দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও রাজনীতি: আমাদের কর্তব্য
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮, ০১:৪১:২০ রাত
দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও রাজনীতি: আমাদের কর্তব্য
[/b
আসুন প্রথমে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে নিই, তারপর দ্বীন প্রতিষ্ঠার উপায় তালাশ করি।
[b]১. রাজনীতি করা ফরয নাকি দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা?
আল্লাহ বলেন: "তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন দ্বীন/ধর্ম; যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে,
"তোমরা ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং ওতে মতভেদ করো না।" (সূরা ৪২ শূরা:১৩)
যারা ধর্ম আর রাজনীতিকে এক করে ফেলে বা একই জিনিস হিসেবে মনে করে তাদের কাছে "দ্বীন প্রতিষ্ঠার" মানে বুঝানো কঠিন। আল্লাহর দেয়া শরীয়াত বা পথকে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে পালন করার নামই হলো দ্বীন প্রতিষ্ঠা, যা নিজ থেকে শুরু করতে হয়; রাষ্ট্র থেকে নয়। রাজনীতি হলো ক্ষমতা দখলের লড়াই।
অপর আয়াতে এসেছে-
"তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এক একটি শরীয়ত (আইন) ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।" (সূরা মাইদাহ: ৪৮)। দ্বীন প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হলো দাওয়াতি আন্দোলন তথা দাওয়াত ও জিহাদ। যখন রাষ্ট্রীয় ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হবে তখনই কিতাল/যুদ্ধ ফরয হবে।
২. জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের জন্য কী করতে হবে? রাজনীতি নাকি জিহাদ:
আগে দেখতাম একদল লোক "ঈমান-আমলের" দা'ওয়াতের ক্ষেত্রে এই আয়াতকে ব্যবহার করতো, এখন দেখছি- ইসলামী রাজনীতি(!)র ক্ষেত্রে এই আয়াতকে ব্যবহার করছেন। দেখি আল্লাহ কী বলছেন-
"হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক বাণিজ্যের সন্ধান বলে দেব না, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে রক্ষা করবে? (৬১:১০)
"(তা এই যে,) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলে বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানতে।" (সূরা ৬১ সাফ:১১)
আয়াতটি স্পষ্ট। ঈমান ও জিহাদের মাধ্যমে আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে বাঁচতে ও জান্নাত লাভের কথা বলা হয়েছে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন জিহাদ ফরয, তেমনি জিহাদই জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়। জিহাদ ব্যক্তি-পর্যায়ে মৌখিক বা দাওয়াতি আন্দোলন আর সম্মিলিতরূপ হলো রাষ্ট্রের অধীন অস্ত্র দিয়ে লড়াইয়ের নাম।
৩. নবীওয়ালা কাজ কোনটা_? রাজনীতি নাকি দাওয়াতে তাবলীগ নাকি দ্বীন কায়েম?
সূরা সাফের ৯ নম্বর আয়াতকে ব্যবহার করে একদল বলছেন, রাজনীতি করা (ইসলামের জন্য) নাকি নবীওয়ালা কাজ; আগে শুনতাম- একদল লোক বলতো তাবলীগ করা নবীওয়ালা কাজ। আসুন দেখি আল্লাহ কী বলেন-
"তিনিই তাঁর রসূলকে প্রেরণ করেছেন পথনির্দেশ এবং সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্য; যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। (সূরা ৬১ সাফ:০৯)
অর্থ্যাৎ আল্লাহর দ্বীনকে পৃথিবীতে বিরাজমান সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করাই ছিলো রাসূলের কাজ। সুতরাং নবীওয়ালা কাজ হলো "দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা" করার আন্দোলনে শামিল হওয়া।
৪. ইসলামী আন্দোলন আর রাজনীতি কি এক জিনিস?
একদল লোক সূরা আলে ইমরানের ১০৪ ও ১১০ নম্বর আয়াতকে ব্যবহার করে দাওয়াতের কাজকে কখনো রাজনীতি কখনো তাবলীগের সাথে ব্যবহার করছে। আফসোস! তারা জেনে বুঝে আল্লাহর আয়াতকে বিকৃত করছে। আল্লাহ বলছেন-
"তোমরাই শ্রেষ্ঠতম জাতি। মানবমন্ডলীর জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান হয়েছে, তোমরা সৎকার্যের নির্দেশ দান করবে, অসৎ কার্য (করা থেকে) নিষেধ করবে, আর আল্লাহতে বিশ্বাস করবে।" (সূরা ২ আলে ইমরান:১১০)
এখানে আদেশ ও নিষেধ দুটি নির্দেশ এসেছে। শুধু ভালো কাজের দাওয়াতই নয় মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার কথাও এসেছে।
অপর আয়াতে এসেছে-
"তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কার্য থেকে নিষেধ করবে। আর এ সকল লোকই হবে সফলকাম।" ( ৩:১০৪)
সবাই এই কাজ (দাওয়াতি আন্দোলন) করবে না, কেননা এই কাজের জন্য থাকতে হবে বিশেষ যোগ্যতা। সবার মাঝে তা নাও থাকতে পারে। তবে ইসলামের যাবতীয় বিধান পালন করা ও অপরের কাছে পৌছানো (তাবলীগ করা) সবার উপর ফরয। মানুষদের আল্লাহর পথে ডাকার (ও মুসলমানদের মাঝে সংশোধনের) জন্য দরকার দুটি বিশেষ গুণ। তাহলো- হিকমাহ / প্রজ্ঞা ও উত্তম নসীহত। এই জন্য এজন দা'য়ীকে অবশ্যই আলেম হতে হবে।
"তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান করো হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা করো সদ্ভাবে।" (১৬:১২৫)
দাওয়াতের আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব আল্লাহর দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করা ও দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা। এর শুরুটা হবে নিজের মাঝে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
আমরা দাওয়াতের কাজকে তাবলীগের সাথে, দ্বীনের কাজকে রাজনীতির সাথে মেশাবো না। রাজনীতি মানে ক্ষমতার জন্য বা গদির জন্য লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা। এতে দ্বীনের ভালো হতেও পারে, নাও হতে পারে। আমি জানি, যারা ইসলামী রাজনীতির কথা বলেন তারা এটা বুঝাতে চান, গদিতে বসে বা ক্ষমতা পেয়ে ইসলামের যাবতীয় বিধান তারা পালন করবেন। অথচ আল্লাহ তাআলা কখনো কোথাও এটা বলেন নি যে, ক্ষমতায় না যাওয়া পর্যন্ত দ্বীন বিজয়ী হবে না বা ইসলামের যাবতীয় বিধান মানা যাবে না। বরং আজ থেকে পনেরশত বছর আগেই আল্লাহ দ্বীনকে বিজয়ী করে দিয়েছেন এবং পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
"আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম (ইসলাম) পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসাবে মনোনীত করলাম।" (৫:৩)
দায়িত্ব ও কর্তব্য:
এখন আর আংশিক দ্বীন পালনের সুযোগ নেই কোনো মুসলমানের। প্রত্যেকে যার যার অর্পিত দায়িত্ব পালন ও যাতীয় আমল করবে। যে সমাজের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হবে বা নিজেই নিজেের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিবে তার উপর ফরয হবে, আল্লাহর বিধান দিয়ে মানুষের মাঝে ফায়সালা করা।
এখানে তার অন্য কোনো যুক্তি বা বাহানা চলবে না।
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
সাবধান! তোমরা সকলেই রাখাল (দায়িত্বশীল) এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার রাখালী (দায়িত্ব পালন) প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যিনি জনগণের নেতা তাকে তার রাখালী (দায়িত্ব) বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। ব্যক্তি তার পরিবারের লোকদের রাখাল (অভিভাবক)। তাদের ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সংসারের রাখাল (ব্যবস্থাপিকা)। তাকে এর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। গোলাম তার মনিবের সম্পদের রাখাল (পাহারাদার)। তাকে এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হবে। অতএব, সাবধান! তোমরা সকলেই রাখাল এবং তোমাদের সকলকেই নিজ নিজ রাখালী বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। (বুখারী:২৫৫৪, মুসলিম: ১৮৩০)
মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি হারাম ও কুফুরী: রাজনীতি করা বা ক্ষমতার জন্য যা করা হয় তা হলো পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আর দলে দলে বিভক্ত হওয়া। আল্লাহ বলেন-
"তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (দ্বীন বা কুরআন)কে শক্ত করে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।" (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)"তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি। (৩:১০৫)
সুতরাং রাজনীতি নয় ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর দ্বীনকে রাসূলের সুন্নাহ দিয়েই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যাক্তি আমাদের উপর অস্ত্র উত্তোলন করবে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (বুখারী, মুসলিম)
পরিশেষ: আসুন আমরা নিজেকে সংশোধন করি আর অপরকে সংশোধনের দিকে দাওয়াত দিই।
যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকাজ করে এবং বলে, ‘আমি তো আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)’ তার অপেক্ষা কথায় উত্তম আর কোন্ ব্যক্তি? (৪১:৩৩)
বিষয়: সাহিত্য
৬০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন