ক্ষতি করো না ও ক্ষতিগ্রস্থ হইও না
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:২৪:৩১ রাত
আসরের সালাত পড়ে বাজার মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে ঘুরতে বের হয়েছি। আগে যেখানে জাম গাছটা ছিলো তার কাছেই রাস্তার পাশে আমরা বসে আলাপ করতে থাকি। যেহেতু দেশের বাইরে থাকি, অনেকদিন এদিকে আসা হয় নি। আমাদের সামনে নিচু জায়গায় একটা ক্ষেত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, যেখানে আশে-পাশের সব জমি আবাদি, ওটাকে পরিত্যক্ত মনে হলো। আমি ইমাম সাহেবকে জিগ্যেস করলাম, আপনি কি জানেন এই ক্ষেতটা কার? পতিত পড়ে আছে কেন?
উনি প্রথমে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলেন, আমি আবারো উনার মনোযোগ আকর্ষণ করলে উনি বলতে বাধ্য হলেন-
আসলে ক্ষেতটা নিয়ে ঝামেলা আছে, জমিটা দুইজনের কাছে বিক্রি হয়েছে। আদলতে মামলা হয়েছে, তাই কোনো পক্ষই এখন আর ক্ষেতে যেতে পারছে না।
আমি ব্যাপারটা বিস্তারিত জানতে চাইলাম। উনি সংক্ষেপে যেটা জানালেন, তা হলো-
জমির মালিক দুই বছর আগে যার কাছে (সঙ্গত কারণে নাম উল্লেখ করলাম করলাম না) জমি বিক্রি করে, সে মূর্খ এবং জমির কাগজপত্র তেমন বুঝে না। জমি ক্রয় করে সে দুই বছর এতে চাষাবাদও করে। এই বছর ক্ষেতে চাষ করতে গেলে তাকে পাশের মহল্লার এক লোক বাঁধা দিয়ে এই জমি নিজের দাবি করে। সে নাকি এই জমি এক বছর আগে জমির পূর্বতন মালিকের কাছ থেকে কিনেছে।
ব্যাপারটা হলো, প্রথম ক্রেতার দলিলে উল্লেখিত জমির দাগ না লিখে ভিন্ন একটা দাগ লেখা হয়েছিল। পরের ক্রেতা সমাজে প্রতিষ্ঠিত কৃষক এবং ধূর্তবাজ। সে যখন জানতে পারলো যে, এই জমির দাগ নম্বর দলিলে নেই, জমির মালিককে প্ররোচিত করে (টাকা দিয়ে) এই জমির সঠিক দাগ নম্বর দিয়ে নিজের নামে দলীল করে।
প্রথমে সামাজিক সালিশ বৈঠক হয়। জানা কথা এখানে প্রথম ক্রেতা টিকতে পারবে না, সমাজের প্রায় সব সালিশী লোকগুলো টাকায় বিক্রি হয়। যারা সৎ লোক তাদের সংখ্যা কম বলে সালিশে কোনো সমাধান না হওয়াতে আদালতে মামলা হয়। দেশের আদলতে জমি সংক্রান্ত মামলাগুলোর নিষ্পতি খুবই কম হয় এবং তাতে সমাধান আসতে অনেক সময় লাগে। জমি সংক্রান্ত বিরোধ আসলে সামাজিক ভাবেই সমাধান হতে হয়। এখন ব্যাপারটা অনেকদিনের জন্য ঝুলে গেলো।
আমি ঘটনা শুনে হতবাক হয়ে বললাম, জেনে শুনে একজন গরীব-মূর্খ লোকটাকে কিভাবে তিনি (পরের ক্রেতা) ঠকাতে পারেন? উনাকে তো কঠোর ধার্মিক বলেই জানি! ইমাম সাহেব কিছু বললেন না, অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
আমার মগজে ব্যাপারটা সারাক্ষণের জন্য লটকে থাকলো। উনার তো উচিত ছিলো, দলীলের ব্যাপারটা জানার পর ক্রেতার পক্ষ হয়ে মালিকের কাছ থেকে দলীলের কাগজ-পত্র ঠিক করে দেয়া। যেহেতু সে সামাজিক ভাবে দূর্বল। অথচ তিনি এক্ষেত্রে (দরীদ্র লোকটার সাথে) চালাকি করে জমিটা নিজের করতে চাইছেন। তিনি ভুলে গেলেন আল্লাহর সাথে চালাকি করা যাবে না।
সমাজের কিছু লোক আছে যারা পার্থিব ব্যাপারে চালাকি করে কিছু হাসিল করতে পেরে নিজেকে অনেক বুদ্ধিমান ভাবে। এভাবে তারা দূর্বল ওয়ারিশদের (ভাই-বোন-ভাগ্নে) কাছ থেকে ধোঁকা দিয়ে জমি আত্মসাত করে। এরা বিতর্কিত জমির দিকে বেশি মনোযোগি হয়। যাতে কম টাকায় জমি আত্মসাৎ করতে পারে।
এটাকে তারা তেমন গুরত্ব দেয় না, অথচ দাড়ি-টুপি-নামাজের ব্যাপারে খুবই হুঁশিয়ার। ইসলামকে তারা শুধু কিছু পোষাকি আচারে পরিণিত করে ফেলেছে। নামাজ-রোযা-হাজ্জ আর রমাযানে যাকাতের টাকা বিতরণের মাঝে সীমাবদ্ধ করে নিজেদের উপার্জন, পারস্পরিক আচার-আচরণ, আদাব-আখলাকের ব্যাপারে উদাসীন।
আল্লাহ বলেন-
"নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা (সুবিচার), সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালংঘন করা হতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন; যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর। (১৬:৯০)
উপরের প্রথম ক্রেতাটি বোকামি করেছে বিজ্ঞ লোক ও সাক্ষ্য ছাড়া জমি দলীল করে আর দ্বিতীয় লোকটি একাধারে প্রতারণার মাধ্যমে জমি আত্মসাৎ, জালিয়াতি, ধোঁকা, জুলুম, সীমালঙ্ঘনের মতো অপরাধে ঘৃণিত।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন-
‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কারো জমির কিয়দংশ জবরদখল করবে, ক্বিয়ামত দিবসে এজন্য তাকে সপ্ত যমীন পর্যন্ত পুঁতে দেওয়া হবে’। (বুখারী; মিশকাত হা/২৯৫৮) তিনি আরো বলেন-
‘যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ জমি জবরদখল করবে আল্লাহ তাকে যমীনের সপ্ত স্তর পর্যন্ত তা খনন করতে বাধ্য করবেন। অতঃপর ক্বিয়ামত দিবসে তা তার গলায় বেড়ী করে রাখা হবে, যে পর্যন্ত না মানুষের মাঝে বিচারকার্য শেষ হয়’। (আহমাদ, মিশকাত হা/২৯৬০)
তিনি আরো বলেন-
‘যে ব্যক্তি জমির নিশানা বা আইল পরিবর্তন করে আল্লাহ তার উপর অভিসম্পাত করেন’। (মুসলিম, মিশকাত: ৪০৭০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের উপর অস্ত্র তোলে। আর যে আমাদেরকে ধোঁকা দেয়, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়।’’ (মুসলিম: ১০১)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, কোন একসময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম (বাজারে) একটি খাদ্যশস্যের স্তূপ অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজের হাতকে স্তূপের মধ্যে প্রবেশ করালেন। তিনি তার হাতে ভিজা অনুভব করেন। স্তূপের মালিককে তিনি প্রশ্ন করেনঃ এ কি? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এটা বৃষ্টির পানিতে ভিজে গিয়েছিল। তিনি বললেনঃ ভিজাগুলো স্তুপের উপরে রাখলে না কেন, যাতে লোকেরা দেখতে পেত? অতঃপর তিনি বললেনঃ প্রতারণাকারী ও ধোকাবাজকারীদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। (তিরমিযী: ১৩১৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
‘‘প্রকৃত মুসলিম সেই, যার মুখ ও হাত হতে মুসলিমগণ নিরাপদে থাকে। আর প্রকৃত মুহাজির [দ্বীন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে স্বদেশ ত্যাগকারী] সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ কর্মসমূহ ত্যাগ করে।’’ (বুখারী: ১০, ৬৪৮৪, মুসলিম: ৪০)
তিনি আরো বলেন-
"কারো ক্ষতি করো না ও ক্ষতিগ্রস্থ হইও না (নিজের ক্ষতি করো না), কেউ অপরের ক্ষতি করলে আল্লাহ তার ক্ষতিসাধন করবেন, আর যে অন্যকে কষ্টে ফেলবে আল্লাহ তাকে কষ্টের মধ্যে ফেলবেন।"হাকেম রহ. বলেন-হাদীসটি মুসলিমের শর্তে সহীহ। (আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন:২৩৯২)
আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।।
সংকলন ও সম্পাদনায়: #সামসুল_আলম
বিষয়: সাহিত্য
৭১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন