খবারে ওয়াহিদ কি ধারণা প্রসূত? একটি পর্যালোচনা

লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:৩৮:২৮ সন্ধ্যা

উসূলে হাদীছে বা মুসতালাহুল হাদীছের প্রায় সকল আলোচনা ও হুকুম আহকাম খবারে আহাদকে ভিত্তি করে হয়ে থাকে।

সংজ্ঞাঃ যেই হাদীছকে এক বা একের অধিক রাবী বর্ণনা করে কিন্তু তা তাওয়াতুরের সীমা পর্যন্ত পৌঁছেনা সেই হাদীছকে খবারে ওয়াহিদ বলে।

হুকুমঃ খবারে আহাদ যদি ছহীহ হয় তাহলে তা ইলম বা জ্ঞানের ফায়দা দিবে।

ব্যাখ্যাঃ

১. যে খবারে আহাদ মুত্তাফাক আলাইহ বা বুখারী-মুসলিমের হাদীছ ।

২. যে খবারে আহাদের রাবীগণ ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক (রহঃ)-দের মত হাফেজে হাদীছ ।

৩. যে খবারে আহাদ মুস্তাফিজ বা মাশহুর এবং তার ছহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোন মুহাদ্দিছের কোন দ্বিমত নাই।

উপরের তিন প্রকারের খবারে আহাদের হাদীছ দ্বারা অর্জিত জ্ঞান মুতাওয়াতির হাদীছের মত ইলমে ইয়াকিন বা নিশ্চিত জ্ঞান। তবে মূল মুতাওয়াতির হাদীছের সাথে দ্বন্দ হলে মূল মুতাওয়াতির হাদীছই প্রধান্য পাবে।

৪. যে খবারে ওয়াহিদ উপরের তিন প্রকারের মধ্যে পড়েনা কিন্তু সন্দেহাতীত ভাবে সানাদ ছহীহ বা হাসান।

৫. যে খবারে আহাদের ছহীহ ও জঈফ হওয়া নিয়ে মুহাদ্দিছদের ইখতিলাফ রয়েছে কিন্তু সঠিক মন্তব্য অনুযায়ী সানাদ ছহীহ।

এই দুইপ্রকার খবারে আহাদ শুধু জ্ঞানের ফায়দা দিবে। তথা মুতাওয়াতির দিবে নিশ্চিত জ্ঞানের আর এই দুই প্রকার দিবে শুধু জ্ঞানের। এক কথায় মুতাওয়াতিরের চেয়ে নিম্ন স্তরের নিশ্চিত জ্ঞানের ফায়দা দিবে।

৬. খবারে ওয়াহিদ নিশ্চিতভাবে জঈফ অথবা জঈফ হওয়া নিয়ে ইখতিলাফ রয়েছে কিন্তু সঠিক মন্তব্য অনুযায়ী জঈফ তাহলে তা ধারণা প্রসূত বলে গণ্য হবে।

বি:দ্র: এই ক্রমধারাটা হুবহু এই ভাবে কোন কিতাবে আসেনি। বিভিন্ন কিতাব মুতা‘লা করে আমার কাছে এই ক্রমধারাটাই সুন্দর মনে হয়েছে। তাই আলেম-ওলামা ও হাদীছ বিশারদগণকে এর উপর উন্মুক্ত মন্তব্য পেশ করার আহব্বান জানাচ্ছি।

খবারে ওয়াহিদ কি ধারণা প্রসূত?

মুতাকাল্লিমীন বা যুক্তিবিদদের নিকটে খবারে আহাদ ধারণা প্রসূত। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক মূলনীতি বিশারদও একই কথা বলেছেন। তারা মনে করেন মুহাদ্দিছগণের নিকটে সকল খবারে আহাদ নিশ্চিত জ্ঞানের ফায়দা দেয়। এই কারণে তারা মুহাদ্দিছদের গইর ফকিহ বা অবুঝও মনে করে থাকে। কিন্তু মুহাদ্দিছগণই হচ্ছেন হাদীছের উপর সবচেয়ে বেশী অভিজ্ঞ। হাদীছ সম্পর্কে তাদের বিশ্লেষণই হয় সবচেয়ে চুলচেরা ও নির্ভরযোগ্য। যুক্তিবিদরা মুহাদ্দিছগণের সম্পর্কে যে মন্তব্য করে থাকে তা অপবাদ বৈ কিছুই নয়। মুহাদ্দিছগণ ব্যাপকভাবে সকল খবারে আহাদকে নিশ্চিত জ্ঞানের ফায়দা প্রদানকারী বলেননি। মুহাদ্দিছগণের নিকটে খবারে আহাদ হাদীছের হুকুম তার সানাদের উপর নির্ভর করে। ছহিহ খাবারে ওয়াহিদ এক রকম ফায়দা দিবে। মুত্তাফাক আলাইহ খবারে আহাদ আরেক রকম ফায়দা দিবে। জঈফ খবারে আহাদ অন্য রকম ফায়দা দিবে। সুতরাং খবারে আহাদ ডাইরেক্ট ধারণার ফায়দা দেয় এই কথা বলার মাধ্যমে যুক্তিবিদগণ নিজেদের র্নিবুদ্ধিতার চরম পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করেছেন।

হাদীছের উপর মুহাদ্দিছগণ যে হুকুম লাগান তা নিশ্চিত হওয়ার পরই লাগান সুতরাং কিভাবে এটা সম্ভব যে, একটা বিষয়ে রাসূলের কথা নিশ্চিত হওয়ার পর মুহাদ্দিসগণ ‘ছহীহ’ হুকুম লাগাচ্ছেন। আর আমি বলছি যে, এটা ধারণার ফায়দা দেয়। রাসূলের কথা নিশ্চিত হওয়ার পরেও কি করে তা ধারণার ফায়দা দিতে পারে?

তাইতো হানাফী মাযহাবের অনেক বড় আলেম আল্লামা সারাখসী সহ আরো দুই মহান আলেম আবু বকর আল জাসসাস এবং ঈসা বিন আবান (রহঃ) বলেছেন, খবারে ওয়াহিদ জ্ঞানের ফায়দা দেয়। কিন্তু তারা নিশ্চিত জ্ঞান ও অন্তরে প্রশান্তিদায়ক জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাদের মতে মুতাওয়াতির নিশ্চিত জ্ঞানের ফায়দা দেয়। আর খবারে ওয়াহিদ ‘ইলমে ত্বমানিনাহ’ ‘প্রশান্তিদায়ক জ্ঞান’-এর ফায়দা দেয়। [উসূলুস সারাখসী (বৈরুতঃ দারিল কিতাব আল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৩) পৃ. ১/২৯২]। (উসূলুল বাযদাবী, ১/১৫৮)

ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ হুকুম আহকামের ভিত্তিই খবারে ওয়াহিদের উপর যেমন, দাদীর জন্য মৃতের সম্পত্তিতে এক ষষ্ঠাংশ নির্ধারণ করা। শুধু হুকুম আহকাম নয় আক্বিদাগত বিষয়ও খবারে আহাদ দ্বারা সকল মাজহাবের আলেমগণ ছাবিত করেছেন। যেমন কবরের আজাব, মহান আল্লাহর দর্শন। এমনও খবারে ওয়াহিদ রয়েছে যার দ্বারা সকল মাজহাবের আলেমগণ কুরআনের আয়াতকে মানসুখ করেছেন। যেমন, কুরআনে মহান আল্লাহ উত্তরাধীকারীদের জন্য ওসিয়ত করার কথা বলেছেন। (সূরা বাকারা-১৮০)। অন্যদিকে উত্তরাধীকারীদের জন্য নির্ধারিত অংশ কুরআনে অবর্তীণ হলে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘উত্তরাধিকারীদের জন্য কোন অসিয়ত নাই’। (ইরওয়াউল গালীল-হা/১৬৩৫)। রাসূলের এই খবারে ওয়াহিদ হাদীছ দিয়ে সকল মাযহাবের আলেমগণ ওসিয়তের আয়াতকে মানসুখ বলেছেন।

সুতরাং এ কথা দিনের আলোর ন্যায় স্পষ্ট যে, খবারে আহাদ যদি ছহীহ হয় তাহলে তা ধারণা প্রসূত হতেই পারেনা। হ্যা, অভিযোগ কারীরা যদি অভিযোগ করে রাবী যতই মজবুত হোক সে কি ভুল করতে পারেনা ? একজন সত্যবাদী কি সবসময় সত্য বলে? সে কি মিথ্যা বলতে পারেনা?

সত্যি বলতে কি এই অভিযোগ যারা উত্থাপন করেন, তাদের মূলত ইলমে হাদীছের সাথে গভীর সম্পর্ক নাই। যাদের ইলমে হাদীছের সাথে সর্ম্পক আছে তারা এই অভিযোগ আনতেই পারেননা। কেননা শত শত হাদীছকে মুহাদ্দিছগণ জঈফ বলেছেন অথচ সেই হাদীছগুলো বাহ্যিকভাবে ছহীহ। রাবী শক্তিশালী ও ন্যায়পরায়ন। সানাদ বিচ্ছিন্ন নয়। তারপরেও মুহাদ্দিছগণ জঈফ বলেছেন। কেন? সেই হাদীছের মধ্যে গোপন ত্রুটি রয়েছে তাই। একজন স্বর্ণকার যেমন নিজের অভিজ্ঞতার বদৌলতে র্স্বণ দেখলেই বলতে পারে নকল না আসল। তেমনি মহান মুহাদ্দিছগণ হাদীছ দেখলেই ধরতে পারেন হাদীছের কোথায় ত্রুটি। আয়নার সামনে যেমন মুখ ধরলে মুখের একটা ছোট্ট দাগও বুঝা যায় তেমনি ইমাম আহমাদ ও বুখারী (রহঃ) দের সামনে হাদীছ ধরলে তারা হাদীছের ছোট্ট ত্রুটিও টের পেয়ে যান। এই গোপন ত্রুটিকে বলে ইল্লাত। কোন হাদীছে ইল্লাত থাকলে মুহাদ্দিছগণ সেই হাদীছকে ছহীহ বলা থেকে বিরত থাকেন। সুতরাং রাবী মজবুত হওয়ার পরেও যদি তার পক্ষ থেকে কোন ত্রুটির আশংকা থাকে তাহলে মুহাদ্দিছগণ অবশ্যই তা ধরতে পারবেন। সুতরাং মুহাদ্দিছগণ সর্বসম্মতিক্রমে যে হাদীছকে ছহীহ বলে থাকেন সেটা রাসূলের কথা হওয়াতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যদি থাকে তাহলে তো হাদীছ শাস্ত্র রক্ষার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। তাইতো সুফিয়ান বিন উয়াইনা (রহঃ) বলেন,

ما ستر الله احدا يكذب في الحديث

তথা: ‘মহান আল্লাহ এমন কাউকে মুহাদ্দিছদের নিকট থেকে গোপন রাখেন নি যে রাসূল (ছাঃ) এর হাদীছের মধ্যে মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়েছে’। [[হাফেয ইরাকী, শারহুত তাবসিরা ও তাযকিরা(মাকতাবাতুল মিশকাত:তাবি) পৃ.১/৯৬]

আল্লাহু আকবার !! আর মহান আল্লাহ গোপন রাখবেনই বা কেমনে? তিনিই তো সেই সত্ত্বা যিনি রাসূলের হাদীছ সংরক্ষণের ওয়াদা করেছেন। আল হামদুলিল্লাহ!! মহান আল্লাহ তার এই ওয়াদা মুহাদ্দিছগণের দ্বারা পূরণ করে নিয়েছেন। তাইতো তারাই এবং যারা তাদের অনুসরণ করে এই উম্মাতের মুক্তিপ্রাপ্ত জামা‘আত। আহ! সেই দিন কতই না গর্বের দিন হবে!! যেদিন মুহাদ্দিছগণ রাসূলের সাথে থাকবেন। যারা রাসূলকে না দেখেও নিজেদের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সেই মহান ব্যক্তির হাদীছকে সংরক্ষণ করেছেন, ক্ষুর্ধাত থেকে, জেলে গিয়ে, চাবুকের বাড়ি খেয়েও সেই ব্যক্তির মুখ নি:সৃত বাণীর প্রচার ও প্রসার বন্ধ করেনি, তারা যখন সেই না দেখা মহামানবের সাথে দেখা করবেন তখন কতই না আনন্দের দিন হবে । আল্লাহ!! আমরা যারা মুহাদ্দিছদের ভালবাসি তাদেরকে সেই দিন মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের একমাত্র ইমাম মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর সাথে থাকার তাওফিক দান কর!

আমীন! ছুম্মা আমীন!!

(খবারে আহাদের প্রকারভেদ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয় পরবর্তী পর্বে ইনশাআল্লাহ। )

বিষয়: বিবিধ

১৫৪৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

339769
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:৪৪
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : যয়ীফ হাদীসের হুকুম কি ?

সকল কিতাবের সকল সহিহ ও যয়ীফ হাদীসগুলোকে চিহিৃত করে পুর্ণাঙ্গ ভাবে এখনো কেন কোন কিতাব লিখা হচ্ছে না ?
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০১:০৭
281143
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক লিখেছেন : যইফ হাদীছ আমল যোগ্য নয়।
অই ভাবে কোনদিন হবেনা। খিদমাট চলতে থাকবে ।
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০১:০৮
281144
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক লিখেছেন : যইফ হাদীছ আমল যোগ্য নয়।
অই ভাবে কোনদিন হবেনা। খিদমাত চলতে থাকবে ।
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০১:১০
281145
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : যয়ীফ হাদীস আমল যোগ্য না হলে বুখারী-মুসলিম সহ সকল কিতাবের মুহাদ্দিসগণ তাদের মাসআলার সপক্ষ্যে যয়ীফ হাদীস দিয়ে দলীল দিলেন কেন ?
339781
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ১০:৪২
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..


অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
339833
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রাত ০১:১০
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক লিখেছেন : ওয়া আলাইকুম আসসালামু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ ।
ওয়া আনতুম ফা জাযাকাল্লাহু খইর ।
339873
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ০৫:৪৬
কাহাফ লিখেছেন :
হাদিস শাস্ত্র নিয়ে জানার আগ্রহী ব্যক্তিদের উপকারে আসবে পোস্ট টা!
জাযাকাল্লাহু খাইর!!
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকাল ১১:৪৬
281247
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক লিখেছেন : ধন্যবাদ । ওয়া আনতুম ফা জাযাকাল্লাহু খইর ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File