দুনিয়া ও নারীদের ফেতনা থেকে সতর্ক থাকা (দরসে হাদীস)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০৭ জানুয়ারি, ২০১৮, ০৩:২১:৪০ রাত
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
দুনিয়া ও নারীদের ফেতনা থেকে সতর্ক থাকা (দরসে হাদীস)
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللَّهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَيَنْظُرُ كَيْفَ تَعْمَلُونَ فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ فَإِنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِي إِسْرَائِيلَ كَانَتْ فِي النِّسَاءِ " . وَفِي حَدِيثِ ابْنِ بَشَّارٍ " لِيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ " .
বাংলা: আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) সুত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ নিশ্চয়ই দুনিয়া সুমিষ্ট সবুজ (আকর্ষণীয় ও চাকচিক্যময়) আল্লাহ তা'আলা সেখানে তোমাদের খলীফা হিসেবে পাঠিয়েছেন। তিনি দেখতে চান যে, তোমরা কেমন আমল করো? তোমরা দুনিয়া ও নারী থেকে সতর্ক (সাবধান) থাকো। কেননা বনী ইসরাঈলদের মধ্যে যে প্রথম ফিতনা দেখা দিয়েছিল তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।
ইবনু বাশশার (রহঃ) এর বর্ণিত হাদীসে فَيَنْظُرُ এর স্থানে لِيَنْظُرَ কথাটি আছে। (সহীহ মুসলিম:২৭৪২, কিতাবুর রিকাক)
(সূত্র: সহীহ মুসলিম: ২৭৪২, সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী, কিতাবুন নিকাহ: ১৩১৪৭, মুসনাদে আহমাদ: ১০৭৮৫)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: পৃথিবীকে আল্লাহ তা'আলা লোভনীয় ও আকর্ষণীয় করে রেখেছেন নানা সৌন্দর্যে ভরপুর করে। তারপর সাবধান করে দিয়েছেন এসব আকর্ষণীয় জিনিসের কারণে যেন আল্লাহ হুকুমের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন না হয়। সুতরাং পৃথিবীর যাবতীয় ফেতনা, বিপর্যয় থেকে যেন মুসলিম দুরে থাকে সে ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. সতর্ক করেছেন। বিশেষ করে নারীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা, কেননা ফেতনা প্রধানত নারী থেকেই শুরু হয়।
আল্লাহ বলেন-
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ
নারী, সন্তান-সন্ততি, জমাকৃত সোনা-রূপার ভান্ডার, পছন্দসই (চিহ্নিত) ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামার প্রভৃতি কমনীয় জিনিসকে মানুষের নিকট শোভনীয় করা হয়েছে। এ সব ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহর নিকটেই উত্তম আশ্রয়স্থল রয়েছে। (সূরা ৩ আলে ইমরান:১৪)
তিনি বলেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ وَاخْشَوْا يَوْمًا لَا يَجْزِي وَالِدٌ عَنْ وَلَدِهِ وَلَا مَوْلُودٌ هُوَ جَازٍ عَنْ وَالِدِهِ شَيْئًا ۚ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ ۖ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো এবং সেদিনকে ভয় করো, যেদিন পিতা সন্তানের কোন উপকারে আসবে না, সন্তানও তার পিতার কোন উপকারে আসবে না। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং শয়তান যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে। (সূরা ৩১ লুকমান:৩৩)
হাদীসটি কম-বেশি শব্দে আরো এসেছে-
(সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী: কিতাবুল জানায়িয:৬৩৭৬, মুসতাদরাক (হাকেম):৮৫৯০, মু'জামুল আওসাত (তাবরানী):৩৮২৯, সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪০০০, সহীহ ইবনে খুজাইমাহ:১৬৯৯, মুসনাদে আহমাদ: ১০৭৫৯, ১০৭৮৫, ১১০৩৪, ১১১৯৩, মুছান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক:২০৭২০)
প্রেক্ষাপট:
এই হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রহ.) ইমাম হাকেম (রহ.) ইমাম তাবরানী, ইমাম আহমাদ ইবনে হুমাম (রহ) তাদের হাদীস গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে এনেছেন। যেমন জামে আত-তিরমিযীতে এভাবে এসেছে-
আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, এক সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে একটু বেশী বেলা থাকতেই আসরের নামায আদায় করেন, তারপর ভাষণ দিতে দাঁড়ান। উক্ত ভাষণে কিয়ামাত পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটবে সেই প্রসঙ্গেই তিনি আমাদেরকে জানিয়েদেন। কেউ সেগুলো মনে রেখেছে এবং কেউ আবার তা ভুলে গেছে। তার ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন তার মধ্যে ছিলঃ
দুনিয়াটা সবুজ-শ্যামল ও সুমিষ্ট (আকর্ষণীয়), আর আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে এর উত্তোরাধিকার বানিয়েছেন। সুতরাং তোমরা কি করছ তা তিনি লক্ষ্য রাখছেন। শোন! দুনিয়া ও নারীদের ব্যাপারে সাবধান। তিনি আরো বলেনঃ সাবধান! কেউ যখন কোন সত্য কথা জানবে, তখন তাকে মানুষের ভয় যেন সেই সত্য বলা থেকে বিরত না রাখে।
রাবী বলেন, এই কথা বলে আবূ সাঈদ (রাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, আল্লাহ তা'আলার কসম! আমরা এরকম কত কাজ হতে দেখেছি কিন্তু তা বলতে মানুষকে ভয় করেছি। তিনি আরো বলেনঃ জেনে রাখ! কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য তার বিশ্বাসঘাতকতার পরিমাণ অনুযায়ী একটি করে পতাকা স্থাপন করা হবে। মুসলিম রাষ্ট্রনায়কের বিশ্বাসঘাতকতার চাইতে ভীষণ কোন বিশ্বাসঘাতকতা নেই। তার এই পতাকা তার নিতম্বের কাছে স্থাপন করা হবে।
সেদিনের আরও যেসব কথা আমরা মনে রেখেছি তার মধ্যে ছিলঃ শুনে রাখ! আদম-সন্তানদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের এক দল তো মু'মিন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছে, মুমিন অবস্থায় জীবন যাপন করেছে এবং মু'মিন অবস্থাতেই মারা গেছে।
তাদের অপর দল কাফির অবস্থায় জনগ্রহণ করেছেন, কাফির অবস্থায় জীবন কাটিয়েছে এবং কাফির অবস্থায়ই মারা গেছে।
অপর দল মু'মিন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন, মু'মিন অবস্থায় জীবন যাপন করেছে এবং কাফির অবস্থায় মারা গেছে।
অপর দল আবার কাফির অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছে, কাফির অবস্থায় জীবন যাপন করেছে এবং মু’মিন অবস্থায় মারা গেছে।
জেনে রাখ! মানুষের মধ্যে কারো রাগ আসে দেরিতে এবং চলে যায় খুব তাড়াতাড়ি। আবার কারো রাগ আসে তাড়াতাড়ি এবং চলেও যায় তাড়াতাড়ি। সুতরাং এর জন্য এই। জেনে রাখ! তাদের মধ্যে কারো রাগ আসে খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু চলে যায় খুব দেরিতে। জেনে রাখ! তাদের মধ্যে উত্তম হল যাদের রাগ আসে দেরিতে এবং চলে যায় খুব তাড়াতাড়ি। আর তারাই খুব নিকৃষ্ট, যাদের রাগ আসে খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু চলে যায় দেরিতে।
জেনে রাখ! মানুষের মধ্যে কেউ পাওনা পরিশোধের বেলায়ও ভালো আবার পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রেও ভদ্র। আবার কেউ পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে নিকৃষ্ট কিন্তু পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে ভদ্র। আবার কেউ পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে ভদ্র কিন্তু আদায়ের ক্ষেত্রে অভদ্র। এক্ষেত্রে একটি অপরটির পরিপূরক হয়ে যায়।
জেনে রাখ! তাদের মধ্যে কারো পাওনা পরিশোধ নিকৃষ্ট এবং সে তাগাদা প্রদানের ক্ষেত্রে অভদ্র। জেনে রেখ সেই সবচেয়ে ভাল, যে পাওনা পরিশোধের বেলায় ভাল এবং পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রেও ভদ্র। জেনে রাখ! তাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি খুবই খারাপ যার পাওনা পরিশোধও নিকৃষ্ট এবং যে তাগাদা প্রদানেও অভদ্র। জেনে রাখা রাগ মানুষের অন্তরের অগ্নিস্ফুলিংগর মত। তোমরা কি লক্ষ্য করনি যে, রাগাৱিত ব্যক্তির চক্ষুদ্বয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করে এবং তার ঘাড়ের শিরাগুলো ফুলে উঠে। সুতরাং তোমাদের কেউ এরূপ অনুভব করলে সে যেন মাটিতে লুটিয়ে যায় (তাহলে রাগ কমে যাবে)।
রাবী বলেন, আমরা সূর্যের দিকে তাকাতে লাগলাম যে, তা এখনো অবশিষ্ট আছে কি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ জেনে রাখ! তোমাদের এই দুনিয়ার যতটুকু অতীত হয়ে গেছে, সেই হিসাবে এতটুকুও আর অবশিষ্ট নেই যতটুকু আজকে এই দিনের অতিবাহিত হয়েছে তার তুলনায় যতটুকু অবশিষ্ট আছে। (কিতাবুল ফিতান:২১৯১)
আল্লাহ আমাদের দুনিয়ার যাবতীয় ফেতনা থেকে দুরে রাখুন। আমীন!!
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ইহকালে কল্যাণ দান কর এবং পরকালেও কল্যাণ দান কর। আর আমাদেরকে দোযখ-যন্ত্রণা থেকে রক্ষা কর।’
সংকলন ও সম্পাদনায়: সামসুল আলম দোয়েল
বিষয়: সাহিত্য
১৫৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন