যে লটকায় তাকে তার উপরই সোপর্দ করা হয়

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০৮ আগস্ট, ২০১৭, ০৩:০৫:৪২ রাত

যে লটকায় তাকে তার উপরই সোপর্দ করা হয়: তাজিজ-কবচ লটকানো শিরক



রাজশাহী থেকে বাসে করে ফিরছি। যমুনা বহুমুখী সেতু পার হয়ে এসেছি (গাড়ি চলছে প্রচন্ড গতিতে) অনেকেই হালকা ঘুমে বা তন্দ্রায়। হঠাৎই প্রচন্ড ঝাঁকুনীতে সবার চোখ খুলে যায়, আর দেখতে থাকি গাড়ি ডানদিকে কাত হয়ে রাস্তার একপাশ থেকে আরেকপাশে ছুটছে(এলোমেলো ভাবে) তারপর ড্রাইভার তার অসাধারণ কৌশল ও শক্তিতে গাড়িটা একটা ব্রিজের পাশে এনে ঠেকাতে পারল। ঘটনা ছিল- সামনের ডানপাশের চাকাটা ব্রাস্ট হয়ে যায়, এর একটু আগেই একটা পাখি গাড়ির সামনের গ্লাসে এসে বাড়ি খাওয়াতে ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে ছিল (অনেকেই বলাবলি করছিল, পাখি তার জীবন দিয়ে আমাদের জীবন বাঁচিয়ে দিল, কেননা যে গতিতে গাড়ি চলছিল সেই গতি থাকলে গাড়ি লাফিয়ে বা ওলটে পাশের খাদে পড়তো বা সামনে বা পিছন থেকে কোনো গাড়ি আসলেও বিপদ ঘটতো)

যাহোক! হাই-ওয়ে পুলিশ আসল, আর গাড়ির চাকা পাল্টানো হলো। আমরা নিচে নেমে যার যার মতো ঘটনার ব্যখ্যা দিতে থাকি (যেমনটা বাঙ্গালীরা করে থাকি)। আমি রীনা আপাকে (ইংরেজি বিভাগের) বললাম: আজ এই তাবিজের কারণে অনেক বড় বিপদ থেকে বাঁচলাম। (আমার কোমরে একটা তাবিজ ছিল, কবিরাজ দেওয়ার সময় বলছিলেন, এটা যাবতীয় বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবে, আমি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলছিলাম) রীনা আপা বললেন: আমি এসব বিশ্বাস করি না, সব কুসংস্কার!

পরবর্তীতে যখন জানতে পারলাম "তাবিজ লটকানো শিরক" তখনই তা ছিঁড়ে ফেলে দিই এবং নিজেই বুঝতে পারি কেন রাসূলুল্লাহ সা. তাবিজ লটকানোকে শিরক বলেছিলেন। আফসোস! আমি সেইদিন নিজের অজান্তেই কত বড় শিরক করে ফেলেছিলাম! আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন।



ছোট্টবেলায় অনেককিছুই লটকানো হতো আমাদের গলায় বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় (যদিও বড় হয়ে লজ্জায় গলায় কিছু ঝুলাইনি, শুধু বাহুতে বা কোমরে ঝুলতো)। পনের বছর আগে সবকিছু ছাড়ার পর আগের চেয়ে ভালোই আছি। বিশ্বাস করুন! আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে কিছু ঝুলাতে বা কপালে কালি দিতেও দিইনি, সে অন্যান্য বাচ্চাদের মতোই আছে বরং আরো ভালো আছে।

তাবিজ লটকানো কেন হারাম? আসলে কোনোকিছু লটকালে মনের অজান্তেই লটকানো জিনিসের প্রতিই একমাত্র আস্থা বা ভরসায় পরিণত হয় আল্লাহর মোকাবিলায়। ঔষুধ বা ঝাড়ফুঁকের ব্যাপারটা সেই রকম নয়।



তাবিজ বা যেকোনো জিনিসই লটকানো শিরক:



“যে আল্লাহর উপর ভরসা করবে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট ” ( সূরা আত্ তালাক: ৩ )



নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক কোনোকিছু ঝুলিয়ে রাখে (তাবিজ-তুমার) তাকে তার উপরই সোপর্দ করা হয়। (তিরমিযী: ২০৭২, মুছান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ: ৩২৪৮, আহমাদ: ১৮৩০৪, হাকেম:৭৫৭৮, মু'জামুল কাবীর(তাবারানী):৯৬০, মিশকাত:৪৫৫৬)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "যে তাবিজ লটকায় সে শিরক করে" (আহমাদ: ১৬৯৬৯, হাকেম:৪২১৯, মু'জামুল কাবীর:৮৮৫)

জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মন্ত্র পাঠ করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ এটি শয়তানের কাজ। (আবু দাউদ:৩৮৬৮,আহমাদ:১৩৭২১)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) হারাম জিনিষ দিয়ে তৈরী ঔষধ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ:৩৮৭০, ইবনে মাজাহ:৩৪৫৯,তিরমিযী: ২০৪৫)

মাসয়ালা: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও ইবনে আব্বাস রা.-এর মতে (সর্বপ্রকার) তাবিজ লটকানো হারাম। একদল সাহাবী, তাবেয়ী ও পরবর্তী আলেমরা এই অভিমতই পোষণ করতেন।

হাদীস: আব্দুল্লাহ (রাঃ)-এর স্ত্রী যাইনাব (রাঃ) আব্দুল্লাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ ,ঝাড়ফুঁক, তাবীজ ও তাওলা (অবৈধ, প্রেম ঘটানোর যাদুমন্ত্র) শির্ক-এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি (যাইনাব) বলেন, আমি বললাম, আপনি এসব কী বলেন? আল্লাহর কসম! আমার চোখ থেকে পানি পড়তো, আমি অমুক ইয়াহুদী কর্তৃক ঝাড়ফুঁক করাতাম। সে আমাকে ঝাড়ফুঁক করলে পানি পড়া বন্ধ হয়ে যেতো। আব্দুল্লাহ (রাঃ) বললেন, এগুলো শয়তানের কাজ। সে নিজ হাতে চোখে যন্ত্রণা দেয়, যখন সে ঝাড়ফুঁক দেয় তখন সে বিরত থাকে। এর চেয়ে বরং তোমার জন্য এরূপ বললেই যথেষ্ট হতো, যেরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেনঃ ‘‘হে মানবজাতির রব! যন্ত্রণা দূর করে দিন, আরোগ্য দান করুন, আপনি আরোগ্যদাতা, আপনার দেয়া নিরাময়ই যথার্থ নিরাময়, যার পরে আর কোনো রোগ বাকী থাকে না।’’ (আবু দাউদ:৩৮৮৩)

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস রা.এর মতে, "আল্লাহর নাম ও সিফাত এবং কুরআন" দিয়ে তাবিজ লটকানো জায়েজ। যদিও এটা নিয়ে বিতর্ক আছে এবং সতর্কতা বিদ্যমান। কেননা পবিত্র কালাম নিয়ে পেশাব-পায়খানা বা খারাপ স্থানে লটকানোও বৈধ নয়।

বর্তমানকালের অধিকাংশ (আরব/অনারব) আলেমদের অভিমত হচ্ছে-
" যে তাবিজে কোনো মন্ত্র থাকে (যার অর্থ বোধগম্য নয়), নকশা আঁকা থাকে বা সংখ্যা থাকে অথবা এমন কিছু লেখা থাকে যা শিরক বা কুফুরীবাক্য তা সর্ব সম্মতভাবে শিরকী ও হারাম।" আর অন্যান্য অবস্থাতে তা পরিত্যাজ্য।



কেননা কুরআন বা দু'আ পড়ে ঝাড়ফুঁকের কথা হাদীসে এসেছে। তাছাড়া কওলী (কথাবাচক) হাদীস ফে'লী(কর্মবাচক) হাদীসের উপর প্রাধান্য পাবে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে শিরক ও কুফর থেকে রক্ষা করুন। আমীন।।

(পুনশ্চ: শায়েখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ,ফতোয়া:১০৫৪৩, শায়খ ইবনে বা'জ,)

বিষয়: বিবিধ

১০৩৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383736
০৮ আগস্ট ২০১৭ দুপুর ০১:৩৩
আবু জারীর লিখেছেন : আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের পরিবারে কখনওই তাবিজের প্রচলন ছিলনা। একবার শখ করে মায়ের অজান্তে সাপুড়েদের কাছ থেকে একটা তাবিজ কিনে বাহুতে বেধেছিলাম কিন্তু মায়ের হাতে ধরা খেয়ে সেটা ফেলে দিতে হয়েছিল।
383740
০৮ আগস্ট ২০১৭ দুপুর ০২:২৪
হতভাগা লিখেছেন : এগুলোকে তদবীর করাও বলে ।

কোন এক সময়ে নিরুপায় হয়ে এরকম কাজে বাধ্য হয়েছিলাম । হুজুরকে জিজ্ঞাস করেছিলাম এগুলো শিরক না তো ? উনি বলেছিলেন না, শিরক না । এক মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন উনি।

পরে বুঝতে পারি যে ওটা শিরকই ছিল।

না বুঝে করেছিলাম । আল্লাহ মাফ করে দিন - আমিন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File