একে একে নিভিছে দেউট:- মাহমুদুর রহমান মান্না
লিখেছেন লিখেছেন ইসলামের তলোয়ার ১৯ নভেম্বর, ২০১৪, ০৪:৪৪:১৫ বিকাল
আমি মাঝে মাঝে যে কয়জনের কলাম পড়ি তার মধ্যে মান্না সাহেব অন্যতম একজন। আজকে বাংলাদেশ প্রতিদিনে তার লিখা কলামটা যারা পড়তে পারেন নি, তাদের জন্য লিখাটা হুবাহু কপি পেষ্ট করে উৎসর্গ করলাম।
বোধহয় মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা এটি। সম্ভবত মেঘনাদবধ কাব্যে। ভুল হলে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু কবিতার এই পঙ্ক্তিটুকুই আজকের আমার লেখার শিরোনাম।
আমি এই লেখা লিখছি ১৪ নভেম্বর শুক্রবার। দুই দিন ধরে পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। পরশু বুধবার ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তার পরে আমরা দেখব।' এই বক্তব্য তিনি দিয়েছেন বিশেষ পরীক্ষার প্রার্থী নির্বাচন উপলক্ষে এবং এমন একসময়, যখন ছাত্রলীগ নিয়ে হাজারটা কথা উঠেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগ নিয়ে এতটাই অসহায় যে, তারা পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী সমীপে হাজির হবেন বলে খবর বেরিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও প্রায় একই। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ঢাকায় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি নিজস্বভাবে একটি প্রশাসন চালাচ্ছে। এরাই সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের মধ্যে ভর্তিচ্ছু ছাত্রদের পিটিয়েছে। দুই তরুণীকে তাদের মামার সামনে অপমান করেছে। সম্পর্কের দিক থেকে এই দুই তরুণীর পিতামহী এক সময় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তার কন্যা একটি নির্বাচন পর্যালোচনা সংগঠন পরিচালনা করেন। শহীদ মিনারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তরুণী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে এসে নিজেই একপ্রকার লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনও সেখানে এসে সরকারি ছাত্র সংগঠনের তথাকথিত নেতা-কর্মীদের অশ্লীল বাক্যবাণে জর্জরিত হয়েছেন। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ছি ছি করছে মানুষ। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় স্বয়ং ছাত্রদের এক সভায় বক্তা হিসেবে হাজির হয়েছেন। ছাত্রলীগের সঙ্গে এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতা এই প্রথম। সেখানে জয় বলেছেন, যারা সংগঠনের অভ্যন্তর থেকে এভাবে সংগঠনের বদনাম করছে তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিতে। কী নিদারুণ বৈপরীত্য! প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা(!) বলছেন, এই দুষ্টুদের পুলিশে ধরিয়ে দিতে। আর রাজনৈতিক উপদেষ্টা বলছেন, তিনি তাদের সরকারি কর্মকর্তা বানিয়ে দেবেন, যদি কোনো রকমে লিখিত পরীক্ষাটা ভালো করতে পারেন। তারা দুষ্ট না শিষ্ট এ প্রসঙ্গ তুলছেন না তিনি। সেটা কোনো ব্যাপার নয় তার কাছে।
এটাই কথা। কে এই এইচ টি ইমাম? সবাই জানেন, তিনি একজন দক্ষ আমলা, যিনি খন্দকার মোশতাকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। এ কথা এখন সবাই জানে। কিন্তু এই নিয়ে এইচ টি ইমাম কিংবা যিনি বা যারা তাকে উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক উপদেষ্টার পদে নির্বাচিত করেছেন তারা কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তিনি কি নিজের থেকে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন? মন থেকে? ইচ্ছার বিরুদ্ধে? এটা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো পথ কি তার ছিল না? বর্জন করতে পারতেন না এ রকম অনুষ্ঠান? এ ধরনের প্রশ্নের কোনো জবাব কোনো দিন কেউ-ই দেননি। নিশ্চয়ই জবাব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। করলে তো দিতেন। অথবা এগুলোকে কোনো প্রশ্নই মনে করেননি। মনে করেছেন, কে কী প্রশ্ন করল তাতে আমার কী আসে যায়। Let the dogs bark, the caravan will move. ৫ জানুয়ারির পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর এ রকম একটা অ্যাটিচুট আমরা লক্ষ্য করছি। কিন্তু সে কথায় পরে আসছি।
গত টার্মে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ছাত্রলীগের এই অত্যাচার শুরু হয়েছিল দেশব্যাপী। তখন পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়েছিল ছাত্রলীগকে সামলানোর জন্য। প্রধানমন্ত্রী সে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মনের দুঃখে ছাত্রলীগের সাংবিধানিক নেতৃত্বের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এটা নাটক ছিল বলে অনেকে তখন বলেছিলেন। ছাত্রলীগকে ভয় দেখানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী এটা করেছিলেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ভয় পায়নি। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি, কোপাকুপি চলেছে লাগাতার। বিশ্বজিতের মতো এক নিরীহ ছেলেকেও কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা। প্রধানমন্ত্রী কিছুই করতে পারেননি। এখন কি তার ছেলে সেই পরিত্যক্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন? ছাত্রলীগের সঙ্গে এই সভা থেকে অনেকে সে রকম মনে করতে চাইছেন। কিন্তু তাই বা কী করে বলি। ছাত্রলীগের মধ্য থেকে যারা এ ধরনের সন্ত্রাসী অপরাধমূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আবার সজীব ওয়াজেদ জয় তো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদেরই বলছেন। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ধরিয়ে দেওয়ার এক কুৎসিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে না? এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশের কাছে। পুলিশ কী করবে? কাকে বিশ্বাস করবে? পুলিশ কি ছাত্রলীগকে চেনে? নাকি এই পাঁচ বছরে সমগ্র পুলিশ বাহিনীর ছাত্রলীগীকরণ হয়ে গেছে।
আসলে উদ্ভট এক উটের পিঠে চলছে স্বদেশ। এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা। আপাদমস্তক একজন অরাজনৈতিক ক্যারিয়ারিস্ট আমলা। টিএসসির ওই বক্তৃতায় তিনি আরও যা বলেছেন তা আওয়ামী লীগ তথা সরকারের নাক কেটে ফেলেছে। তিনি বলেছেন, 'নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রশাসনের যে ভূমিকা, নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের নিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।'
কাউকে বলে দেওয়ার দরকার লাগে না, কতখানি অর্বাচীনের মতো, সরকারের জন্য বিপজ্জনক একটি অরাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়েছেন এই রাজনৈতিক উপদেষ্টা। খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ভেতর ও বাইরে এ নিয়ে তোলপাড় চলছে। তার বক্তব্যে দলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
সেটা তাদের হওয়ারই কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পুরো সরকার জান দিয়ে দিচ্ছেন ৫ জানুয়ারির প্রহসনকে নির্বাচন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। হিল্লি-দিল্লি ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা। বিশ্বের কোন কোন নেতা কী কী বলেছেন বা বলেননি, কোন অখ্যাত নির্বাচনে তাদের নেতারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জিতেছেন এসব কথা বলে মানুষকে জিতে নেওয়ার অথবা কাবু করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচন কমিশন তো আগেই সত্যের কষ্টিপাথরে ধরা পড়ে গেছে। যখন ৫ শতাংশ ভোটকে তারা ৪০ শতাংশ দেখিয়েছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে সরাসরি ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং করার অভিযোগ তোলা মুশকিল হচ্ছিল। এইচ টি ইমাম সে কাজটি তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এখন সহজ করে দিয়েছেন। এক সময়ের বামপন্থি নেতা বর্তমানে জোটের শরিক, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সরকারকে সমর্থন বা সমালোচনার ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর মতো খুল্লাম খুল্লা নন। তিনি বলেছেন, নির্বাচন সম্পর্কে তার যে বক্তব্য, সে অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। নির্বাচনের সময় যে আক্রমণ হয়েছে, তা দমনের বিষয়টি প্রশাসনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটা অতিরিক্ত কিছু নয়।
নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, নির্বাচন পরিচালনা করেছে নির্বাচন কমিশন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের আওতায় কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে তার (এইচ টি ইমাম) সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করিনি।
বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এইচ টি ইমাম মূর্খের মতো হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রহসনের যে বিড়ালকে আওয়ামী লীগ উপুড় করা হাঁড়ি ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছিল তা ভেঙে গেছে। বেচারা প্রহসনের বিড়াল কুৎ কুৎ করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ধরা পড়ে গেছে যে এখন! ধরে ফেলবে নাকি তাকে সবাই মিলে? তাই দেখে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বিব্রত। নিজেদের রক্ষা করার জন্য বলছেন, তিনি দল ও সরকারের ক্ষতি করেছেন এবং ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছেন। সরকার আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে বলেই তিনি এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার সাহস পেয়েছেন বলে তাদের ধারণা।
এই সিনিয়র নেতারা কারা তা পত্রিকায় লেখেনি। তবে সবাই জানেন, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ কিংবা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চেয়ে এইচ টি ইমামের দলগত অবস্থা শক্ত। হতে পারে মনের কষ্ট থেকে বলেছেন তারা। একটা সত্য কথা অবশ্য বলেছেন যে, সরকার আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। এ কথারই আরেক পিঠ হচ্ছে আমলারাও এই সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। কারণ, আমলারা এমন কিছু কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন যে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তাদের ডকে উঠতে হবে। আর আমলাদের ওপর নির্ভর করে তো সরকার চলতে পারে না। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য যে মনে করেন, জনসমর্থন না থাকলে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না, তাও সত্যি।
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার মতে, লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের চেয়েও এইচ টি ইমামের বক্তব্য ভয়ঙ্কর। তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন। এই তারা যে কারা তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু তারা যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তা বলতে হবে। আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, এসব ঘটনা তার প্রমাণ। এইচ টি ইমামের বক্তব্য প্রসঙ্গে আমি উট সম্পর্কিত কবিতার লাইনটি উল্লেখ করেছিলাম। সেই যে কবিতার লাইনের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছি।
'উদ্ভট এক উটের পিঠে...।' লতিফ সিদ্দিকী কি এ রকম একজন উদ্ভট মানুষ। আমি কিছু বলব না। ব্যক্তিগত সমালোচনা আমি এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। তার পরও কেউ যদি জালে আটকা পড়েন আমার করার কিছু থাকে না।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মাঝেমধ্যে সম্ভবত নিজের অজান্তে সত্য কথা বলে ফেলেন। দেশজুড়ে যে ভয়াবহ দুর্নীতি চলছে তা তিনি তার বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে বলেছেন। সে দুর্নীতির সামনে তিনি ও তার সরকার অসহায়, সেটাও স্বীকার করেছেন। আর সর্বশেষ দুর্নীতিকে তিনি বর্ণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এই বলে যে, ঘুষকে নাকি দুর্নীতি বলা চলে না। এসব অর্থ ব্যবসাকে মসৃণ করে। হা হা হা।
বেচারা মুহিত ভাই। ভালো মানুষ। কিন্তু বয়স হয়েছে তো। এইচ টি ইমামেরও বয়স হয়েছে। লতিফ সিদ্দিকীর বয়সও কম নয়; একটা করে উইকেট পড়ে যাওয়ার অবস্থা। এইচ টি ইমামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এর আগে মুহিত সম্পর্কেও এ রকম কথা এসেছিল। এ জন্যই লেখাটার শিরোনাম করেছি, 'একে একে নিভিছে দেউটি।'
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল :
- See more at: http://www.bd-pratidin.com/editorial/2014/11/19/44448#sthash.yDPSH0M7.dpuf
বিষয়: বিবিধ
১২০১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন