পার্থিব জীবন, ভোগ, আনন্দ এবং মুমিনের আনন্দময় ভারসাম্যপূর্ণ জীবন
লিখেছেন লিখেছেন নুমান আলী খান কালেকশন বাংলা ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০১:৫৭:০৫ দুপুর
বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম
কু’রআনে এই কথাগুলো বার বার আসে: সুস্বাদু খাবারের কথা, জীবনকে উপভোগ করার কথা, আল্লাহর ﷻ সৃষ্টি করা এই অত্যন্ত সুন্দর পৃথিবী এবং আকাশ ঘুরে দেখা। আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে কু’রআনে বার বার তাঁর অনুগ্রহের কথা চিন্তা করতে বলেছেন, আমাদেরকে হালাল উপায়ে জীবনকে উপভোগ করে আখিরাতে আরও বেশি আনন্দের জন্য চেষ্টা করতে বলেছেন।
কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে অনেক মুসলিমের ভেতরে একটি ধারণা চলে এসেছে যে, যদি একজন আদর্শ মুসলিম হতে চাও, তাহলে আজকে থেকে জীবনের সব আনন্দ ছেড়ে দিয়ে, কোনোমতে চলে–এরকম একটা জীবন-যাপন করো এবং নিজেকে যত পারো কষ্টের মধ্যে রাখো। হাজার হলেও, হাদিসে আছেঃ “দুনিয়া মু’মিনের জন্য জেলখানা, কাফিরের জন্য বেহেশত।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহ মুসলিম)
এটি একটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা যে, একজন আদর্শ মুসলিম হতে হলে জীবনের সব হালাল আনন্দ, সম্পদ অর্জনের সুযোগ, উচ্চতর ডিগ্রি পাওয়ার চেষ্টা – এই সব ছেড়ে দিয়ে, গরিবের মতো জীবন যাপন শুরু করতে হবে। “সবসময় মুখ গম্ভীর করে রাখতে হবে, যেন মানুষ আমাকে দেখলেই বুঝতে পারে আমি একজন খাঁটি ঈমানদার। সস্তা, সাধাসিধে, তালি দেওয়া কাপড় পড়তে হবে, যেন আমাকে দেখলে মনে হয় আমি একজন আদর্শ সুন্নতি বান্দা। পরিবারকে নিয়ে ভুলেও রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে, সবাই যাকাত দিয়ে, সব গরিব মানুষ সচ্ছল হয়ে না যাচ্ছে। দিনরাত নিজেকে বিভিন্ন ধরনের কষ্টের মধ্যে রাখতে হবে। কারণ যত বেশি কষ্ট, তত বেশি সওয়াব”— এগুলো সবই ভুল ধারণা, যা হাদিসটির বিভিন্ন ধরনের অপব্যাখ্যা থেকে এসেছে। এধরনের অপপ্রচারের কারণে আজকাল মানুষ ‘ইসলাম’ মানেই মনে করে একটি বন্দি, হতাশাকর, বিষণ্ণ জীবন ব্যবস্থা।
এই দুনিয়াতে মানুষের আত্মাকে আল্লাহ ﷻ দেহ নামের এক জেলখানায় ভরে দিয়েছেন। এই জেলখানায় থাকার অনেক নিয়মকানুন আছে। এখানে কিছু কাজ করা নিষিদ্ধ, কিছু কাজ নিয়মিত করা বাধ্যতামূলক। এই নিয়মগুলো দেওয়া হয়েছে জেলখানার সবার ভালোর প্রতি লক্ষ রেখে, জেলখানায় নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। এই হচ্ছে জেলখানার প্রকৃতি। একজন মু’মিনের কাছে এই ব্যবস্থাকে একটা জেলখানার মতো মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা এবং সে সেটা মেনে নেয়।
কিন্তু অবিশ্বাসীরা এটা বিশ্বাস করতে চায় না যে, একদিন কিয়ামত হবে, বা মৃত্যুর পরে আর কোনো জীবন আছে। তারা মনে করেঃ এই দুনিয়াটাই হচ্ছে তাদের বেহেশত — এখানে কোনো নিয়ম নেই, কোনো নিষেধ নেই, যখন যা খুশি তাই করা যাবে। যেহেতু তাদের কাছে এই দুনিয়াটাই হচ্ছে একমাত্র জীবন, এর পরে আর কোনো অস্তিত্ব নেই, তাই তারা এই দুনিয়াটাকে তাদের মতো করে বেহেশত বানিয়ে, যতটুকু সম্ভব আমোদ ফুর্তি করে যেতে চায়। এই দুনিয়ার মতো ক্ষণস্থায়ী একটা জায়গা, যেখানে অসুখ হয়, প্রিয়জনেরা হারিয়ে যায়, পদে পদে নানা কটু কথা, অন্যায় সহ্য করতে হয় – এটাই তাদের শেষ বেহেশত। এরপরে আর কিছু পাওয়ার আশা নেই।
এরকম একটি ধারণা মানুষকে কতখানি হতাশ করে দেয়, সেটা আমাদের মুসলিমদের পক্ষে চিন্তা করাটা কঠিন। একটা মানুষ যখন প্রতিদিন নিজেকে বোঝায়ঃ “একদিন আমি মরে যাবো, আর এই সবকিছু হারিয়ে যাবে, আমার পরিবার আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, আর কোনোদিন আমি তাদেরকে পাবো না; আমার সব সম্পত্তি একদিন আমার কাছ থেকে চলে যাবে, আমার অস্তিত্ব একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, আর মাত্র কয়েকটা বছর, তারপর সব শেষ” – কী ভয়ংকর হতাশাকর পরিস্থিতির মধ্যে তাকে জীবনটা পার করতে হয়। সে তখন মরিয়া হয়ে যায় এই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যত বেশি করে পারে আনন্দ করে নিতে। তখন সে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মরিয়া হয়ে উত্তাল জীবন যাপন করে। যৌবন শেষ হয়ে গেল, শরীর নষ্ট হয়ে গেল – এই তাড়নায় ছুটতে থেকে অশ্লীল কাজে গা ভাসিয়ে দেয়।
তারপর শরীর এবং মন ভর্তি অসুখ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। একসময় সে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তার ভয়ংকর আসক্তির জন্য এবং জঘন্য সব স্মৃতিকে ভুলে থাকার জন্য নিজেকে অ্যালকোহলে, ড্রাগে বুঁদ করে রাখতে হয়। এদেরকে বাইরে থেকে দেখে অনেক আমোদে আছে, জীবনটা অনেক উপভোগ করছে মনে হলেও, রাতে ঘরে ফেরার পর যখন তারা একা হয়, তখন তাদের উপরে হঠাৎ করে নেমে আসে ভয়ংকর বিষণ্ণতা, অবসাদ এবং হতাশা। তাদের জীবনে আর বড় কোনো গন্তব্য নেই, বড় কোনো উদ্দেশ্য নেই। এই নষ্ট দুনিয়াটাই তাদের শেষ চাওয়া-পাওয়া।
আপনারা যদি পাশ্চাত্যের অমুসলিমদের মুসলিম হওয়ার ঘটনাগুলো পড়েন, দেখবেন তাদের ঘটনায় একটি ব্যাপার বার বার ঘুরে ফিরে আসেঃ তাদের অনেকেই দিনরাত ফুর্তি করত, ব্যভিচার, মদ ছিল তাদের জীবনে খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা। শনি-রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বারে গিয়ে সারারাত ড্রিঙ্ক করে মাতাল হয়ে আসত। তারপর যখন সোমবারে হুঁশ ফিরত, এক ভয়ংকর হতাশা, বিষণ্ণতায় ডুবে যেত। জীবনটা তাদের কাছে অসহ্য মনে হতো। নিজের কাছে নিজেকে একটা পশু মনে হতো। “জীবন কি এটাই? জীবনে কি এর চেয়ে বড় কিছু নেই? এভাবে নিজেকে শেষ করে দিয়ে কী লাভ?”— এই ধরনের প্রশ্ন তাদেরকে পাগলের মতো তাড়িয়ে বেড়াত। তাদের জীবনে কোনো সুখ ছিল না, ছিল কিছু ক্ষণস্থায়ী ফুর্তি। হতাশা, বিষণ্ণতা, অশান্তি এবং নিজেকে শেষ করে দেওয়ার একটা অসহ্য ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখার জন্য তাদেরকে দিনরাত নিজের সাথে সংগ্রাম করতে হতো, নিজেকে মদে বুঁদ করে রাখতে হতো।
আল্লাহ ﷻ আমাদেরকে এর ঠিক উল্টোটা করতে বলেছেন। তিনি আমাদেরকে যে জীবন-বিধান দিয়ে দিয়েছেন, সেভাবে জীবন পার করলে এই দুনিয়াতেই আমরা হাসিখুশি থাকতে পারব, নিজের জীবনে, পরিবারে, সমাজে, দেশে শান্তি নিয়ে আসতে পারব। একই সাথে মৃত্যুর পরে অনন্তকাল পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনাবিল, অফুরন্ত শান্তিতে জান্নাত উপভোগ করতে পারব। তিনি আমাদেরকে বলেননি এই দুনিয়াতে নিজেদের উপরে ইচ্ছা করে কষ্ট দিতে। বরং তিনি পৃথিবীতে অসংখ্য হালাল আনন্দের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং সেগুলো উপভোগ করার নির্দেশ কু’রআনেই দিয়েছেন—
https://www.facebook.com/NAKBangla/posts/1496173413970613
"আল্লাহ তোমাদেরকে এই জীবনে যা দিয়েছেন, তা ব্যবহার করে এর পরের জীবনকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা কর, কিন্তু সেই সাথে এই দুনিয়াতে তোমার যে প্রাপ্য রয়েছে, সেটা ভুলে যেও না। অন্যের সাথে ভালো কাজ কর, যেভাবে আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে দুর্নীতি ছড়ানোর চেষ্টা করবে না। দুর্নীতিবাজদের আল্লাহ পছন্দ করেন না!" [আল-কাসাস ২৮:৭৭]
বল, “কে তোমাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্য এবং ভালো-পবিত্র খাবার উপভোগ করতে মানা করেছে, যা তিনি তার বান্দাদের জন্যই তৈরি করেছেন?” বলে দাও, “এগুলো তাদেরই জন্য যারা এই দুনিয়াতে বিশ্বাস করে: কিয়ামতের দিন এগুলো শুধুমাত্র তাদেরই হবে।” এভাবেই আমি আমার বাণীকে পরিষ্কার করে দেই বুদ্ধিমান লোকদের জন্য। [আল-আরাফ ৭:৩২]
ও প্রভু, আমাদেরকে এই দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দিন। আর আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেন। [আল-বাকারাহ ২:২০১]
উপরের আয়াতগুলো এবং বাকারাহ-এর আলোচ্য আয়াতের মূলকথা একটাই: জীবনকে উপভোগ করতে হবে আল্লাহর প্রতি অনুগত থেকে, কৃতজ্ঞ থেকে এবং পাপের ব্যাপারে সবসময় সাবধান থেকে। মনে রাখতে হবে, দুনিয়াতে আমরা যা কিছুই উপভোগ করব, কিয়ামতের দিন সেগুলোর সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। সুতরাং আমরা যেন উপভোগ করতে গিয়ে আল্লাহর ﷻ অবাধ্য না হই। এমন কিছু যেন করে না ফেলি, যেটা কিয়ামতের দিন আমাদেরকে দেখানো হলে আমরা লজ্জায় কিছু বলতে পারব না।
------------------------------------------------------------
(সোর্স এবং আরো বিস্তারিত দেখুন এখানে - উস্তাদ নুমান আলী খানের তাফসীরের প্রেরণায় বাংলা ভাষায় অসাধারণ এই সাইট থেকে - http://quranerkotha.com/baqarah-58/)
এই সাইট সম্পর্কে চমৎকার একটা রিভিউ পাবেন এখানে- http://tinyurl.com/obakf9y
মূল লিংক - https://www.facebook.com/NAKBangla/posts/1496173413970613
আমাদের অফিশিয়াল ফেইসবুক পেইজ - https://www.facebook.com/NAKBangla?ref=bookmarks
অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেল(বাংলা ডাবিং ও সাবটাইটেল) – http://www.youtube.com/user/NAKBangla/videos
আমাদের সকল বাংলা রিসোর্স আর্কাইভ - https://www.facebook.com/NAKBangla/notes
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন