ধর্মান্তরিত এক আলেমকে নিয়ে জার্মানির ঘুম হারাম!!
লিখেছেন লিখেছেন আবদুল্লাহ মাহমুদ ১৬ নভেম্বর, ২০১৪, ১২:২২:১৬ দুপুর
সভেন লাউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী একজন জার্মান। জার্মানির একটি ক্যাথলিক পরিবারে তার জন্ম। বর্তমানে তিনি ইসলামের সালাফীবাদের একজন সমর্থক হিসাবে পরিচিত। ৩৪ বছর বয়সী লাউ পূর্বে একজন দমকলকর্মী ছিলেন।
জার্মান কর্তৃপক্ষ লাউকে পর্যবেক্ষণ করতে অন্তত আট বছর সময় ব্যয় করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করেন যে তিনি একজন ‘মৌলবাদী’ ইসলাম প্রচারক এবং সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাোযোগ রয়েছে। তার মাঝে কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
জার্মান কর্মকর্তারা বলছেন, লাউ জার্মানিতে ইসলাম প্রচারকারী বিশিষ্ট আলেমদের অন্যতম। তার মাঝে এমন কিছু আধ্যাত্মিক শক্তি বা বাণী রয়েছে যেটি সহজেই জার্মান তরুণদের ইসলাম গ্রহণে প্রভাবিত করে।
জার্মানির একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান লাউকে দেশের একজন ‘শীর্ষ প্রচারকারী’ বলে অভিহিত করেছেন।
কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করছে যে লাউ তার অনুসারী কিছু তরুণদের সিরিয়া ও ইরাকে আইএসের সাথে যুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করছেন এবং জার্মানি ও পশ্চিমাদের উপর ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলার হুমকি দিচ্ছেন।
তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
পুরো জার্মান জুড়ে বিভিন্ন শহরে শত শত শ্রোতাকে ধর্মোপদেশ প্রদান করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা টেলিফোনে আড়ি পেতে তার কথোপকথন রেকর্ড করাসহ তার বাড়ি ও কম্পিউটারে তল্লাশি অভিযান চালায়।
ইসলামিক স্টেটকে সমর্থন বা কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদের সাথে তার সম্পৃতার অভিযোগকে তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। ইতোপূর্বে কয়েকবার সিরিয়া গমন করেছেন তিনি। লাউ বলেছেন, মানবিক সহায়তার কাজে তিনি সেখানেগিয়েছেন।
জার্মান কর্তৃপক্ষ বলছেন যে, লাউকে তাদের গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বুর্কহার্ড ফ্রিয়ার অভিযোগ, ‘তিনি ক্রমাগতভাবে তরুণদেরকে চরমপন্থী বানাচ্ছেন এবং অঞ্চলটিকে ভবিষ্যত সহিংসতার একটি উর্বর ভূমিতে পরিণত করছেন।’
লাউর নিজ শহর উত্তর রাইনের ওয়েস্টফেলিয়ায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জার্মান কর্তৃপক্ষ লাউকে সিরিয়া থেকে ফিরে আসার পর গ্রেপ্তার করে। বিদেশী সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদান এবং নাশকতামূলক কাজে জড়িত থাকার সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
স্টোটগর্টের প্রসিকিউটর তার বিরুদ্ধে আনা এক অভিযোগে বলেন, লাউ এবং তার একজন সহযোগী ৩৭ বছর বয়সী এক জার্মানকে সিরিয়ার জেহাদী বাহিনীর সাথে যোগ দিতে প্ররোচিত করেন।
এছাড়াও কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে যে, লাউ গত ফ্রেব্রুয়ারীতে সিরিয়ার জিহাদিদের জন্য একটি এম্বুলেন্স ক্রয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন এবং দুজন ব্যক্তিকে কয়েক হাজার ইউরোর বিনিময়ে এটি ক্রয় করতে প্ররোচিত করেন।
কিন্তু লাউ তার বিরুদ্ধে আনা এ সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার আইনজীবী মুতলো গুনাল জানান, জার্মান কর্তৃপক্ষ তার মক্কেলের ফোনালাপের যে দলিল দেখাচ্ছে তাতে দেখা যায়, তিনি আলেপ্পোর একটি হাসপাতালের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন।
যদিও গুনাল ও জার্মান কর্মকর্তারা লাউর ফোনালাপের রেকর্ড প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন।
লাউর কথিত সহচর ইসমাইল ইসাকে একটি পৃথক মামলায় বিচারের সম্মুখীন কর করা হচ্ছে। ফেডারেল প্রসিকিউটর ইসার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে, ২০১৩ সালের আগস্টে ইসলামী জঙ্গিদের সমর্থনে তিনি সিরিয়া গমন করেন এবং যোদ্ধাদের জন্য নগদ অর্থ ও চিকিৎসা সহায়তা এবং সামরিক অস্ত্র সরবরাহ করে দুই মাস পরে ফিরে আসেন।
ইসার আইনজীবী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
গত মে মাসে লাউকে তিন মাস জেলে আটক রাখা হয়। এরপর কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তুলে নেয় এবং তাকে মুক্তি দেয়।
স্টোটগর্টের প্রসিকিউটর বলেন, একটি ফৌজদারি অপরাধের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ না থাকায় জার্মান আদালত সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে তাকে মুক্তি দেন।
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেন, সন্ত্রাস-সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য গত মাস পর্যন্ত লাউ তাদের তদন্তাধীনে ছিল।
লাউ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তারা আমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের কোনো কিছুই খুঁজে পায়নি।’
তাকে একটি মসজিদে প্রাই অবস্থান করতে দেখা যায়। মসজিদটি সর্ম্পকে তিনি বলেন, ‘এখানে অপরাধ করার মত কোনো কিছুই নেই।’
পাচঁ সন্তানের জনক লাউ বাস করেন রাইনল্যান্ড শহরের মনচেনগ্লাডব্যাচে। সেখানে ১৮ বছর বয়সে একজন তুর্কির সাক্ষাৎ পান এবং তার শিষ্য হিসেবে লাউ তার নাম নথিভুক্ত করেন।
লাউ একটি অনলাইন ভিডিও সাক্ষাৎকারে তার ইসলামে রূপান্তরের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, ‘তিনি (তুর্কি) আমাকে বললেন, আমাদের এই জীবন একটি পরীক্ষা মাত্র এবং এই জীবনের পরে আমাদের হয় জান্নাত অথবা জাহান্নামে যেতে হবে। অবশেষে তার কাছে আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পাই।’
তিনি জানান, তার সাথে সাক্ষাতের চার বছর পর তিনি একজন আরব বন্ধুর কথা জানতে পারেন যিনি নিজেকে একজন সালাফি বলে পরিচয় দেন। পরে তিনি ঐ আরব লোকটির সাথে দেখা করেন।
জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, ‘২০০৬ সালে প্রথমবারের মত তার উপর আমরা নজর রাখতে শুরু করি। এ সময় তিনি মদ খাওয়া ছেড়ে দেন। লুউ স্থানীয় চ্যাম্পিয়নশীপের একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় ৮০০ মিটার দৌড়ে মাত্র দুই মিনিট ছয় সেকেন্ড সময় নেয়। তার প্রশিক্ষক হান্স ইরেকলেন্জের সাথে সাক্ষাত করার জন্য মাঠ হতে দৌড়ে আসার সময় তিনি একটি ইসলামী বই প্রশিক্ষকের হাতে দেন।’
তার সাথে অংশ নেয়া হেরাল্ড মোল নামে অন্য একজন প্রতিযোগী জানান, তরুন লাউকে সবসময় তার নতুন ধর্মের উদ্দেশ্যে কাজ করতে দেখা যেত।
মোল বলেন, লাউ একটি আবদ্ধ রুমে প্রার্থনা করতেন এবং প্রার্থনা শেষে তাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য ‘প্ররোচিত’ করতেন।তিনি আরো জানান, তার স্ত্রী মারা যাবার পর লাউ তাকে মরোক্কোর একজন নারীর সাথে তার বিয়ের কথা বলেন। যদিও লাউ এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।
মোল বলেন, ২০০৮ অথবা ২০০৯ সালের দিকে লাউ স্থানীয় দৌড় ক্লাব হতে প্রশিক্ষন নেয়া ছেড়ে দেন। ২০১০ সালের দিকে লাউ জান্নাতের আমন্ত্রণ নামে সালাফি সংগঠনের নেতা হন যেটি সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হান্স-জর্জ ম্যাসেন বলেন, ২০১৩ সালের দিকে লুউ অধিক মাত্রায় চরমপন্থী হন। মিশরে প্রায় এক বছর আরবি এবং ইসলাম নিয়ে গবেষণা করার পর সিরিয়ায় সাহায্য প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করেন।
২০১৩ সালের মে মাসে অনলাইনে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে লাউ দর্শকদের আহ্বান জানান কারারুদ্ধ মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য। ভিডিওটিতে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে সেরা কাফেরের চেয়ে একজন সাধারন মুসলিম অধিক উত্তম।'
২৩ মার্চ ম্যানহেইমে অনুষ্ঠিত লাউর একটি র্যালিতে শত শত লোক উপস্থিত হয়।
সেখানে তিনি জার্মানিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জার্মান সরকার কর্তৃক বৈষম্যের অভিযোগ আনেন। একই সভায় তিনি সিরিয়ায় মুসলমানদের দুর্ভোগের কথা বলেন।
স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যম জানায়, ঐ সভায় ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় জনতার মধ্যে দুজন লোক ইসলামিক স্টেটের পতাকা উড়াচ্ছে। এর পরপরই লাউকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারন করলে লাউ এবং ভোগেল নামে তার একজন সহযোগী সিরিয়ার যুদ্ধে আহতদের সহায়তা করার কথা বলে অনুদান সংগ্রহ করেন। লাউর মত ভোগেলও একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম।
লাউ বলেন, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুদ্ধে আহতদের সহায়তা এবং বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে তিনি সেখানে তিনবার গমন করেছেন।
গত সেপ্টেম্বরে পোষ্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, উপারতালের রাস্তায় চৌকি বসিয়ে লাউ ও তার একজন সহযোগী যুবকদের থামিয়ে মদ না খাওয়া ও জুয়া না খেলার পরামর্শ দিচ্ছেন।
ভিডিওটি জার্মানিতে নিন্দা এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করে। জামান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেলসহ অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে লাউ বলেন, ক্যামেরার জন্য চৌকি স্থাপন করা হয়েছিল এবং এটি পুলিশী ক্ষমতা প্রদর্শনের কোনো প্রচেষ্টা ছিল না।
জার্মান কর্মকর্তারা মনে করছেন অভিবাসীদের পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক জার্মানরাও ব্যাপকহারে ইসলামী চরমপন্থী হচ্ছেন।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, সালাফি আন্দোলন এখন দেশের দ্রুত বর্ধমান একটি ইসলামী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জনান, ৪৫০ জনেরও বেশি জার্মান নাগরিক ইসলামী জঙ্গিদের সমর্থন ও তাদের সাথে যোগ দিতে সিরিয়া গমন করেছেন।
তারা আরো বলেন, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্য ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং বেলজিয়ামের পাশাপাশি জার্মানিও মধ্যপ্রাচ্যে বিদেশি যোদ্ধাদের একটি বৃহত্তম উৎসে পরিণত হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলেন, অন্তত সাত জন জার্মান নাগরিক সিরিয়া ও ইরাকে আত্মঘাতী হামলায় অংশ নিয়েছে। অক্টোবরে ইসলামিক স্টেটের পোস্ট করা একটি প্রোপাগান্ডামূলক ভিডিওতে দেখা যায়, জঙ্গিরা মার্কেলের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং ইউরোপের মুসলমানদেরকে ইরাক যুদ্ধে যোগদান করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন।
লাউ বলেন, সিরিয়াতে যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের সর্ম্পকে তিনি জানেন কিন্তু তিনি কাউকে সেখানে যাবার জন্য উপদেশ দেননি। তিনি স্বীকার করেন মনস্তাত্বিক প্রভাবের কারণে তারা যুদ্ধে অংশ নিয়ে থাকতে পারে।
জার্মান কর্তৃপক্ষ সিরিয়ায় তার নাগরিকদের গমন ঠেকাতে ও সন্দেহভাজন ইসলামী জঙ্গি সমর্থক এবং সিরিয়া হতে ফেরত আসা যোদ্ধাদের ধরতে একটি আইনগত ভিত্তি খুঁজার চেষ্টা করছেন।
এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ জার্মান যুদ্ধা সিরিয়া থেকে ফিরে এসেছে বলে জানা যায়। ইতোমধ্য তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাদের জার্মান পাসপোর্ট প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
গত অক্টোবরে জার্মান পুলিশ অন্তত চারজন সন্দেহভাজন ইসলামিক স্টেট সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে।
প্রসিকিউটরা জানান, একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সিরিয়ার ইসলামী মিলিশিয়া আহরার আল-শামের জন্য ৭,৫০০ জোড়া বুট জুতা, ৬,০০ সামরিক জ্যাকেট ও ১০০ টি সামরিক শার্ট বিতরণ করা হয়েছে যা তারা তদন্ত করছে।
লাউ উপারতালের দারুল আরকাম মসজিদের দ্বিতীয় তলায় তার একটি কক্ষে অবস্থান করে এবং সেখান হতে ধর্ম প্রচার করেন।
লাউ এবং তার ৩ বছর বয়সী ছেলে তরুণদের সাথে হাত নেড়ে তাদের নামাজের জন্য আহ্বান জানান।
কিছু নৃতাত্ত্বিক জার্মানসহ মোটামুটিভাবে ৮০% লোক, যাদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকান, এই মসজিদের ধূসর-কার্পেট বিছানো নামাযের কক্ষে জড়ো হয়। কিছু লোক প্রথাগত মুসলিম পোশাক পরেন কিন্তু অধিকাংশই জিন্স, কার্গো প্যান্ট পরিধান করেন।
১৫ বছর বয়সী ফ্যাকাশে স্বর্ণকেশী চুল এবং উজ্জ্বল নীল চোখের অধিকারী এক বালক লাউ সর্ম্পকে বলেন, ‘তিনি খুবই ভাল একজন লোক।’
অন্য আরো একজন বালক বলেন, ‘বলতে গেলে তিনি একজন রোল মডেল।’
সূত্র: ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল
বিষয়: বিবিধ
১২৬৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন