শাহ্‌ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসী দেহলভী (রহঃ) এর মতানুসারে হাদীসগ্রন্থের স্তরবিন্যাস:

লিখেছেন লিখেছেন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক ১১ নভেম্বর, ২০১৪, ১০:১৯:৪৫ রাত

হাদীস সংকলনের কয়েকটি স্তর ও বিভিন্ন মর্যাদা বিন্যস্ত হয়েছে:

=> হাদীসের সর্বোত্তম শ্রেনী হলো মুতাওয়াতের হাদীস। সমগ্র উম্মত তা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত।

=> দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত মুস্তাফীজ হাদীস। তাতে কোনো নির্ভরযোগ্য সংশয় অবশিষ্ট নেই। যুগের অধিকাংশ ফিকাহবিদ তা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একমত হয়েছেন। অথবা সে সব হাদীস বিশেষত হারামাইন শরীফের আলিমদের মাঝে সেগুলোর ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। যেহেতু প্রাথমিক যুগে খোলাফায়ে রাশেদীনের রাজধানী ছিল হারামাইন এবং সব যুগের হাদীসের আলেমগণ সেখানে যাতায়াত করতেন, তাই সেখানকার হাদীস বেত্তা আলেমগন কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা সমর্থন করতে পারেন না। অথবা সে সব হাদীস যা এক বিশাল এলাকায় মশহুর ও সুপরিচিত এবং সে এলাকার সব মুসলমান তা মেনে চলছে। আর তা বর্ণিত হয়েছে সাহাবা ও তাবেঈনদের বড় একদল থেকে।

=> তৃতীয় স্তরে রয়েছে সে সব হাদীস যার সনদ সহীহ কিংবা হাসান এবং হাদীস বিশারদ আলেমগণ তার সপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু সে হাদীস এরূপ মাতরুক নয় যে, কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করেন নি।

=> পক্ষান্তরে যে হাদীসের সনদ ও মতন অর্থাৎ সূত্র ও বাক্য মাওজু ও জঈফ হয় কিংবা মাকলুব বা মাজহুল হয় এমন বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত হয় কিংবা সে যুগের মরুস্তরের পূর্বসূরিগণ সে বর্ণনার বিরুদ্ধে একমত, এ ধরনের বর্ণনা গ্রহনের কোনো উপায় নাই।

হাদীসগ্রন্থের স্তরবিন্যাস:

———————

১. প্রথম স্তর: প্রথম স্তরের কিতাবের ভেতর সর্বোচ্চ মর্যাদা সেই কিতাবের, যার ভেতর মুতাওয়াতের হাদীসের সমাবেশ ঘটেছে। পরবর্তী মর্যাদায় রয়েছে অকাট্য বিশুদ্ধ হাদীসের কিতাব। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, প্রথম স্তরের মাত্র তিনটি হাদীস গ্রন্থ রয়েছে:

ক) মুয়াত্তা ইমাম মালিক

খ) সহীহ বুখারী

গ) সহীহ মুসলিম

ইমাম শাফেয়ী (রহHappy বলেন: আল্লাহ্‌র কিতাবের পর বিশুদ্ধতর কিতাব হলো মুয়াত্তা ইমাম মালিক। এ ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিস একমত যে, ইমাম মালেক ও তাঁর মতাবলম্বীদের মতানুসারে মুয়াত্তর সকল হাদীসই বিশুদ্ধ। পক্ষান্তরে, তাঁর বিরোধীদের মতানুসারেও তাতে এমন কোনো মুরসাল ও মুনকাতে হাদীস নেই যার সনদ ভিন্ন ধারার মাধ্যমে মুত্তাসিল হয়নি। এ দিক বিবেচনায়ও সংকলনটি সহীহ।

=> যদি সুস্পষ্ট সত্য বুঝতে চান তো মুয়াত্তার সাথে ইমাম মুহাম্মদের কিতাবুল আছার ও ইমাম আবূ ইউসুফের কিতাবুল আমাল তুলনা করুন। অনেক পার্থক্য দেখতে পাবেন। আপনি কি কখনো দেখেছেন যে, কোনো মুহাদ্দিস বা ফকীহ সে কিতাব দুটোর দিকে আদৌ ভ্রূক্ষেপ করেছেন?

=> সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের ব্যাপারে সকল মুহাদ্দিস একমত যে, সে দু’গ্রন্থে যে সব মুত্তাসিল ও মারফূ বর্ণনা রয়েছে তা সবই অকাট্যরূপে বিশুদ্ধ। আর সে বর্ণনাগুলো গ্রন্থকারদের পর্যন্ত মুতাওয়াতের বর্ণিত হয়েছে। যে লোকই এ দুটোকে সাধারণ কিছু ভাববে সে বিদআতী। সে ঈমানদের পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে পা বাড়িয়েছে।

* যদি এ সত্যটি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে চান তাহলে এ গ্রন্থদ্বয়ের সাথে ইবনে আবি সায়বার কিতাব, তাহভীর কিতাব ও মুসনাদে খাওয়ারিযমীর তুলনা করুন। তাহলে সেক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাবেন।

২. দ্বিতীয় স্তর: এ স্তরে সে সব সংকলন রয়েছে যার মান সহীহাইন বা মুআত্তার পর্যায়ে নয়। অবশ্য তার কাছাকাছি বলা যায়। সেগুলোর রচয়িতাদের নির্ভরযোগ্যতা, ন্যায়ানুগতা, স্মৃতিশক্তি ও হাদীস শাস্ত্র সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের গভীরতা রয়েছে। তাদের সংকলনে হাদীস নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে সব শর্ত অনুসরণ করেছেন তাতেও কোনো দুর্বলতা নেই। পববর্তী যুগের লোক তাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সব যুগের ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ তাদের সংকলনের ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। ফলে সর্বস্তরের লোকদের ভেতর তা খ্যাতি অর্জন করেছে। উলামায়ে কিরাম সে সবের গরীব হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বর্ণনাকারীদের বিশ্লেষণ করেছেন, মাসআলা মাসায়েল উদ্ভাবন করেছেন ও সেগুলোকে জ্ঞান অর্জনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেমন –

ক) সুনানে আবু দাউদ

খ) জামে আত-তিরমিযী

গ) আল মুসতাবানে আন-নাসায়ী

=> এ সংকলনগুলো প্রথম স্তরের কাছাকাছি স্তরে রয়েছে। ইমাম রযীন ‘তাজরীদুস হিহাহ্‌’ ও ইবনে আছীর ‘ জামেউল উসুল’ গ্রন্থে সে সব সংকলনের হাদীসগুলো সন্নিবেশিত করেছেন।

ঘ) মুসনাদে আহমদও এ স্তরের কাছাকাছি রয়েছে। কারণ, ইমাম আহমদ এ মূলনীতি গ্রহণ করেছেন যে, এ সংকলন দ্বারা সহীহ ও গায়রে সহীহ হাদীসের পার্থক্য জানা যাবে। বস্তুত তিনি বলেছেন – এ কিতাবে যে হাদীস ঠাঁই পায়নি তা গ্রহন করো না।

৩. তৃতীয় স্তর: এ স্তরের হাদীসের কিতাব হলো সে সব মুসনাদ, জামে ও মুসান্নাফ রয়েছে যেগুলো বুখারী ও মুসলিম সহ সমসাময়িক কালে রচিত কিতাবসমূহের আগের যুগের কিংবা পরে রচিত হয়েছে।

এসব গ্রন্থে সহীহ, হাসান, যঈফ, মা’রূফ, গরীব, শায, মুনকার, ভুল, সঠিক, ছাবেত, মাকলূব (transposed) – এক কথায় সব ধরনের সব ধরনের হাদীস জমানো হয়েছে। আলেমদের ভেতর সেগুলো তেমন খ্যাতিও অর্জন করেনি। অবশ্য সেগুলোর সাধারণ পরিচিতি রয়েছে। যেমন-

ক) আবূ আলীর মুসনাদ

খ) আবদুর রাজ্জাকের মুসান্নাফ

গ) আবূ বকর ইবনে শায়বার মুসান্নাফ

ঘ) আব্দ ইবনে হামীদের মুসনাদ

ঙ) মুসনাদে তায়ালেসী,

চ) বায়হাকীর কিতাব

ছ) তাহাভীর কিতাব ও

জ) তাবরানীর কিতাব

=> সে সব মুহাদ্দিসদের উদ্দেশ্যই ছিল যা কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় তা সবই সংকলিত করা। সেগুলো ছাঁটকাট করা, বিন্যস্ত করা ও কালোপযোগী করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।

৪. চতুর্থ স্তর: এ স্তরের কিতাব সেগুলো যার রচয়িতারা দীর্ঘকাল পর এ নিয়ত করলেন যে, পূর্ববর্তী দু’স্তরের কিতাবে যে সব হাদীস নেয়া হয়নি সেগুঅে একত্রিত করবেন। সে সব হাদীস মূলত যত অখ্যাত ও অপরিচিত কিতাবে মওজুদ ছিল। তারা সে হাদীসগুলোর গুরুত্ব দিলেন। এ সব হাদীস এমন সব রাবীদের থেকে বর্ণিত হয়েছে যাদের হাদীস মুহাদ্দিসরা লিপিবদ্ধ করেন নি। সে সব বর্ণনাকারীরা ছিলেন যত সব ওয়ায়েজ, আনুসঙ্গিক কথা বলার লোক ও দুর্বল স্মৃতিসম্পন্ন লোক। তারা মূলত সাহাবা ও তাবেঈনদের কথাকেই হাদীস বলেছেন, অথবা বনী ঈসরাঈলদের প্রচারিত কাহিনী বর্ণনা করেছেন কিংবা জ্ঞানী গুনী ও ওয়ায়েজদের কথাকেই ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় নবীর হাদীস বলে চালিয়েছেন। অথবা কুরআন ও সহীহ হাদীসের এক অস্বচ্ছ ধারণাকে একদল নেককার লোক মারফূ হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন। কারণ, রিওয়াতের তত্ত্বই তাদের জানা ছিল না। কিংবা কিতাব ও সুন্নাতের ইঙ্গিতবহ একটি তাৎপর্যকে বর্ণনাকার ইচ্ছাকৃতভাবে মুত্তাসিল হাদীসরূপে বর্ণনা করেছেন। অথবা সে বর্ণনাটির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন হাদীসে ছিল। সেগুলো একত্রে করে একটি স্বতন্ত্র হাদীস বানিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে হল-

ক) ইবনে হিব্বানের কিতাব আল যুয়াফা

খ) ইবনে আদীর আলকামিল

গ) খতীব এ সংকলন

ঘ) আবু নাঈস এর সংকলন

ঙ) জুযকানীর সংকলন

চ) ইবনে আসাকির সংকলন

ছ) ইবনে নাজ্জার সংকলন

জ) দায়লামীর সংকলন

ঝ) মুসনাদে খাওয়ারিজমী

=>এ স্তরের কিতাবের সবচেয়ে উত্তম হাদীস হলো যঈফ ও মুহতামাল হাদীস এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট হাদীস হলো মাউজু ও মাকলূব হাদীস এবং চরম পর্যায়ের মুনকার হাদীস। ইবনে জাওযীর ‘আল-মাওজুআত’ এ স্তরের কিতাব।

৫. পঞ্চম স্তর: এ স্তরের হাদীসগুলো ফকীহ, সূফী, ঐতিহাসিক প্রমূখের মুখে মুখে চালু হয়ে গেছে, অথচ আগের চার স্তরে তার কোনো ভিত্তি নেই। এ স্তরের হাদীসের ভেতর সে সব হাদীসও রয়েছে যা বেদ্বীন ভাষাভাষীরা তৈরি করে চালু করেছে। তারা এমন সব শক্তিশালী সূত্রের বরাত দিয়ে তা চালু করেছে যাদের সমালোচনাও চলে না। তদুপরি এরূপ আল তারিফ ভাষায় তা বানানো হয়েছে যা হুযুর (সাHappy এর ভাষায় মতোই মনে হয়। তারা ইসলামের ভেতর মারাত্মক গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু যখন বড় বড় হাদীস বেত্তা আলেম সেসব হাদীস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার মুতাবিআত ও শাওয়াহেদ পরখ করেছেন, তখনই তার আবরণ উন্মোচিত হয়েছে এবং হাকীকাত জাহের হয়েছে। অবশ্য মুহাদ্দিসগন পয়লা দুই স্তরের হাদীসকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেন।

=>তবে তৃতীয় স্তরের হাদীসের ওপর আমল করা ও তার স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে শুধু বড় বড় উঁচুদরের মুহাদ্দিসরাই পদক্ষেপ নিতে পারেন। কারণ, তারা রাবীদের পরিচিতি ও বর্ণনার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল রয়েছেন। অবশ্য এ স্তরের হাদীসগুলো থেকে অধিকাংশ মুতাবিআত ও শাওয়াহেদ সংগ্রহ করা হয়েছে। কারণ ‘আল্লাহ সব বস্তুর একটা পরিমাপ নির্ধারণ করেছেন’।

=>চতুর্থ স্তরের হাদীসগুলো সংকলিত করা, তা থেকে মাসআলা উদ্ভাবন ও তা নিয়ে গবেষণা চালানো উত্তরসূরিদের কাজ।

=>> যদি সত্য কথা জানতে চান সেটা এই যে, রাফেজী, খারেজী ও বিদআতীরা এসব হাদীস থেকেই তাদের স্বপক্ষে দলীল ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করে থাকে। এ কারণেই হাদীসবেত্তা উলামায়ে কেরাম এসব হাদীস থেকে দলীল প্রদান বৈধ ভাবেন না। আল্লাই সর্বজ্ঞ।

সোর্স: হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, অধ্যায় ৭৭: হাদীস গ্রন্থের স্তরবিন্যাস

সংকলনেঃ মুহসিন জামান

বিষয়: বিবিধ

১০০০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

283705
১২ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:০৮
বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর । ভালো লাগলো ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File