয়ার এমন কোন বড় আলেম ছিলেন না যিনি তার কাছ থেকে হাদীছ শ্রবণ করেন নি। যেমন ইমাম লাইছ, ইমাম শুবা, ইমাম আওযাঈ ও ইমাম সুফিয়ান ছাওরী সকলেই তার কাছ থেকে হাদীছ শ্রবণ করেছেন। এছাড়াও তিনি অনেক মহান ছাত্র তৈরী করে গেছেন যেমন ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম শাফেয়ী।
ইবনু মাঈনের নিকট সবচেয়ে বিশুদ্ধ সানাদ: আ‘মাশ ইবরাহীম নাখয়ী থেকে তিনি আলকামা থেকে তিনি আব্দুল্লাহ বিন মাসউ‘দ (রাঃ) থেকে। এই সূত্রটি ইমাম ইবনু মাঈনের নিকট সবচেয়ে বিশুদ্ধ।
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ): বুদ্ধিমান ও ফকিহ ছাহাবী। পাতলা ও খাটো সাইজের ছিলেন। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ কারী সৌভাগ্যবানদের মধ্যে তিনি একজন। ওহুদের যুদ্ধের দিন রাসূল ছা: এর সাথে যে চারজন অবশিষ্ট ছিলেন ইবনু মাসউদ রা: তাদের একজন। ইবনু মাসউদ রাঃ-কে রাসূল ছা: তার বাড়ীতে যখন তখন প্রবেশের অনুমতি দিয়ে রেখেছিলেন যতক্ষণ না রাসূল তাকে নিষেধ করেন। তিনি অধিকাংশ সময় রাসূল ছাঃ এর জুতা ও মিসওয়াক বহন করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১/৪১৮)
আলকামা: ফকিহ ও মুজতাহিদ। কূফার অধিবাসী এই মহান ফকিহ রাসূল ছা: এর রিসালাতের জামানাতেই জন্ম গ্রহণ করেন। এজন্য তাকে মুখাজরামীনদের মধ্যে গণ্য করা হয়। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা এর খাস ছাত্র ছিলেন। তার হাদীছ ও ফতোয়া সর্ম্পকে সবচেয়ে বেশী অভিজ্ঞ ছিলেন। কূফাতে আলী রা: ও আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাঃ এর পর ফতোয়ার জন্য মানুষ তার শরণাপন্ন হত। (সিয়ারূ আলামিন নুবালা, ৭/৫৭)
ইবরাহীম নাখয়ী: হাফেজ, ইমাম ও ফকীহুল ইরাক। তাকে তাবেয়ী হিসেবেই গণ্য করা হয় কিন্তু কোন ছাহাবীর নিকট থেকে তার কোন বর্ণনা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়নি। ছোট অবস্থায় একবার আয়েশা (রাঃ)-কে দেখেছিলেন। তিনি ফিকহ শাস্ত্রে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পছন্দ করতেন না। হাম্মাদ বলেন,‘আমি ইবরাহীমকে যখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মৃত্যুর খবর শুনালাম তখন তিনি খুশীতে সিজদায় পড়ে যান এবং কেঁদে ফেলেন। এই মহান মানুষটি ১৯৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৯০)
আ'মাশ: তার পূর্ণ নাম সুলায়মান বিন মিহরান আল আ‘মাশ। শায়খুল ইসলাম, হাফিজ, ক্বারী ও মুহাদ্দিছ। অক্বি ইবনুল জাররাহ বলেন আ‘মাশের সত্তর বছর কোনদিন ছালাতে প্রথম তাকবীর ছুটে যায়নি। ইবনে উয়াইনা বলেন আমি আ‘মাশকে দেখেছি তিনি ছিড়ে-ফাটা পোশাক পরেছিলেন। জামার ঝুল গুলো তার পায়ের সাথে লটকাচ্ছিল। এই মহান ইবাদাতগুজার, ক্বারী ও মুহাদ্দিছ ১৪৮ হিজরীতে মারা যান।
নোট:
১- আলকামা এবং ইবরাহীম পরস্পর মামা ভাগ্নে। আলকামা রহ: ইমাম নাখয়ীর মামা ছিলেন। দুইজনই কূফার নামকরা ফকিহ।
২- হাদীছের কিতাবগুলোতে যদি শুধু আব্দুল্লাহ বলা হয় এবং পিতার নাম উল্লেখ না করা হয় তাহলে তার দ্বারা উদ্দেশ্য হয় আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ।
৩- উপরের সর্ববিশুদ্ধ সানাদগুলোর মধ্যে আমরা কোনটাকে কোনটার উপর প্রাধান্য দিবনা। বরং সবগুলোকে উঁচু পর্যায়ের সানাদ বলে গণ্য করব। এছাড়া আরও ইমামের পক্ষ থেকে যদি সর্ববিশুদ্ধ জানতে পারি তাহলে সেটাও উঁচু পর্যায়ের সানাদ বলে গণ্য হবে।
ছহীহ লি যাতিহি হাদীছ সমূহের স্তর বিন্যাস:
যে হাদীছের মধ্যে আগের পর্বে উল্লেখিত ৫ টি গুণ যে পরিমাণে পাওয়া যাবে সেই হাদীছের মানের স্তরও সেই হিসেবে বাড়বে। হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহ ছহীহ লি-যাতিহী হাদীছ সমূহের মানের উপর ভিত্তি করে স্তর বিন্যাস করেছেন।
১. মুত্তাফাক আলাইহ তথা বুখারী মুসলিম গ্রহণ করেছে এমন হাদীছ।
২. শুধু ছহীহ বুখারীর হাদীছ।
৩. শুধু ছহীহ মুসলিমের হাদীছ।
৪. বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ছহীহ।
৫. বুখারীর শর্ত অনুযায়ী ছহীহ।
৬. মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ছহীহ।
৭. যে সমস্ত ছহীহ হাদীছ উপরের ৬ প্রকারের বাইরে।
নোট: বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ছহীহ অর্থ হচ্ছে এই হাদীছের রাবী বুখারী ও মুসলিমের রাবী।
ফায়দা: দুই হাদীছের মাঝে দ্বন্দ হলে অত্র বিন্যাস অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত বেশী ছহীহ হাদীছকে প্রাধান্য দেয়া হবে।
নোট: এই স্তর বিন্যাস থেকে আমাদের মনে হতে পারে, মুত্তাফাক আলাইহ হলেই তা সবচেয়ে বিশুদ্ধ বলে গণ্য হবে। এটা একটা ভূল ধারণা এবং ইলমে হাদীছ সর্ম্পকে অজ্ঞতার পরিচয়। এই স্তরবিন্যাসের বাইরেও অপেক্ষাকৃত বেশী বিশুদ্ধ হাদীছ পাওয়া যেতে পারে। যেমন মনে করি তিরমিযীর কোন হাদীছ মাশহুর এবং সকল সূত্র বিশুদ্ধ পাশাপাশি একটা সূত্র আমাদের উপরে বর্ণিত সর্ববিশুদ্ধ সূত্রগুলোর অর্ন্তভূক্ত। সকল মুহাদ্দিছ হাদীছকে ছহীহ বলেছেন। তাহলে এই হাদীছটি বুখারী মুসলিমের ঐ হাদীছের উপর প্রাধান্য পাবে যেই হাদীছের সানাদে এই বৈশিষ্ট্য গুলো নাই।
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
মসজিদে নববী, মদীনা।
বিষয়: বিবিধ
১৬২৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাই, ইমাম মুসলিমের শর্তই হচ্ছে যে তিনি সেসকল হাদীস বর্ণনা করেছেন যে সকল হাদীস শুধু তার নিজের নিকট ই ছহিহ নয় বরং সকল মুহাদ্দিস যেসকল হাদীসের ব্যাপারে একমত যে তা সহীহ। তাহলে আপনার কথা কেমন যেন হয়ে গেল না?
"হাদিস সংকলন এর ইতিহাস" এ এই বিষয়ে পড়েছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন