*অল্প সময়ে সর্ম্পূণ কুরআন হিফজ*
লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক ১৪ মে, ২০১৫, ০৩:০৩:৫৭ রাত
আমাদের ছেলেরা হিফজ করতে কম সে কম তিন বছর লাগিয়ে দেয়। অনেকেই তো হিফজ এবং হিফজ শেষে দাওর বা রিভাইজ করতে প্রায় ৫/৭ বছর লাগিয়ে দেন। এই দিকে হিফজ খানায় ভর্তি হওয়ার আগে দেখা যাচ্ছে ৫/৬ বছর স্কুলে পড়েছে সব মিলিয়ে হিফজ শেষ করতে করতেই জীবনের একটা বিরাট অংশ পার করে ফেলার মাধ্যমে উজ্জল ভবিষ্যৎকে হুমকির সম্মুখীন করে। ফলত অনেক হাফেজ তাদের পরিধিটা মসজিদের ইমামতি, খুতবা বা তারাবী পড়ানোর বাইরে নিয়ে যেতে পারেন না, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অনেক বড় বাধা। আমার জনৈক শ্রদ্ধেয় উস্তাদ বলতেন ওমর রা: সহ সাহাবীরা তাদের সময়ে একাধারে যেমন কুরআনের হাফেজ ও মুজতাহিদ ছিলেন তেমনি রাজনীতিতে ছিলেন চৌকস এবং পাশাপাশি তীরন্দাজি, ঘোড়সওয়ারী সহ সবকিছুতেই পারর্দশী ছিলেন। আজ যদি তারা জীবীত থাকতেন তাহলে বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছুতে পারদর্শী হতেন। সেই হিসেবে আমাদের হাফেজে কুরআন এবং আলেম ওলামা অনেক পিছিয়ে। অন্য কিছু না হয় বাদই দিলাম কিন্তু পড়াশোনার দিক দিয়েই অনেক হাফেজে কুরআন শুধু কুরআনের শব্দ মুখস্থের উপরই নিজের স্টুডেন্ট লাইফকে শেষ করে দেন। আগ বেড়ে কুরআনের অর্থ জানা, কুরআন থেকে বিভিন্ন যুগপযোগী মাসালা ইস্তিম্বাত করার দিকে পাই বাড়ান না। বাংলা, ইংরেজী তো অনেক দূরের কথা। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে কুরআন হিফজে দীর্ঘসূত্রিতা।
আমি আমার হিফজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই একজন ছেলে এই দীর্ঘসূত্রিতাকে অনেক কমিয়ে আনতে পারে। একজন মধ্যম মানের ব্রেনের ছেলে অনায়াসে ৪ মাসে কুরআন হিফজ করতে পারবে, ৪ মাসে না পারলে খুব জোর ৬ মাস লাগবে এবং আরো ৬ মাস রিভাইজ বা দাওরের মাধ্যমে ৫/৬ বছরের এই দীর্ঘসূত্রিতাকে ১২ মাসে সীমাবদ্ধ করা অনায়াসে সম্ভব .ইনশা আল্লাহ। এর জন্য মেধা লাগবে না শুধু পরিশ্রম লাগবে। শুধুই পরিশ্রম। এই পরিশ্রমকে একটা সুন্দর ছকে বেঁধে নিলে তো কোনও কথাই নাই।
সেই ছকটি শুনার আগে হিফজ খানার কিছু পরিভাষা আমরা দেখব।
সবক: প্রতিদিন ফজর পর নতুন যে পড়াটা ছাত্ররা উস্তাদকে শুনায় সেটাই সবক।
সাত সবক: যে পারা থেকে প্রতিদিন নতুন পড়া শুনাচ্ছে সেই পারাটাকে প্রতিদিন প্রথম থেকে যতদূর হয়েছে ততদূর শুনানোকে বলে সাত সবক।
আমুখতা: যেই পারাগুলো হিফজ করা হয়েছে সেগুলো প্রতিদিন জোহরের পর শুনানোকে বলে আমুখতা। এক কথায় পুরাতন পড়া।
এবার সেই সুন্দর ছকটা আমার জীবনের হিফজের ঘটনাবলীর সাথেই বলি। আজ থেকে 4 বছর আগে দেশ থেকে যখন ভারতে গেছিলাম তখন একটাই লক্ষ্য ছিল জামেয়া সালাফিয়াতে পড়া। জামেয়া সালাফিয়াতে পৌঁছার পর শুনলাম ভর্তির সময় পার হয়ে গেছে। নিয়ম ভেঙ্গে ভর্তি অসম্ভব।
ছোট বেলায় আব্বু কুরআন হিফজ করান নি। কিন্তু বড় হওয়ার পর যখন আলেম ওলামা ও মুজাদ্দিদে উম্মতদের জীবনী পড়তাম তখন দেখতাম অধিকাংশ বড় আলেম কুরআনের হাফেজ। তারা ছোট বেলাতেই মায়ের কাছে কুরআন হিফজ করেছেন। তাই আমার অন্তরে কুরআন হিফজ না করার কারণে একটা গোপন ব্যাথা ছিল। তাই মনে করলাম পরবর্তী বছরের ভর্তির সময় আসার আগে আগে যদি কুরআনটা হিফজ করতে পারি তাহলে মনের ব্যাথাটা একটু হলেও পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ, হিফজে ভর্তি হওয়ার জন্য দরখাস্ত দিলাম জামেয়া সালাফিয়াতে। শায়খুল জামেয়া বললেন হিফজ করতে তো কম সে কম ৩ বছর লাগবে আর তোমার বয়স অনুযায়ী এই তিন বছর হিফজের পিছনে লাগানো ঠিক হবেনা। আমি পরের দিন আবার আরেকটা দরখাস্ত নিয়ে গেলাম। দুইটা দরখাস্তই অবশ্য আরবীতে লিখেছিলাম। পরের দরখাস্তের বিশেষ যে পরিবর্তন ছিল তা হচ্ছে ‘শায়খ! আমার হিফজ করতে ইনশাআল্লাহ ৩ বছর লাগবেনা আমি ৬ মাসে হিফজ করতে পারব।তাই প্লিজ আমাকে জামেয়া সালাফিয়ার হিফজ বিভাগে ভর্তি নিন!’ এবার দরখাস্ত নিয়ে গেছিলাম নাজেম বা প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের বাড়ীতে। দরখাস্তের এই ভাষা এবং আত্ম বিশ্বাস দেখে নাজেম সাহেব দরখাস্তের উপর লেখে দিলেন ‘শায়খুল জামেয়া দেখ লিজিয়ে’ এবং জামেয়াতে গিয়ে শায়খুল জামেয়ার সাথে দেখা করতে বললেন। আমি দরখাস্ত নিয়ে পরেরদিন শায়খুল জামেয়ার কাছে আসলাম । তিনি দরখাস্ত নিয়ে অফিসে গেলেন। অফিসের ভিতরে এই নিয়ে আলোচনা হল। আমার এই কথাটা অনেক শিক্ষকের কাছে আশ্চর্য লেগেছিল। তাদের অনেকেই বের হয়ে আমাকে একবার দেখে নিয়ে বলছিলেন তুমিই ৬ মাসে কুরআন হিফজ করতে চেয়েছ। আমি লজ্জান্বিত হয়ে বলতাম জ্বী। আস্তে আস্তে এই কথা জামেয়ার অনেক ছাত্রের কানে পৌঁেছ গেছিল যে, একজন ছেলে জামেয়াতে ভর্তি হতে চায় সে নাকি ৬ মাসে কুরআন হিফজ করবে। কিন্তু আমার মনের ব্যাথা কেউ বুঝত না । আমি আসলে কোনওমতে জামেয়া সালাফিয়া ছাড়তে চাচ্ছিলাম না। শায়খুল জামেয়া অফিস থেকে বের হয়ে বললেন আসলে ৬ মাসে হিফজ করা অত সহজ নয়। তুমি যখন জামেয়া সালাফিয়াতে পড়ার এতই আগ্রহী তাহলে তুমি আমাদের তাজবীদ বিভাগে ভর্তি হও। দুই বছরের র্কোস। আর যদি হিফজই করতে চাও তাহলে পাশে একটা ভাল হিফজ খানা আছে সেখানে ভর্তি হয়ে যাও! ৬ মাসে হিফজ শেষ করতে পারলে জামেয়া সালাফিয়াতে এসে ফাজিলিয়াতে বা দাওরা হাদীছে ভর্তি হয়ে যাবে।
আমি ভগ্ন হৃদয়ে জামেয়া সালাফিয়া থেকে বের হয়ে আসলাম আর মাথায় একটাই জিনিস ঘুরপাক খেতে লাগল আমাকে ৬ মাসেই কুরআন হিফজ করতে হবে। রুমে এসে কুরআন নিয়ে বসে গেলাম এবং চিন্তার রাজ্যে ঘুরে ফিরে পথ বের করতে লাগলাম কিভাবে ৬ মাসে কুরআন হিফজ করা যায়।
1- আমাদের দেশে ছাপা কুরআনের পৃষ্ঠা ৬০০ পৃষ্ঠার কাছাকাছি। ৩০ তম পারা যেহুতু শুরুতেই মুখস্থ করে নেয়া হয় তাই সেটা বাদ দিলে পৃষ্ঠা সংখ্যা আরো কমে আসে।
2- এক পারাতে সাধারণত ২০ পৃষ্ঠা থাকে।
3- প্রতিদিন ৪ পৃষ্ঠা করে মুখস্থ শুনালে ৫ দিনে এক পারা শেষ করা যাবে।
4- ৫ দিনে একপারা শেষ হলে ১৫০ দিনে কুরআন শেষ করা যাবে।
5- ৩০ দিনে ১ মাস সুতরাং ১৫০ দিন = ৫ মাস।
এই পরিকল্পনা করে জামেয়া সালাফিয়ার র্পাশ্ববর্তী হিফজ খানায় ভর্তি হয়ে গেলাম।
এখন মাথায় ঘুরতে লাগল কিভাবে প্রতিদিন ৪ পৃষ্ঠা মুখস্থ করা যায়। রুটিন তৈরী করলাম।
1- ক্লাসে টিচার আসতেই সকলের আগে সবক শুনাতে হবে।
2- সবক শুনানোর পর সাত সবক ঠিক করে সকলের আগে সাত সবক শুনাতে হবে। এই দুটি
সবার আগে শুনিয়ে দিতে দিতে সকাল ৮ টা বেজে যায়।
3- সকালের খাওয়া দাওয়ার পর থেকে ১০টা সাড়ে দশটা পর্যন্ত দুই পৃষ্ঠা নতুন মুখস্থ করতে হবে।
4- ১১ টা থেকে জোহর পর্যন্ত ঘুম, খাওয়া-দাওয়া এবং গোসল।
5- জোহরের পর সবার আগে আমুখতা শুনিয়ে দিতে হবে।
6- আমুখতা শুনানোর পর থেকে আসর পর্যন্ত আবার নতুন দুই পৃষ্ঠা মুখস্থ। সম্ভব না হলে আসর থেকে মাগরীব পর্যন্ত সময় নিব।
7- মাগরীব থেকে এশা পর্যন্ত যে চার পৃষ্ঠা সারাদিনে মুখস্থ করেছি তা আবার রিভাইজ করা।
8- এশার পর থেকে ঘুমানো পর্যন্ত পুরাতন পড়া ঠিক করা।
9- ফজরের আগে ঘুম থেকে উঠে ফজর পর্যন্ত নতুন সবক আবার রিভাইজ দেয়া।
উপরের রুটিন অনুযায়ী কুরআন মুখস্থ করতে গিয়ে দেখলাম জোহরের পরে আমুখতা শুনানো থেকে শুরু করে একদম মাগরীব পর্যন্ত আমার দুই পৃষ্ঠার জায়গায় তিন পৃষ্ঠা মুখস্থ হয়ে যেত। সুতরাং সাধারণত আমি প্রতিদিন সকালে ৫ পৃষ্ঠা সবক শুনাতাম। আস্তে আস্তে তা বেড়ে হল ৬ পৃষ্ঠা এবং শেষের দিকে এসে সাত পৃষ্ঠা এবং শেষের দিন একসাথে ১৬ পৃষ্ঠা শুনিয়ে আমার কুরআন হিফজ করতে সময় লেগেছিল ৩ মাস ১৩ দিন। আমি কোনও ছুটিকে ছুটি মনে করতাম না। শুক্রবারের দিন সহ প্রত্যেক যেকোনও ছুটির দিন সবক শুনাতাম। ছুটির দিনে সবক শুনার জন্য আমি আমার উস্তাদ লাল মোহাম্মাদ সাহেবের কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব। কোনওদিন ভুলের কারণে টিচার সবক না শুনলে আমার কান্না চলে আসত। আমার এই জীবনে কুরআন হিফজ করার আগে কোনওদিন এবং পরে আজ পর্যন্ত কোনও দিন এত পরিশ্রম করিনি। পরিশ্রমের পাশাপাশি ছিল বিভিন্ন কষ্ট। যেরকম কষ্ট আমার জীবনে কোনওদিন যায়নি। অনেক কষ্ট যেগুলো মানুষ বিশ্বাস করবেনা। এখন কলমেও লিখতে পারবনা।
এত কষ্ট পাড়ি দিয়ে যেই দিন কুরআন হিফজ শেষ করেছিলাম সেই দিনের মত আনন্দ আমার জীবনে আগেও কোনওদিন পাইনি পরেও কোনওদিন পাইনি। সেই দিন আমার হাতে যত টাকা ছিল সব মাদরাসার ছাত্র শিক্ষক বাবুর্চিকে দিয়ে নি:স্ব হয়ে শুধু অঝর ধারায় চোখের পানি ফেলেছি। সেই অশ্রু কোনও বেদনার অশ্রু ছিলনা। ছিল পরম কষ্টের মাঝে পাওয়া আনন্দের অশ্রু।
আর লিখতে পারলাম না......... কুরআন যেন মরা পর্যন্ত ধরে রাখতে পারি সেই দুয়া চাই। ।
বিষয়: বিবিধ
২৩২৪ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কোন বয়সে আপনি শুরু করেছেন তা লেখেন নি। যেভাবে হিসেব করে পরিকল্পিত ভাবে হিসেব করে এগিয়েছেন এবং প্রচণ্ড মনস্তাত্বিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, তা দেখে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মত পরিপক্কতা মনে হয়। পৃথিবীর আর কোন কিছু না দেখে- কেবল একাগ্রচিত্তে নিজের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়েছেন! তিন মাস তের দিন! এর আগে এক এত কম সময়ে হিফজ করার কথা শুনি নাই! মাশাআল্লাহ। অনেকের কাছে এটা চমক লাগানো দৃষ্টান্ত বলে মনে হবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য।
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 7228
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
আপনার অনুপ্রেরনা থেকে এই ৩৫ বছর বয়সে হিফজ করার শখ আবারও বেড়ে গেল।
ধন্যবাদ আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য।
ইউ আর গ্রেইট ব্রাদার!
অনেক অনেক দোয়া রইল।
অনুযায়ী হাফেজী মাদ্রাসা গুলো চলা উচিৎ।
অতি অল্প সময়ে প্রচুর হাফেজ তৈরী করা।
আপনার পরিকল্পনা ফলপ্রসু। আপনাকে প্রিয়তে
এড করে রেখেছি।
পোস্টটি পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম আপনার অবস্থান জান্নাতে আমাদের সবার চাইতে কতো উঁচুতে হবে! সুবহান আল্লাহ!
এই ধরনের অনুপ্রেরনা মূলক পোস্টগুলো পড়লে ঝিমিয়ে যাওয়া মনটা আবারো সচেতনতায় নড়ে চড়ে উঠে আলাহমদুলিল্লাহ!
অনেক অনেক দোআ, শুভেচ্ছা ও শুভাকামনা রইলো! আপনার দোআয় আামদের শামিল রাখতে ভুলবেন না!
মন্তব্য করতে লগইন করুন