নেতৃত্বের পরিণতি ও মুমিনদের কতর্ব্য
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০২ আগস্ট, ২০১৭, ০২:৪২:২৫ রাত
নেতৃত্বের পরিণতি অপমান আর লাঞ্ছনা:
নেতা বা আমীর যদি মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে আর জনগণের অধিকারকে পুরোপুরি সংরক্ষণ করে তাহলে তার জন্য রয়েছে মহাপুরষ্কার ।(আরশের নিচে ছায়া পাবার কথাও হাদীসে এসেছে) এর বিপরীতে অসৎ ও গোমরাহী নেতাদের জন্য রয়েছে তিরষ্কার, লাঞ্ছনা আর শাস্তি! (দ্রষ্টব্য: বুখারী: ৭১৪৮, নাসায়ী ৪২১১, মিশকাত:৩৬৮১-৮৪)
তারা আরো বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় বড় লোক (বুযুর্গ)দের আনুগত্য করেছিলাম, সুতরাং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল।
হে আমাদের প্রতিপালক! ওদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং মহা অভিসম্পাত করো।’ (সূরা ৩৩ আহযাব:৬৭-৬৮)
عن أَبِىْ اُمَامَةَ عَنِ النَّبِىِّ ﷺ أَنَّه قَالَ : «مَا مِنْ رَجُلٍ يَلِىْ أَمْرَ عَشَرَةٍ فَمَا فَوْقَ ذٰلِكَ إِلَّا أتاهُ اللّٰهُ عَزَّ وَجَلَّ مَغْلُوْلًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَدُه إِلٰى عُنُقِه فَكَّه بِرُّه أَوْ أَوْبَقَه إِثْمُه أَوَّلُهَا مَلَامَةٌ وَأَوْسَطُهَا نَدَامَةٌ وَاٰخِرُهَا خِزْىٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
বাংলা: আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দশ বা ততোধিক লোকের নেতা বা জিম্মাদার হয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার গলায় শিকল পরা অবস্থায় উপস্থিত করবেন। তার হাত গর্দানের সাথে বাঁধা অবস্থায় থাকবে, তার নেক ‘আমল তাকে রক্ষা করবে অথবা তার কৃত অপরাধ তাকে ধ্বংস করবে।
নেতৃত্বের প্রথম অবস্থা তিরস্কার ও নিন্দা, মধ্যম অবস্থায় লজ্জা, আর অবশেষে কিয়ামতের দিন অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে। (মু'জামুল কাবীর(তাবারানী):৭৭২০, ৭৭২৪, আহমাদ: ২১৭৯৭, সহীহাহ্: ৩৪৯, সহীহ আল জামি‘ ৫৭১৮, সহীহ আত্ তারগীব ২১৭৫ মিশকাত:৩৭১৪)
অপর হাদীসে এসেছে-তার গলার বেড়ি থেকে তার "ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ" তাকে মুক্ত করবে অথবা তার কৃত "জুলুম ও নির্যাতন" তাকে ধ্বংস করবে। (আহমাদ: ৯৫৭৩, দারিমী: ২৫১৮, সহীহাহ্: ২৬২১)
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দুর্দশা শাসকদের জন্য, দুর্দশা সমাজপতিদের জন্য ও দুর্দশা আমানতদারদের জন্য। অনেক লোক কিয়ামতের দিন অবশ্যই কামনা করবে, যদি তাদের কপালের চুল সুরাইয়া তারকার সাথে বেঁধে দেয়া হত, আর তাদেরকে আকাশমন্ডলী ও জমিনের মাঝে ঝুলিয়ে রাখা হতো, তবুও তাদেরকে সে সব নেতৃত্ব না দেয়া হতো। (আহমাদ: ৮৪১৩, মিশকাত:৩৬৯৮)
মা‘ক্বিল ইবনু ইয়াসার হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ মুসলিম জনতার ওপর যদি কোনো শাসক নিযুক্ত হয়, অতঃপর সে আত্মসাৎকারীরূপে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত:৩৬৮৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন: কোনো ব্যক্তিকে যদি আল্লাহ তা‘আলা প্রজাপালনের দায়িত্ব প্রদান করেন। আর সে তাদের জন্য কল্যাণকর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় বা না পারে, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত:৩৬৮৭)
তিনি সা. আরো বলেন- শাসকদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট শাসক সে, যে অত্যাচারী ও নিপীড়নকারী। (মুসলিম, মিশকাত:৩৬৮৮)
জালেম, ফাসেক শাসক থাকাবস্থায় মুমিনদের কর্তব্য: তারা তাদের নসিহত করবে, সতর্ক করবে, তাদের থেকে দুরে থাকবে ও ধৈর্য ধারণ করবে। তাদের ভালোকাজের আনুগত্য করবে আর আল্লাহদ্রোহিতার ব্যাপারে কোনো আনুগত্য নেই। (আরো দ্রষ্টব্য আল কুরআন: সূরা ৪ নিসা:৫৯, সহীহ মুসলিম, কিতাবুল আমারাহ, অনুচ্ছেদ:১১. শাসকের অত্যাচার অবিচার ও অন্যায় পক্ষপাতিত্বের সময় ধৈর্যধারন)
আল্লাহ বলেন-
" তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কার্য থেকে নিষেধ করবে। আর এ সকল লোকই হবে সফলকাম।" তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি। (সূরা ৩ আলে ইমরান: ১০৪-১০৫)
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নাফরমানির ক্ষেত্রে আনুগত্য নেই। আনুগত্য শুধু সৎকর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত:৩৬৬৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেনঃ প্রতিপালকের অবাধ্যতার মাঝে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য নেই। (শারহুস্ সুন্নাহ্: ২৪৫৫, সহীহ আল জামি‘: ৭৫২০, মিশকাত:৩৬৯৬)
উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের ওপর এমন শাসকবর্গ নিযুক্ত হবে যারা ভালো-মন্দ উভয় প্রকারের কাজ করতে দেখতে পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি তার অসৎ কাজের প্রতিবাদ করল, সে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেল। আর যে ব্যক্তি অন্তর থেকে ঘৃণা করল, সেও নিরাপদ হয়ে গেল। কিন্তু যে ব্যক্তি উক্ত কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করল ও শাসকের আনুগত্য করল, তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, এমতাবস্থায় কি আমরা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করব না? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সলাত কায়িম করে। না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা সলাত কায়িম করে। রাবী বলেন, প্রতিবাদ ও মন্দ জানার অর্থ হলো, যে ব্যক্তি অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করে ও অগ্রাহ্য করে। (মুসলিম, মিশকাত:৩৬৭১)
আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেনঃ শীঘ্রই তোমরা আমার পরে স্বজনপ্রীতি এবং এমন সব কাজ দেখবে যা তোমরা পছন্দ করবে না। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রসূল! তখন আমাদের করণীয় কি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তখন তোমরা তাদের হক আদায় করো। আর তোমাদের হক আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করো। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত:৩৬৭২)
কা‘ব ইবনু ‘উজরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ নির্বোধ লোকেদের নেতৃত্ব থেকে আমি তোমাকে আল্লাহ তা‘আলার হিফাযাতে অর্পিত করলাম। তিনি (কা‘ব ) বললেনঃ হে আল্লাহর রসূল! এটা কিরূপে হবে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ শীঘ্রই আমার পরে বিভিন্ন যুগে তাদের (নির্বোধ ও যালিমরূপে আমীর ও শাসক) আবির্ভূত হবে আর যে ব্যক্তি তাদের সান্নিধ্যে থাকবে এবং তাদের মিথ্যাকে সত্য বলে স্বীকৃতি দিবে এবং তাদের অন্যায় ও জুলুমের সহযোগিতা করবে, সে আমার দলভুক্ত নয় এবং তাদের সাথে আমারও কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আমার হাওযে কাওসারে আসতে পারবে না। আর যে তাদের নিকট যাবে না এবং তাদের মিথ্যাকে সত্যায়িত করবে না এবং তাদের অন্যায়ের কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করবে না। তারাই হবে আমার দলভুক্ত। আর আমিও তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি। আর তারা হাওযে কাওসারে আমার নিকট আগমন করবে। (নাসায়ী ৪২০৮, তিরমিযী:২২৫৯, আহমাদ: ১৪৮৬০, মিশকাত:৩৭০০)
হুযায়ফা ইবনু ইয়ামান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা ছিলাম অমঙ্গলের মধ্যে; তারপর আল্লাহ আমাদের জন্য মঙ্গল নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ মঙ্গলের পিছনে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললাম এ মঙ্গলের পিছনে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমি বললাম, এ মঙ্গলের পিছনে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমি বললাম, তা কিভাবে?
তিনি বললেন, আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে, যারা আমার হেদায়েতে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে না এবং আমার সুন্নাতও তারা অনুসরণ করবে না। তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে, যাদের অন্তঃকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তঃকরণ। রাবী বলেন, তখন আমি বললামঃ তখন আমরা কি করবো ইয়া রাসুলাল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতীর সম্মুখীন হই? বললেনঃ তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সস্পদ কেড়েও নেয়া হয়, তবুও তুমি আনুগত্য করবে। (মুসলিম:৩৫৪৪)
দলাদলি করা যাবে না, কোনো বাতিল আদর্শের নিচে বা মানবরচিত বিধানের অধীন কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকা যাবে না, মুমিনদের জন্য পরস্পর মারামারি. হানাহানি, হত্যাযজ্ঞ হারাম!
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গেল এবং জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং মৃত্যুবরণ করলো, সে জাহেলিয়াতে মৃত্যুবরণ করলো। এবং যে ব্যক্তি লক্ষ্যহীন নেতৃতের পতাকাতলে যুদ্ধ করে গোত্রের টানে ক্রুদ্ধ হয় এবং গোত্র প্রীতির জন্যেই যুদ্ধ করে সে আমার উম্মাত নয়। আর আমার উম্মাতের যে ব্যক্তি অস্র ধারন করে আমার উম্মাতেরই নেককার ও বদকার সকলের গর্দান কাটে, আর মুমিনকেও রেহাই দেয়না এবং যার সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় তার অঙ্গীকারও পালন করে না, সে আমার উম্মাত নয়। (মুসলিম: ৩৪৪২-৪৩)
আল্লাহ আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বীনের পথে থাকার ও ভালো থাকার তাওফীক দান করুন!!
বিষয়: বিবিধ
৮৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন