কুরআন ও সুন্নার আলোকে কথাবলার শিষ্টাচার: (বাক_বাগ্মীতা ও কথাবলার শিষ্টাচার-৫)

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০২ মার্চ, ২০২০, ০২:৩২:৪০ রাত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

১. সুন্দর ও উত্তম পদ্ধতিতে কথাবলা: মুসলমানদের প্রতিটি কথা হবে উদ্দেশ্যমূলক এবং সুন্দর। তাই মানুষের সাথে কথা বলতে সুন্দর শব্দমালায় ও উত্তম পদ্ধতিতে। কথা হবে সৌন্দর্যমণ্ডিত আর তা হলো-যখন মানুষের সাথে কথা বলবে, নম্রভাবে হাসিমুখে ও খোলামনে বলবে। যেমন আল্লাহ বলেন- "এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে।" (সূরা ২ বাকারা:৮৩)1

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো; যদিও খেজুরের এক টুকরো সাদাকাহ করে হয়। আর যে ব্যক্তি এরও সামর্থ্য রাখে না, সে যেন ভাল কথা বলে। (বুখারী:৬১৯৫, মুসলিম:১০১৬)2

২. শালীন ভাষায় কথা বলা: কথা বলতে হবে উত্তম শব্দ চয়নে ও শালীন ভাষায়। এটাই উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার পরিচায়ক। মুসলমান কখনো অশ্লীলভাষী হতে পারে না। কথা-বার্তায় খারাপ বা বাজে শব্দ প্রয়োগ করা যাবে না। ইসলামে গাল-মন্দ, বাজে সম্ভোধন, পরচর্যা, অনর্থক কথা ইত্যাদি যাবতীয় খারাপ ভাষা নিষিদ্ধ।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্লীল ভাষী ও অসদাচরণের অধিকারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম। (বুখারী, মুসলিম:২৩২১)3

৩. সঙ্গত কথা বলা ও বেহুদা কথা বর্জনীয়: একজন মুসলিম এমন কথা বলতে পারে না যাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো উপকার নেই। একজন প্রকৃত মুমিন কখনো অনর্থক, ফালতু বা আজেবাজে কথা বলে না।

ঈমানদারদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন-

'হে বিশ্বাসীগণ ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো'। (সূরা ৩৩ আহযাব:৭০)

আলোচ্য আয়াতে ( قَوْلًا سَدِيدًا) "সঙ্গত কথা" -এর তাফসীর করা হয়েছে, সত্য কথা, সরল কথা, সঠিক কথা। (তাফসীরে ইবনে কাসীর) এমন কথা যা সঠিকতা ও সত্যতা থেকে এক চুল বরাবর যেন বিচ্যুত না হয়। সূরা নিসাতেও অনুরূপ শব্দ এসেছে।4

সূরা মুমিনূনে সফলকাম মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন-

"আর যারা আসার/অনর্থক কর্মকাণ্ড থেকে থাকে বিমুখ"। (সূরা ২৩ মুমিনুন:৩)5

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তোমাদের তিনটি কাজ অপছন্দ করেন- (১) অনর্থক কথাবার্তা, (২) সম্পদ নষ্ট করা এবং (৩) অত্যধিক সওয়াল করা। (বুখারী:৮৪৪)6

৪. অধীনস্থ ও অসহায়দের সাথে "সঙ্গত ও ন্যায্য" কথা বলা: অধীনন্থ তথা আপন পরিবার-স্ত্রী, সন্তান, চাকর-বাকর, শিক্ষার্থী, কর্মচারী আর অসহায় বলতে অল্পবয়স্ক, এতীম, দরীদ্র, নিঃস্ব, গরীবশ্রেণী। এদের সাথে কথা বলতে হবে নরম ভাষায়, সহজ.সরল ও হাসিমুখে। তাদেরকে যথা সম্ভব ধমক দেয়া, কর্কশ শব্দে কথা বলা এবং রাগ করা থেকে বিরত থাকা পরিপূর্ণ ঈমানের পরিচয়।

কুরআনে এই শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলতে বলা হয়েছে-

"আর তোমরা তাদের সাথে সদালাপ করো"। (দ্রষ্টব্য: সূরা ৪ আন নিসা: ৫,৮) এখানে قَوْلًا مَعْرُوفًا হলো এমন কথা বলা যাতে কেউ কষ্ট না পায়, মিষ্টি করে কথা বলা। এর আরেকটি অর্থ হতে পারে "বোধগম্য ভাষায় তথা সহজ সরলভাবে কথা বলা।7

সাহায্যপ্রার্থীদের সাথেও নরম ভাষায় আন্তরিকতার সাথে কথা বলতে হবে। যদি সাহায্য করতে না পারে তবে নম্রভাবে বিদায় করতে হবে। আল্লাহ বলেন- "তুমি নিজেই যখন তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে কোন প্রত্যাশিত করুণা লাভের সন্ধানে থাকো, তখন তাদেরকে যদি বিমুখই কর, তাহলে তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো"। ( সূরা ১৭ ইসরা: ২৮)

আনাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দশ বছর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খিদমত করেছি। আল্লাহর শপথ তিনি কখনো আমাকে 'উহ' শব্দও বলেননি এবং কোন সময় আমাকে ‘এটা কেন করলে’, ‘ওটা কেন করনি তাও বলেননি। (সহীহ মুসলিম, ফাযায়েল অধ্যায়, হা:২৩০৯)

অধীনস্থদের সাথে কথায় ও আচরণে কোমল ও নরম হতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: আল্লাহ তাআলা কোমল, তিনি প্রতিটি ব্যাপারে কোমল ও নম্রতাকে পছন্দ করেন। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীন: ৬৩৮)8

৫. পিতা-মাতা ও মুরুব্বীদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলা:

পিতা-মাতাবর্গ তথা পিতৃস্থানীয়, বয়সে বড়, আলেম-ওলামা, তথা মুরুব্বী শ্রেণিদের সাথে সম্মানের সাথে কথা বলতে হবে। তাদের সাথে কটু কথা বলা যাবে না, ধমকের স্বরে কথা বলা যাবে না, কথা বলতে হবে নম্রতায় ও বিনয়ের সাথে।

"তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের এক জন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে (বিরক্তিসূচক শব্দ) ‘উঃ’ বলো না এবং তাদেরকে ভৎর্সনা করো না; বরং তাদের সাথে বলো সম্মানসূচক নম্র কথা। ( সূরা ১৭ ইসরা:২৩)9

৬. বিধর্মী ও শত্রুদের সাথে বাকপটু ও হৃদয়স্পর্শী কথা বলা:

আল্লাহ তা'আলা তার বান্দাহদের শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে অবিশ্বাসী, মুনাফিক, ভিন্নমতালম্বী ও শত্রু শ্রেণীদের সাথে কথা বলতে হবে। আল্লাহ বলেন-

এরাই তো তারা, যাদের অন্তরে কী আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদেরকে উপেক্ষা করো, তাদেরকে সদুপদেশ দাও এবং তাদেরকে তাদের সম্বন্ধে মর্মস্পর্শী কথা বলো।( সূরা ৪ নিসা:৬৩)

বিধর্মী-অবিশ্বাসী, কিংবা ভিন্নমতাদর্শীদের কটু কিংবা গর্হিত কথায় বিতর্ক না করে তাদেরকে যথাসম্ভব ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে, উত্তম উপদেশ দিতে হবে এবং তাদের সাথে অলঙ্কারপূর্ণ, বিগলিত কন্ঠে, মর্মস্পর্শী সুন্দর কথায় আলাপ করতে হবে যাতে তারা সত্যের পথে আকৃষ্ট হয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে ধাবিত হতে পারে। এ থেকে জানা যায় যে, উপেক্ষা, ক্ষমা, ওয়ায-নসীহত এবং হৃদয়স্পর্শী উত্তম কথা দ্বারা শত্রুদের ষড়যন্ত্রসমূহকে ব্যর্থ করার প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত।

আল্লাহ তা'আলা মূসা ও হারূন আ.কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

তোমরা দু’জন ফিরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে, অথবা ভয় করবে। (সূরা ২০ ত্বহা:৪৩-৪৪)

এ আয়াতে দাওয়াত প্ৰদানকারীদের জন্য বিরাট শিক্ষা রয়েছে। সেটা হচ্ছে, ফিরআউন হচ্ছে সবচেয়ে বড় দাম্ভিক ও অহংকারী, আর মূসা হচ্ছেন আল্লাহর পছন্দনীয় লোকদের অন্যতম। তারপরও ফিরআউনকে নরম ভাষায় সম্বোধন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (তাফসীরে ইবন কাসীর)

প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস ও চিন্তাধারার বাহক হোক না কেন, তার সাথেও সংস্কার ও পথ প্রদর্শনের কর্তব্য পালনকারীদের হিতাকাংখার ভঙ্গিতে নরম কথাবার্তা বলতে হবে। এরই ফলশ্রুতিতে সে কিছু চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হতে পারে এবং তার অন্তরে ইসলাম বা সঠিক মতাদর্শের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে।

মূসা আলাইহিস সালাম কিভাবে সে নরম পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন সেটার বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেছিলেন, “আপনার কি আগ্রহ আছে যে, আপনি পবিত্র হবেন— ‘আর আমি আপনাকে আপনার রবের দিকে পথপ্রদর্শন করি যাতে আপনি তাঁকে ভয় করেন?” (সূরা ৭৯ আন-নাযিআত: ১৮–১৯)

৭. দাওয়াত ও বিতর্ক করতে হবে উত্তমপন্থায়:

মানুষকে সত্যের পথে ডাকতে হবে প্রাজ্ঞতা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে, চমৎকৃত ভাষায়, আকর্ষণীয় শব্দমালায় ও নম্রতার সাথে। যেমনি আল্লাহ মূসা আ.কে শিখিয়েছেন (قَوْلًا لَيِّنًا) নরম কথায় ফিরআউনকে দাওয়াত দিতে। (দ্রষ্টব্য, সূরা ত্বহা:৪৪)

আল্লাহ বলেন-

আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়... (সূরা ১৬ নাহল:১২৫)10

এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝতে পারি, দাওয়াত হবে সুন্দর উপদেশ ও প্রাজ্ঞতার সাথে। আর যদি দাওয়াতের কাজে কোথাও তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে তর্ক-বিতর্কও উত্তম পন্থায় হওয়া দরকার। উত্তম পন্থার মানে এই যে, কথাবার্তায় নম্রতা ও কমনীয়তা অবলম্বন করতে হবে। (তাফসীরে ইবন কাসীর)

অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন-

ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। উৎকৃষ্ট দ্বারা মন্দ প্রতিহত করো; তাহলে যাদের সাথে তোমার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। (সূরা ৪১ হা-মীম-সাজদাহ:৩৫)

"আর তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া কিতাবীদের সাথে বিতর্ক করবে না" (সূরা ২৯ আনকাবূত: ৪৬)

বিতর্কের পদ্ধতি হবে, কঠোর কথাবার্তার জওয়াব নম্র ভাষায়, ক্রোধের জওয়াব সহনশীলতার সাথে এবং মুর্খতাসূলভ হট্টগোলের জওয়াব গাম্ভীর্যপূর্ণ কথাবার্তার মাধ্যমে দাও। বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা উপযুক্ত যুক্তি-প্রমাণ সহকারে, ভদ্র ও শালীন ভাষায় এবং বুঝবার ও বুঝাবার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে করতে হবে। (ফাতহুল কাদীর)

৮. মূর্খদের এড়িয়ে চলা:

যখন কোনো মুর্খ, অজ্ঞ কিংবা বিতর্কপ্রিয় লোক অযথা তর্ক করতে চায়, সঠিক কথা বুঝতে চায় না কিংবা যাদের কাছে সত্য, বস্তুনিষ্ঠ ও দলিলের চেয়ে যুক্তি বড়, তাদেরকে এড়িয়ে যেতে হবে। তাদের সাথে অযথা তর্ক করা যাবে না, কারণ তাদের সাথে তর্ক করলে ওরা জ্ঞানীদের ওদের সমতূল্য মনে করবে।

আল্লাহ বলেন-

তারাই পরম দয়াময়ের দাস, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’। (সূরা ২৫ ফুরকান:৬৩)

সালাম’ বলার অর্থ মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ও তর্ক-বিতর্ক ছেড়ে দেওয়া। অর্থাৎ, ঈমানদাররা জাহেল ও মুর্খ লোকদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে না। বরং তারা এমতাবস্থায় এড়িয়ে চলার পদ্ধতি অবলম্বন করে এবং ফালতু বিতন্ডা বর্জন করে।

মুর্থ মানে অশিক্ষিত বা লেখাপড়া না জানা লোক নয় বরং এমন লোক যারা অজ্ঞতার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবার উদ্যোগ নিয়েছে এবং কোন ভদ্রলোকের সাথে অশালীন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। রহমানের বান্দাদের পদ্ধতি হচ্ছে, তারা গালির জবাবে গালি এবং দোষারোপের জবাবে দোষারোপ করে না। (দেখুন-ফাতহুল কাদীর,তাফসীরে কুরতুবী)। যেমন কুরআনের অন্য জায়গায় বলা হয়েছেঃ “আর যখন তারা কোন বেহুদা কথা শোনে, তা উপেক্ষা করে যায়। বলে, আমাদের কাজের ফল আমরা পাবো এবং তোমাদের কাজের ফল তোমরা পাবে। সালাম তোমাদের, আমরা জাহেলদের সাথে কথা বলি না।” (সূরা আল-কাসাস: ৫৫)

অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন -

তুমি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করো, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খদেরকে এড়িয়ে চলো। ( সূরা ৮ আরাফ:১৯৯)1

টিকা:

1. 'আর (স্মরণ কর সেই সময়ের কথা) যখন বনী ইস্রাইলের কাছ থেকে আমি অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্রের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে, নামাযকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং যাকাত প্রদান করবে। তারপর তোমাদের মধ্য হতে কিছুসংখ্যক লোক ছাড়া তোমরা সকলেই অবজ্ঞা করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। (সূরা বাকারা ২:৮৩)

আয়াতে এমন কথাকে বুঝানো হয়েছে, যা সৌন্দর্যমণ্ডিত। এর অর্থ এই যে, যখন মানুষের সাথে কথা বলবে, নম্রভাবে হাসিমুখে ও খোলামনে বলবে। তবে দ্বীনের ব্যাপারে শৈথিল্য অথবা কারো মনোরঞ্জনের জন্য সত্য গোপন করবে না। সবার সাথে সুন্দরভাবে কথা বলা উচিত। হাদীসে এসেছে, “তোমরা সৎকাজের সামান্যতম কিছুকে খাটো করে দেখ না। যদিও তা হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করা।” [মুসলিম: ২৬২৬] অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন-

"আর আমার বান্দাদেরকে বলুন, তারা যেন এমন কথা বলে যা উত্তম। নিশ্চয়ই শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়; নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্ৰকাশ্য শত্ৰু। (সূরা ১৭ ইসরা:৫৩)

2. আদী ইবনু হাতিম (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নামের শাস্তির কথা উল্লেখ করে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং চরম অস্বস্তির ভাব প্রকাশ করলেন- “তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর"। তিনি পুনরায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন ও এমন ভাব প্রকাশ করলেন যাতে আমাদের মনে হচ্ছিল যে, তিনি তা দেখেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর যদি তা এক টুকরা খেজুরের বিনিময়েও হয়। আর যার এ সামর্থ্যটুকু নেই সে যেন ভাল কথার মাধ্যমে তা করে।” (সহীহ মুসলিম, যাকাত অধ্যায়, হা: ১০১৬, একটু ভিন্ন শব্দে সহীহ বুখারীতে রিক্বাক অধ্যায়, হা:৬১৯৫)

3. আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্লীল ভাষী ও অসদাচরণের অধিকারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে নৈতিকতায় সর্বোত্তম।(সহীহ বুখারী, কিতাবুল আদাব, হা: ৫৬৮২, মুসলিম: ২৩২১)

আল্লাহ বলেন-

'প্রকাশ্যে হোক কিংবা গোপনে হোক, অশ্লীল আচরণের নিকটবর্তীও হয়ো না ' ( সূরা ৬ আন'আম:১৫১)

অপর আয়াতে- "বলুন, নিশ্চয়ই আমার রব হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা"। (সূরা ৭ আরাফ: ৩৩)

আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নিষিদ্ধ কার্যে মু’মিনদেরকে বাধা দানকারী আল্লাহর চেয়ে অধিক কেউ নেই, এজন্যই প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যাবতীয় অশ্লীলতা নিষিদ্ধ করেছেন, আল্লাহর প্রশংসা প্রকাশ করার চেয়ে প্রিয় তাঁর কাছে অন্য কিছু নেই, সেজন্যেই আল্লাহ আপন প্রশংসা নিজেই করেছেন। (বুখারী, তাফসীর অধ্যায়, হা: ৪৬৩৪; মুসলিম: ২৭৬০)

অপর আয়াতে এসেছে-

হে ঈমানদারগণ! কোন মুমিন সম্প্রদায় যেন অপর কোন মুমিন সম্প্রদায়কে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা উপহাসকারীদের চেয়ে উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অন্য নারীদেরকে উপহাস না করে; কেননা যাদেরকে উপহাস করা হচ্ছে তারা তারা উপহাসকারিণীদের চেয়ে উত্তম পারে। আর তোমরা একে অন্যের প্ৰতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নাম অতি নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না তারাই তো যালিম৷ (সূরা ৪৯ হুজুরাত:১১)

4. আর তারা যেন ভয় করে যে, অসহায় সন্তান পিছনে ছেড়ে গেলে তারাও তাদের সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হত। কাজেই তারা যেন আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে এবং সঙ্গত কথা বলে। (সূরা ৪ নিসা:৯)

5. পূর্ণ মুমিনের এটি দ্বিতীয় গুণঃ অনর্থক বিষয়াদি থেকে বিরত থাকা। لغو এর অর্থ অসার ও অনর্থক কথা বা কাজ। এর মানে এমন প্রত্যেকটি কথা ও কাজ যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও যাতে কোন ফল লাভও হয় না। শির্কও এর অন্তর্ভুক্ত, গোনাহের কাজও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হতে পারে [দ্রষ্টব্য: তাফসীরে ইবন কাসীর, সূরা মুমিনুন:৩] অনরূপভাবে গান-বাজনাও এর আওতায় পড়ে [কুরতুবী] অপর আয়াতে আল্লাহমুখী বান্দাহদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে- "আর যারা মিথ্যার সাক্ষ্য হয় না এবং অসার কার্যকলাপের সম্মুখীন হলে আপন মর্যাদা রক্ষার্থে তা পরিহার করে চলে"। ( সূরা ২৫ ফুরক্বান:৭২)

6. হাদীসটি বিভিন্ন সনদে ও বিভিন্ন শব্দে কখনো সংক্ষেপে কখনো বিশদাকারে এসেছে বুখারী-মুসলিম সহ হাদীসের অনেক গ্রন্থে। যেমন-

মুগীরাহ ইবনু শু‘বাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর হারাম করেছেন মায়ের নাফরমানী, কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া, কারো প্রাপ্য না দেয়া এবং অন্যায়ভাবে কিছু নেয়া আর অপছন্দ করেছেন অনর্থক বাক্য ব্যয়, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা, আর মাল বিনষ্ট করা। (বুখারী, আদাব অধ্যায়, হা: ৫৬৩০, সহীহ মুসলিম: ৫৯৩)

7. আল্লাহ বলেন- আর সম্পত্তি বণ্টনকালে আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন এবং অভাবগ্রস্ত লোক উপস্থিত থাকলে, তাদেরকে তা হতে কিছু দান কর এবং তাদের সাথে সদালাপ করো। (সূরা ৪ নিসা:৮) এই আয়াতে বুঝা যাচ্ছে সাহায্যপ্রার্থীদের সাথেও ভালো কথা বলতে হবে। কখনো সাহায্য করতে না পারলে তাদেরকে নরমভাবে বলতে হবে আর তাদের জন্য ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্য্যের প্রার্থনা করতে হবে। (তাফসীরে তাবারী)

(قَوْلًا مَعْرُوفًا) "সদালাপ" শব্দটি কুরআনে ৪ জায়গায় এসেছে। (সূরা ২ বাকারা:২৩৫, নিসা:৫/৮, আহযাব:৩২)

8.আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এক বেদুঈন মসজিদের ভিতরে প্রস্রাব করে দিল। সুতরাং লোকেরা তাকে ধমক দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘ওকে ছেড়ে দাও এবং প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কেননা তোমাদেরকে সহজ নীতি অবলম্বন করার জন্য পাঠানো হয়েছে, কঠোর নীতি অবলম্বন করার জন্য পাঠানো হয়নি।’’ (বুখারী, রিয়াদুস সালেহীন: ৬৪১) অপর হাদীসে এসেছে-

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, ‘আপনি আমাকে কিছু অসিয়ত করুন!’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি রাগান্বিত হয়ো না।’’ সে ব্যক্তি এ কথাটি কয়েকবার বলল। তিনি (প্রত্যেক বারেই একই কথা) বললেন, ‘‘তুমি রাগান্বিত হয়ো না।’’ (বুখারী, রিয়াদুস সালেহীন:৬৪৪)

9. এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পর দ্বিতীয় নম্বরে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে পিতা-মাতার আনুগত্য ও তাঁদের খেদমত করার এবং তাঁদের প্রতি আদব ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার কত যে গুরুত্ব তা পরিষ্কার হয়ে যায়। বিশেষ করে বার্ধক্যে তাঁদের কোনো কথা বা কাজে বিরক্তি হয়ে ‘উঃ’ শব্দটিও বলতে এবং তাঁদেরকে ধমক দিতে নিষেধ করেছেন। কেননা, বার্ধক্যে তাঁরা দুর্বল ও অসহায় হয়ে যান। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিজের মাতা-পিতাকে গালি দেয়া কাবীরাহ্ গুনাহসমূহের মধ্যে অন্যতম। সহাবায়ি কিরাম জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! মানুষ কি তার পিতা-মাতাকে গালি দেয়? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, সে কোন ব্যক্তির বাবা ও মাকে গালি দিল, সেই ব্যক্তিও তার বাবা ও মাকে গালি দিল। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত: ৪৯১৬)

আমর ইবনু শুআইব (রাহঃ) হতে পর্যায়ক্রমে তার বাবা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি (দাদা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক আমাদের শিশুদের আদর করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (তিরিমিযী: ১৯২০)

10. ‘হেকমত’ শব্দটি কুরআনুল কারীমে অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এস্থলে কোন কোন মুফাসসির হেকমতের অর্থ নিয়েছেন কুরআন, কেউ কেউ বলেছেন, কুরআন ও সুন্নাহ। [তাবারী] আবার কেউ কেউ অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ স্থির করেছেন। [ফাতহুল কাদীর] আবার কোন কোন মুফাসসিরের মতে বিশুদ্ধ ও মজবুত সহীহ কথাকে হেকমত বলা হয়। [ফাতহুল কাদীর]

অন্য আয়াতে আছে- (وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ) -অর্থাৎ কথা-বার্তার দিক দিয়ে সে ব্যক্তির চাইতে উত্তম কে হবে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়? [ফুসসিলাতঃ ৩৩]

(- وعظ – موعظة) এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোন শুভেচ্ছামূলক কথা এমনভাবে বলা, যাতে প্রতিপক্ষের মন তা কবুল করার জন্য নরম হয়ে যায় [ফাতহুল কাদীর] উদাহরণতঃ তার কাছে কবুল করার সওয়াব ও উপকারিতা এবং কবুল না করার শাস্তি ও অপকারিতা বর্ণনা কর। [ইবন কাসীর] الْحَسَنَةِ এর অর্থ বর্ণনা ও শিরোনাম এমন হওয়া যে, প্রতিপক্ষের অন্তর নিশ্চিত হয়ে যায়, সন্দেহ দূর হয়ে যায় এবং অনুভব করে যে, এতে আপনার কোন স্বার্থ নেই- শুধু তার শুভেচ্ছার খাতিরে বলেছেন। موعظة শব্দ দ্বারা শুভেচ্ছামূলক কথা কার্যকর ভঙ্গিতে বলার বিষয়টি ফুটে উঠেছিল। কিন্তু শুভেচ্ছামূলক কথা মাঝে মাঝে মর্মবিদারক ভঙ্গিতে কিংবা এমনভাবে বলা হয় যে, প্রতিপক্ষ অপমান বোধ করে। এ পস্থা পরিত্যাগ করার জন্য حسنة শব্দটি সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ দাওয়াত দেবার সময় দুটি জিনিসের প্রতি নজর রাখতে হবে। এক, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা এবং দুই, সদুপদেশ। এ দুটিই মূলত: দাওয়াতের পদ্ধতি। কিন্তু কখনও কখনও দায়ী-র বিপক্ষকে যুক্তি-তর্কে নামাতে হয়। তাই কিভাবে সেটা করতে হবে তাও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। [ফাতহুল কাদীর]

অন্য আয়াতে আছে- (وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ) -অর্থাৎ কথা-বার্তার দিক দিয়ে সে ব্যক্তির চাইতে উত্তম কে হবে, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়? [ফুসসিলাতঃ ৩৩]

11. ইমাম বুখারী উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় উমার (রাঃ)-এর একটি ঘটনা তুলে ধরেছেন। আর তা হল এই যে, একদা উয়াইনাহ বিন হিসন্‌ উমার (রাঃ)-এর খিদমতে হাযির হন ও সমালোচনা করতে শুরু করেন যে, আপনি না আমাদের পূর্ণ প্রাপ্য দেন, আর না আমাদের মাঝে ইনসাফ করেন! যার কারণে উমার (রাঃ) রাগান্বিত হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতি দেখে উমারের পরামর্শদাতা হুর বিন কায়েস (রাঃ) (উয়াইনার ভাতিজা) বললেন, মহান আল্লাহ নিজ নবী (সাঃ)-কে আদেশ করেন, {خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ} অর্থাৎ, ‘ক্ষমা কর, সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং মূর্খদেরকে এড়িয়ে চল। আর ইনি একজন মূর্খ মানুষ। সুতরাং উমার (রাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। বলাই বাহুল্য যে, উমার (রাঃ) কুরআনের আদেশের সামনে আত্মসমর্পণকারী ছিলেন। (সহীহ বুখারীঃ সূরা আ’রাফের তাফসীর)

সংকলন ও সম্পাদনায়: সামসুল আলম

বিষয়: বিবিধ

৬৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File