বন্ধন: পারিবারিক এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তির মূলমন্ত্র
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০৫ মে, ২০১৯, ০৫:২২:৪৬ সকাল
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে একটা সুদৃঢ় বন্ধনের সুঁতোতে আবদ্ধ করেছেন। পারিবারিক বন্ধন, আত্মীয়তার বন্ধন, সামাজিক বন্ধন, রাষ্ট্রীয় বন্ধন এবং সর্বোপরি মানবিক বন্ধন। আর আমাদের পৃথিবীতে বাস করতে হয় প্রতিটি বন্ধনকে আঁকড়ে ধরে, যদি এর বন্ধনগুলো ছুটে যায় তাহলে জীবনে, পরিবারে, সমাজে নেমে আসে বিপর্যয়। আল্লাহ চান, আমরা যেন সম্পূর্ণরূপে মানবিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাস করি, কেননা এতে রয়েছে সুশৃঙ্খলতা আর শান্তি। বন্ধন ছিন্নতা হলো সবচেয়ে বড় গোনাহ বা অপরাধ। এতে পরিবারে বা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও শান্তি নষ্ট হয়।
আমরা প্রত্যেকে সৃষ্টিগতভাবে একই প্রাণের উৎস থেকে আগত। পরবর্তীতে মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে নানা বর্ণ, জাতি আর ভাষার তারতম্য ঘটেছে। কিন্তু মূলগতভাবে আমরা সবাই আদমেরই সন্তান এবং একই আত্মার আত্মীয়।
১.আত্মার আত্মীয়: বন্ধনের প্রথম স্তর হলো সৃষ্টিগত। সৃষ্টিগতভাবে আমরা সবাই আদমের সন্তান। সকল মানুষ তাই একই আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের প্রত্যকের মাঝে তাই মানবিকতার বন্ধনকে শক্ত করতে হবে। মানবিকতার প্রথম ধাপ হলো, মানুষকে তার স্রষ্টার পরিচয় তুলে ধরা এবং তার অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা।
আল্লাহ বলেন-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا ﴿١﴾
"হে মানবসম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একটি প্রাণ হতে সৃষ্টি করেছেন ও তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যিনি তাদের দু’জন থেকে বহু নরনারী (পৃথিবীতে) বিস্তার করেছেন। সেই আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচ্ঞা কর এবং জ্ঞাতি-বন্ধন ছিন্ন করাকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন। (সূরা ৪ নিসা: ১)
মানুষকে দাওয়াত দিতে হবে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে-
হে মানুষ সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের উপাসনা করো, যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা পরহেযগার (ধর্মভীরু) হতে পার। (২:২১)
প্রত্যেক নবী-রাসূল যা বলে দাওয়াত দিতেন-
"নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার প্রতিপালক ও তোমাদের প্রতিপালক, সুতরাং তোমরা তাঁর উপাসনা করো, এটাই হল সরল পথ। ( সূরা ১৯ মারইয়াম:৩৬)
২.বন্ধনের দ্বিতীয় স্তর বিশ্বাসগত:
মুমিন বা বিশ্বাসীরা পরস্পরে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আল্লাহ বলেন-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ﴿١٠﴾
সকল বিশ্বাসীরা তো পরস্পর ভাই ভাই, সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাই-এর মধ্যে সন্ধি স্থাপন কর এবং আল্লাহকে ভয় কর; যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও। ( সূরা ৪৯ হুজুরাত:১০)
৩.বন্ধনের তৃতীয় স্তর হলো সামাজিকতা: আমরা সমাজগতভাবে বসবাস করি। সুতরাং আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বন্ধনে থাকতে হবে। ইসলাম এটাকে জামাতবদ্ধতা/একতা বলে। ঐক্যবদ্ধতার মূলমন্ত্র হলো "শ্রবণ আর আনুগত্য"।
আনুগত্য ও সম্পর্ক রক্ষা: পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন রক্ষার জন্য দরকার নেতৃত্বের আনুগত্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক রাখা। এই জন্যই ইসলামে আনুগত্যের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
"হে বিশ্বাসিগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রসূল ও তোমাদের নেতৃবর্গ (ও উলামা)দের অনুগত হও। (সূরা নিসা: ৫৯)
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখার জন্যই নেতৃত্বের আনুগত্য ফরয করা হয়েছে, তবে ‘‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই।’’ (মুসলিম: ১৮৪০)
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতা করল। আর যে আমীরের (নেতার) আনুগত্য করল, সে আমারই আনুগত্য করল। যে আমীরের অবাধ্যতা করল, সে আমারই অবাধ্যতা করল। প্রকৃতপক্ষে ইমাম (নেতা) হলেন ঢাল স্বরূপ। তার পিছন থেকে যুদ্ধ করা হয়, তার দ্বারা (শত্রুদের কবল থেকে) নিরাপত্তা পাওয়া যায়। সুতরাং শাসক যদি আল্লাহর প্রতি ভয়প্রদর্শন পূর্বক প্রশাসন চালায় এবং ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে এর বিনিময়ে সে সাওয়াব (প্রতিদান) পাবে। কিন্তু সে যদি এর বিপরীত কর্ম সম্পাদন করে, তাহলে তার গুনাহও তার ওপর কার্যকর হবে। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত: ৩৬৬১)
ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক মুসলিমের (তার শাসনকর্তার নির্দেশ) শোনা এবং আনুগত্য করা অপরিহার্য; তার মনঃপূত হোক বা না হোক, যতক্ষণ না তাকে গুনাহের দিকে নির্দেশ করে। কিন্তু যদি তাকে গুনাহের কাজের নির্দেশ দেয়া হয়, তখন তা শোনা ও আনুগত্য করা কর্তব্য নয়। ( বুখারী: ৭১৪৪, মুসলিম: ১৮৩৯, মিশকাত: ৩৬৬৪)
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি যদি তার আমীরকে অনৈতিক কোনো কিছু করতে দেখে, তাহলে সে যেন ধৈর্যধারণ করে। কেননা যে কেউ ইসলামী জামা‘আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ দূরে সরে যায় এবং এ অবস্থায় মারা যায়, সে জাহিলিয়্যাত যুগের ন্যায় মৃত্যুবরণ করল। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত: ৩৬৬৮)
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমীরের (শাসকের) আনুগত্যের অবাধ্য হলো এবং মুসলিম জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, এমতাবস্থায় সে মারা গেলে তার মৃত্যু জাহিলিয়্যাত যুগের উপর হবে। আর যে ব্যক্তি এমন পতাকার নিচে যুদ্ধ করে যার হক বা বাতিল হওয়া সম্পর্কে অজানা; বরং সে যেন দলীয় ক্রোধের বশীভূত হয়ে অথবা দলীয় স্বার্থ রক্ষায় লোকেদেরকে আহবান করে কিংবা দলীয় প্রেরণায় মদদ জোগায়। এমতাবস্থায় সে মারা গেলে জাহিলিয়্যাতের উপরই মৃত্যুবরণ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মাতের বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করল এবং ভালো-মন্দ সকলকে নির্বিচারে আক্রমণ করতে লাগল। এমনকি তাত্থেকে আমার উম্মাতের কোনো মু’মিনেরও পরোয়া করল না এবং আশ্রিত তথা নিরাপত্তায় অধিকারী ব্যক্তির সাথে যে অঙ্গীকার রয়েছে, তার চুক্তিও পূরণ করল না, সে আমার উম্মাতের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তার সাথে আমার কোনই সম্পর্ক নেই। (মুসলিম, মিশকাত: ৩৬৬৯)
আবূ বাকরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন পাপই এতটা যোগ্য নয় যে, পাপীকে আল্লাহ তা‘আলা খুব শীঘ্র এ দুনিয়াতেই তার বিনিময় দেবেন এবং আখিরাতেও তার জন্য শাস্তি জমা করে রাখবেন। তবে হ্যাঁ, এরূপ দু’টো পাপ রয়েছে- ১. সমসাময়িক নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এবং ২. আত্মীয়তার বন্ধনকে ছিন্ন করা। ( তিরমিযী: ২৫১১, ইবনু মাজাহ: ৪২১১, আবু দাউদ: ৪৯০২)
৪. আত্মীয়তার বন্ধন: বন্ধনের চতুর্থ স্তর হলো আত্মীয়তার বন্ধন। সদাচরণ পাবার ক্ষেত্রে আত্মীয়রা রয়েছে দ্বিতীয় ধাপে, এ ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে মাতা-পিতা।
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال "الرَّحِمُ شِجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمٰنِ. فَقَالَ اللهُ: مَنْ وَصَلَكِ وَصَلْتُه وَمَنْ قَطَعَكِ قَطَعْتُه "
আবূ হুরায়রা (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘রাহেম’’ (আত্মীয়তা) শব্দটি আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নাম ‘‘রহমান’’ থেকে উদ্ভূত। আল্লাহ তা‘আলা ‘‘রহম’’(আত্মীয়তা)কে বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তোমাকে সংযোজন করে, আমি তার সাথে সংযোজিত হবো; আর যে ব্যক্তি তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। ( বুখারী: ৫৬৪২, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ্ :৯২২, সহীহুল জামি‘: ৩৫৪৮)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা সকল মাখলূক সৃষ্টি করলেন। আর যখন তা থেকে অবসর হলেন, তখন রহিম তথা ‘‘আত্মীয়তা’’ উঠে দাঁড়াল এবং আল্লাহ রহমানুর্ রহীম-এর কোমর ধরল। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেনঃ থামো, কি চাও বলো? ‘‘আত্মীয়তা’’ জিজ্ঞেস করল, এ স্থান তার, যে তোমার কাছে আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদ থেকে রেহাই চায়। আল্লাহ তা‘আলা বললেনঃ তুমি কি এ কথায় সম্মত আছ, যে ব্যক্তি তোমাকে বহাল ও সমুন্নত রাখবে, তার সাথে আমিও সম্পর্ক বহাল রাখব; আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব? রহিম তথা আত্মীয়তা উত্তর দিল, হ্যাঁ, রাযি আছি, হে আমার প্রভু! আল্লাহ তা‘আলা বললেনঃ তাহলে তোমার সাথে আমার এ ওয়া‘দাই রইল। (বুখারী: ৪৫৫২, মুসলিম:২৫৫৪, সহীহুল জামি‘ ২৬৪২)
অপর হাদীসে এসেছে-
আবদুর রাহমান (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ পরিপূর্ণ কল্যাণ ও প্রাচুর্যের অধিকারী আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ "আমিই আল্লাহ এবং আমিই রাহমান। আত্মীয়তার সম্পর্ককে আমিই সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম হতে নির্গত করে এই নাম (রাহমান হতে রাহেম) রেখেছি। যে ব্যক্তি এই সম্পর্ক বহাল রাখবে আমিও তার সাথে (রাহমাতের) সম্পর্ক বহাল রাখব। আর এই সম্পর্ক যে ব্যক্তি ছিন্ন করবে আমিও তার হতে (রাহমাতের) সম্পর্ক ছিন্ন করব”। (তিরমিযী: ১৯০৭, মুছান্নাফে আবনে আবী শাইবাহ: ৩৪৯২, আবু দাউদ: ১৬৯৪)
৫. প্রতিবেশী তথা আবাসিকতার বন্ধন: প্রতিবেশী বলতে নিজ আবাসস্থলের পাশে বসবাসকারী পরিবার। এ ক্ষেত্রে মুসলিম, কাফের, নেক বান্দা,ফাসেক, বন্ধু, শত্রু,পরদেশী, স্বদেশী, উপকারী, ক্ষতিসাধনকারী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, নিকটতম বা তুলনামূলক একটু দূরের প্রতিবেশী সবাই অন্তর্ভুক্ত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জিবরীল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাকিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাছের অংশিদার বানিয়ে দেয়া হবে। ( বুখারী: ৬০১৪;মুসলিম: ২৫২৪)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে। (সহীহ মুসলিম: ১৮৫) আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। (সহীহ মুসলিম : ১৮৩)।
৬. পারিবারিক বন্ধন: পিতা-মাতা, স্বামী/স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি মিলে একটি পরিবার।
বন্ধনের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম আসে নাড়ির সম্পর্ক। আমরা সবাই মায়ের জড়ায়ুর বন্ধন থেকে এসেছি। আর এই জন্য এটাকে আরবিতে রাহেম বলা হয়। আর রাহেম এসেছে রহমান থেকে।
আসমা বিনতু আবূ বকর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার মা আমার কাছে আসলেন। তিনি ছিলেন মুশরিকা। এ ঘটনা ঐ সময়ের, যখন কুরায়শদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি সংঘটিত হয়েছিল। আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রসূল! আমার মা আমার কাছে এসেছেন, তিনি ইসলামের প্রতি অসন্তুষ্ট। সুতরাং আমি কি তার সাথে সদ্ব্যবহার করব? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, তার সাথে উত্তম আচরণ করো। (বুখারী ও মুসলিম, দ্রষ্টব্য: মিশকাত: ৪৯১৩)
বাহয ইবনু হাকীমের দাদা (মু'আবিয়া ইবনু হাইদা রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল কোন ব্যক্তির সাথে আমি উত্তম আচরণ করব? তিনি বললেনঃ তোমার মায়ের সাথে। আমি প্রশ্ন করলাম, এরপর কার সাথে? তিনি বললেনঃ তোমার মায়ের সাথে। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, এরপর কার সাথে? তিনি বললেনঃ তোমার মায়ের সাথে। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, এরপর কার সাথে? তিনি বললেনঃ তারপর তোমার বাবার সাথে, তারপর নিকটাত্মীয়তার ক্রমানুসারে উত্তম আচরণ করবে। (তিরমিযী: ১৮৯৭)
বিভেদ নয় এক্যবদ্ধতা: আল্লাহ বলেন-
তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (ধর্ম বা কুরআন)কে শক্ত করে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর; তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে... ( সূরা ৩ আলে ইমরান: ১০৩)
আবদুর রহমান ইবনু গানম ও আসমা বিনতু ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যাদেরকে দেখলে আল্লাহকে স্মরণ হয়। আর আল্লাহ তা‘আলার নিকৃষ্ট বান্দা তারা, যারা মানুষের পরোক্ষ নিন্দা করে বেড়ায়, প্রিয়জনের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং পূত-পবিত্র লোকেদের পদস্খলন প্রত্যাশা করে। ( আহমাদ ও বায়হাক্বী শু‘আবুল ঈমানে,দ্রষ্টব্য মিশকাত: ৪৮৭১, সিলসিলাতুস সহীহাহ: ২৮৮৯) ।
বন্ধনের ক্ষেত্রে অন্তরায়:
পরস্পরের মাঝে সুদৃঢ় বন্ধনের জন্য দরকার বিশ্বাস ও আস্থা এবং সহনশীল আচরণ। গীবত, চুগলখুরী, ছিদ্রান্বেষণ, অপবাদ, উপহাস, সন্দেহ, ধারণা, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি বিষয়গুলো সামাজিক ব্যধি এবং ইসলামে এগুলো হারাম। এইগুলো পারস্পরিক বন্ধনকে আগলা করে।
আল্লাহ বলেন.
হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বহুবিধ ধারণা হতে দূরে থাক; কারণ কোন কোন ধারণা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা (গীবত) করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভায়ের গোশত ভক্ষণ করতে চাইবে? বস্তুতঃ তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। ( সূরা ৪৯ হুজুরাত: ১২)
মানুষের মর্যাদা জন্মগত বা বংশগত নয় বরং পরহেজগারিতার ভিত্তিতে:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ﴿١٣﴾
হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক আল্লাহ-ভীরু। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন। ( সূরা হুজুরাত:১৩)
পরিশেষ, আমরা প্রতিটি বন্ধনকে যেন সুদৃঢ় রাখি এবং বন্ধনের সুতো যেন খুলে না ফেলি। নিজেদের পারস্পরিক মতানৈক্য বা ধর্মীয় মতবাদের বিভেদকে পাশে রেখে ঐক্যবদ্ধতাকে যেন আঁকড়ে ধরি। বিশেষ করে বিশ্বাসী বান্দাদের উচিত আল কুরআনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাওয়া।
সংকলন ও সম্পাদনা: সামসুল আলম
বিষয়: বিবিধ
৭৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন